শহরে এসে আমরা যখন প্রথমেই হেঁটে হোটেলের খোঁজ করছিলাম আর পথচারীদের কাছে ঠিকানা জানতে চাইছিলাম তখন কেউ কেউ বলেছেন- এই নামে শহরে পাঁচ-ছয়টা হোটেল আছে। আমরা শহরের এদিক-ওদিক খুঁজতে খুঁজত শেষ কিনারায় উঁচু শৃঙ্গের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা রাস্তার পাশে দাঁড়ালাম। ভ্রমণসঙ্গী মোয়াজ্জেম আর লাহিদুল সবাইকে থামিয়ে বলল, এভাবে এবড়ো-থেবড়ো উঁচু-নিচু রাস্তায় সবার পথ চলার কোনো মানে হয় না। আপনারা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিন আর আড্ডা দিন, আমরা মোবাইলে থাকা ঠিকানা ধরে বুকিং করা হোটেল খুঁজে তথ্য নিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে ফিরে আসছি। শহরের উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখা যাচ্ছে খাড়া পাহাড়ি খাদ। আমি সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে রাস্তার গা ঘেঁষে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। নিচের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে মনে হচ্ছে, আমি যেন কয়েকশ তলা উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছি। শহরটি সমতল ভূমি থেকে ৮ হাজার ফিটেরও অধিক উচ্চতায় অবস্থিত। সোজা নিচের গিরিখাদের দিকে তাকিয়ে আতœার একেবারে গভীরে পৌঁছে যাচ্ছে মৃত্যু ভয়। মানুষ পাহাড়ের চূড়ার প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে এক অন্যরকম আবাসস্থল গড়ে তুলেছে এখানে। ঝিরিঝিরি শীতল হাওয়া আমার শীতের পোশাক ভেদ করে শিরশিরে এক অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছে শরীরে। আর আমি যেন মুগ্ধতার চরমে পৌঁছে যাচ্ছি। মানুষ কেবল মানুষকেই ভালোবাসে না; মানুষ প্রকৃতিও ভালোবাসে। যে কারণে প্রকৃতির একটু পরশ পেতে দূরদূরান্ত থেকে আমাদের মতো হাজারও মানুষ ছুটে আসে এই শহরে।
কিছুক্ষণ পর আমি সামনের দিকে একটু এগুতেই চোখে পড়ল ছোট ছোট মাছ-মাংসের দোকান। দোকানের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে। কিছুক্ষণ পরপর ক্রেতা এসে নিজেদের প্রয়োজন মতো অনায়াসে ১৫০-২০০ গ্রাম মাছ-মাংস কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ক্রেতাদের অল্প পরিসরে মাছ মাংস কেনার দৃশ্য দেখে সত্যি মনটা ভালো হয়ে গেল। মনে হলো এটাই যেন সত্যিকারের ভোক্তা অধিকার। আমাদের দেশের কোথাও বা কোনো তল্লাটে এমন দোকান পাওয়া যায় না। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন নিরাপদ, পুষ্টিকর খাদ্য। মনে হচ্ছে আমাদের দেশের যে সকল মানুষ টাকার অভাবে গোটা মুরগি বা বড় মাছ কেনার সামর্থ্য নাই, তারা যদি ১৫০-২০০ গ্রাম করে দার্জিলিং বাসির মতো কিনতে পারত! তাহলে সত্যিকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ হতো আমাদের দেশে। এদিকে হতাশা নিয়ে ফিরে এসে লাহিদুল আর মোয়াজ্জেম খবর দিলো হোটেলে অনেক দূরে আর রুম খুব নি¤œমানের। তাছাড়া হোটেলে বুকিং থাকলেও আমাদের জন্য কোনো রুম বরাদ্দ রাখা হয়নি। আমরা যখন আবারও হোটেল খোঁজার চেষ্টায় সামনের দিকে হাঁটছি তখন মনে হচ্ছে দার্জিলিং পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুর মধ্যে অন্যতম কারণ ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে প্রকৃতির পরম ছোঁয়া পাওয়া। অবশেষে হোটেল খুঁজে পেলাম আর, আমরা তিন হাজার রুপি করে মোট ৫টি রুম খুঁজে নিলাম। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা সিকিমের রাজার নিকট তে দার্জিলিং অধিগ্রহণ করে এবং এ অঞ্চলের উন্নয়ন করে। এই অঞ্চলে ব্রিটিশরা প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে। মূলত ব্রিটিশদের হাত ধরেই দার্জিলিং শহরের দর্শনীয় স্থান আর বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। শহরের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম টাইগার হিল, রক গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, বাতাসিয়া লুপ, মহাকাল মন্দির, নেপালি কবি ভানু ভক্তের মূর্তি, হ্যাপি ভ্যালি ট্রি স্টেট, পৃথিবীর অন্যতম উঁচু রেল স্টেশন ঘুম। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত সুউচ্চ দার্জিলিং শহরে রয়েছে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বিখ্যাত বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেন্ট পলস স্কুল, সেন্ট জোসেফ স্কুল, দিল্লী পাবলিক স্কুল, আছে আরও অনেক বিখ্যাত স্কুল।
সন্ধ্যার পর আমরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে শহর ঘুরে বেড়ালাম আর যার যার প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে নিলাম। বিশাল উচ্চতায় অবস্থিত এই দার্জিলিং শহরে শপিং মল, ক্যাসিনো, সিনেমা হল, ভিডিও পার্লার, সাইবার ক্যাফে, জামাকাপড় ও ইলেকট্রনিক্সের দোকান ইত্যাদি আধুনিক শহরের সব উপাদানে ভরপুর এ শহর। দার্জিলিং শহর ও তার আশপাশের দ্রষ্টব্য এতই বেশি যে সাইটসিয়িং করতে অন্ততপক্ষে তিন চার দিন সময় লাগবেই। ঢাকা শহরের শত ব্যস্ততা কাটাতে দার্জিলিং শহরে ছুটে এসেছি দর্শনীয় স্থান ঘুরে ঘুরে দেখব বলে। আমরা মাত্র একরাত দার্জিলিং এ অবস্থান করব যার কারণে শহরের সবগুলো স্থান ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। রাতেই গাড়ি ভাড়া করার সময় ড্রাইভারের সাথে আলোচনা করে স্থির করলাম চারটি স্থান ঘুরে দেখার বিষয়ে। রাতের দার্জিলিং শহর দেখে আর রুমে ফিরে ঘুমাতে ঘুমাতে ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটার অধিক বেজে গেল।
আবার রাত তিনটা ত্রিশ মিনিটে অন্য সবার কলরবে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। রাত বারোটার পর ঘুমিয়ে আবার সাড়ে তিনটার আগে জেগে উঠে প্রাকৃতিক দৃশ্যতে দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যাপারটা আমার মোটেও ভালো লাগলো না। আমার রুমের দু’জন ঘুম থেকে উঠে ঘুরতে যাবে এজন্য হইচই করে একটা আনন্দমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছে। আমার আরও কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নিয়ে মাথাটা হালকা করার ইচ্ছে হলো। আসলে চাইলেও সব পরিবেশ পরিস্থিতিতে নিজের চাওয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া যায় না। ভারতের সিকিম ও নেপালজুড়ে অবস্থিত বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে অনেক গল্পকথা শুনেছি । সারা বছর ধরে বরফে ঢাকা থাকে পর্বতশৃঙ্গটি যার কারণে লোভ সামলাতে পারলাম না। মহান সৃষ্টিকর্তার বিশাল উপহার হিমালয় কন্যা কাঞ্চনজঙ্ঘার অনুপম সৌন্দর্য ও চিত্তাকর্ষক সূর্যোদয় দেখার জন্য আমরা রওনা হলাম রাত চারটা দশ মিনিটে। আকাশে চাঁদ নেই তবে ঠান্ডা আর কুয়াশার দাপট চলছে তাই চারদিকে খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন। গাড়ির ড্রাইভার হেড লাইট জ্বালিয়ে রাস্তার দু’ধারে গাছপালায় ঢাকা পাহাড়ি উঁচু রাস্তা ধরে চলছে টাইগার হিলের দিকে। কিছু না খেয়েও যেন আমি ঘুমের কারণে গাড়িতে বসে মাতলামি করছি। কখনো ঝিমিয়ে পড়ার কারণে টস করে মাথা বাড়ি খাচ্ছে গাড়ির জানালার কাঁচের সাথে আর তৎক্ষনাৎ নিদ্রা ভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে বাঁক নেয়ার সময় হেড লাইটের আলো গিয়ে যখন পড়ছে নিচের পাহাড়ি খাদের কিনারায়, তখন ভয় পেয়ে মনে হচ্ছে ড্রাইভারও যদি আমার মতো তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তাহলে আমাদের সলিলসমাধি রচনা হয়ে যেতে পারে নিমিষেই।
আমাদের গাড়ি ভোর ৫টা ১০ মিনিট যখন টাইগার হিল এসে পৌঁছাল তখনও রাত্রির কালো আঁচলের তলায় পুরো পাহাড়ি অঞ্চল যেন চাপা পড়ে আছে। আমাদের মতো শত-শত গাড়ি আর বিপুলসংখ্যক পর্যটক এখানে ভিড় করেছে। কনকনে ঠান্ডায় যখন আমাদের সবাই গাড়ি হতে বেরিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে পায়ে হেঁটে টাইগার হিলের চূড়ার দিকে যাচ্ছে মনে হলো এত ভিড় আর ঠান্ডার মধ্যে টাইগার হিলের উপরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। স্থির করলাম সূর্যোদয়ের সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা যখন তার রূপের ঝিলিক দেখাবে তার দশ-পনের মিনিট আগে টাইগার হিলে গিয়ে পৌঁছাবো। গাড়িতে বসে ঝুমাচ্ছি আর ভাবছি, হিমালয় পর্বতমালার পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ যার উচ্চতা ২৮ হাজার ফুটের অধিক। আর আমাদের অবস্থান করা টাইগার হিলের উচ্চতা ৮৪০০ ফুট। কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া হয়ত এত উঁচুতে যে, হয়ত আকাশের কাছাকাছি গিয়ে মিশে যাবে।
যার কারণে হিমালয়ের পাদদেশের তুষারাবৃত সুবিশাল দানব আকৃতির উচ্চতাসম্পন্ন কাঞ্চনজঙ্ঘার কাছে টাইগার হিল নেহায়েত মা’য়ের আঁচলের নিচে থাকা বাচ্চা শিশুর মতো মনে হবে। আমরা দুজন ৬টা বাজার দশ মিনিট আগে টাইগার হিলে গিয়ে পৌঁছালাম আর টিমের অন্য সবার সাথে দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যে যখন সূর্যোদয় হবে আর তখন বরফে ঢাকা পর্বতের চূড়া সাদা থেকে ক্রমে আকাশের রংয়ের সাথে মিলে নীল হয়ে উঠবে, তারপর নীল রঙ ধীরে-ধীরে চোখ ঝলসানো সোনালী কিংবা গোলাপি রঙে রঙিন হয়ে উঠবে। প্রচ- ঠা-ায় জবুথবু অবস্থার মধ্যেও প্রশান্তির সূর্যরশ্মি উঁকি দিবে পূর্ব আকাশে এই আশায় আমাদের মতো হাজারও মানুষ প্রতীক্ষার গ্রহর গুনছে। কিছুক্ষণ পর সূর্যের ধবধবে ফর্সা আলো কুয়াশার চাদর সরালেই এই কাঞ্চনজঙ্ঘা ভেসে উঠবে আমাদের চোখের সামনে। আমরা ছয়টা দশ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, ঘন কুয়াশার কারণে আমাদের দৃষ্টির সীমানা কিছুদূর গিয়েই আবার যেন ফিরে আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার আশার আলো। আমরা দূরের আকাশের পানে তাকিয়ে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম সূর্যের আলো ফুটলে কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়তো দ্যুতি ছড়িয়ে নিজ অস্তিত্বের জানান দিবে। ঘন কুয়াশার কারণে হিমালয় কন্যা কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিললো না।
আমরা বুক ভরা হতাশা নিয়ে টাইগার হিল ত্যাগ করে গাড়ি এগিয়ে চলল শতবর্ষের প্রাচীন আর পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনাস্থান ঘুম মোনাস্ট্রির দিকে। সূর্যের আলোর দেখা না মিললেও ঘন অন্ধকার কেটে গিয়েছে আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কিছু দুরে পাহাড়ের ঢালে মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে তুলোর আঁশের মতো। চলতি পথে পাহাড়ে ঘেরা শহরটির বিভিন্ন স্থানে টিলার গায়ে ঘরবাড়ি,মন্দির, গির্জা, স্কুল, ক্লাব, হোটেল ইত্যাদি ছড়ানো ছিটনো অবস্থায় চোখে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর আমরা ঘুম মোনাস্ট্রিতে এসে পৌঁছালাম। উপাসনালয়ের ভেতরে সাত সকালে ধর্মচারীরা প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনায় মগ্ন। আমি জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে এদিক-ওদিক খুব মনোযোগ সহকারে তাকালাম। উপাসনালয়ের দেয়ালে সেঁটে দেওয়া আছে পৌত্তলিক যুগের জীবনভিত্তিক কাহিনি থেকে নেয়া পাথরের তৈরি কালো মূর্তি। মূর্তিগুলো প্রাচীন যুগের মানুষের ধর্মবিশ্বাসের চিন্তা চেতনাকে ফুটিয়ে তুলেছে। সত্যিই, অনেক সময় একটি খোদাই করা প্রতিকৃতি শত বছরের পিছনের হাজারো শব্দের কথা যেন একসঙ্গে বলে দেয়।
আমরা বৌদ্ধ মন্দির থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই উঁচু-নিচু সবুজ উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমির রাস্তা পেরিয়ে, ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ বাতাসিয়া লুপ-এ এসে পৌঁছালাম। প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ২০ রুপি। প্রবেশ করেই চোখে পড়ল বহু রকমের গাছে সাজানো বিশাল মনোরম বাগান। বাতাসিয়া লুপের কেন্দ্রে একটি যুদ্ধ স্মৃতিস্মারক আছে। চারপাশে পরিপাটি করে লাগানো রং-বেরঙের ফুল। এ যেন নান্দনিক এক প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমতা মিশ্রিত স্থাপত্য যা চমৎকার আর রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগিয়ে তুলছে মনে। দার্জিলিং শহর থেকে পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথের ট্রেনের যাত্রা সাবলীল করতেই বাতাসিয়া লুপ গড়ে তোলা হয়েছে বলে জানা গেল। দার্জিলিং শহর থেকে মোট ষোল কিলোমিটার রাস্তা বাতাসিয়া লুপ হয়ে পাড়ি দিয়ে ট্রেনে চড়েই ঘুরে দেখা যায় পুরো দার্জিলিং শহর। যার জন্য খরচ করতে হয় পনেরোশ থেকে ষোলশ রুপি। দার্জিলিং শহরের ঘুম রেলস্টেশনকে বলা হয়ে থাকে ভারতের সবচেয়ে উঁচু আর পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ উঁচু রেলস্টেশন। স্টেশনটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। সুউচ্চ পাহাড়ের উপর স্থাপিত বাতাসিয়া লুপের কিনারে দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে মনে হচ্ছে, আশপাশের পুরো অঞ্চল সুবিশাল ও দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ে ঘেরা। উপরে মেঘের ঘনঘটার সঙ্গে আকাশের নীল আর নিচে পাহাড়ের ঢালু থেকে ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত নাম না-জানা বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদের সবুজতা মিলেমিশে একাকার হয়ে অন্যরকম এক আবহ সৃষ্টি করেছে! দূর পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে পাহাড়িদের ছোট ছোট ঘর আর সারি সারি নাম না জানা বৃক্ষের সমারোহ। কী অপূর্ব দৃশ্য! দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে! জায়গাটি যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমীর কাছে স্বর্গরাজ্য মনে হবে। দূরবর্তী পর্বতমালার শিখরগুলি এবং দার্জিলিং শহরের দৃশ্যপট দূরে থেকে কাছে টেনে এনে দেখার জন্য এখানে বাইনোকুলার এবং টেলিস্কোপের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের পাশের কয়েকজন পর্যটক দূরবীনের সাহায্যে বিস্তীর্ণ অপরূপ উপত্যাকাটির এধার-ওধারের সব দৃশ্যপট অবলোকন করছেন। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন আর দিগন্ত আবছা কুয়াশায় ঢাকা থাকার কারণে ৩০০ রুপি খরচ করে আমরা বাইনোকুলার এবং টেলিস্কোপে চোখ রাখলাম না।
দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন শেষে ড্রাইভার বাতাসিয়া লুপ থেকে ঢালু ও খাঁড়া পাহাড়ি রাস্তার বাঁক ঘুরে রওনা হলো রক গার্ডেনের দিকে ঝরনার স্রোতধারা দেখাবে বলে। দার্জিলিং থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে উদ্যানটি অবস্থিত। কিন্তু পাহাড়ি উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা রাস্তা থাকায় পাড়ি দিতে হয় ২৫-৩০ কিলোমিটার পথ। চলতি পথে মাঝেমধ্যেই পাহাড়ি রাস্তার দু’ধারে দাগের আঁচড়ে চোখে পড়ছে ধাপে-ধাপে তৈরি কৃষি আবাদি খেত, কোথাও সমান্তরাল আবার কোথাও ধাপওয়ালা। ঢালু পাহাড়ে চাষ করা ভারি শক্ত আর বিপজ্জনক কাজ। পাহাড়ের চূড়ায় যেসব সাহসী একদল মানুষ যুগ যুগান্তের অসীম পরিশ্রম করে এই ধাপওয়ালা খেতগুলো তৈরি করেছে ফসল চাষের জন্য। মাঠের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে কোথাও পাহাড়ের ছাদে চা বাগানের সবুজতা চোখে পড়ছে আবার কোথাও ফলের বাগান। তবে এখানে গবাদি পশুর তেমন দেখা মিলছে না।
আমরা কাছাকাছি পৌঁছানোর পর ঠিক উপর থেকে নিচেই দিক গভীর বিস্তীর্ণ আর ঘন বনে ঢাকা উপত্যকার খাদের কিনার ঘেঁষে রক গার্ডেন দেখা যাচ্ছে। গাড়ি অনেকটা খাঁড়া পথে নিচের দিকে নামছে, দার্জিলিং শহরের মধ্যে এটাই বোধহয় সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তা। পাহাড়ের গা কেটে সমতলের সঙ্গে সংযোগকারী সড়কপথ নির্মাণে যারা অবদান রেখেছে তারা সত্যিকারের লৌহমানব। রাস্তাগুলোর ধরন দেখে এগুলো যে কয়েক শতাব্দি ধরে এলাকায় বসবাস করা মানুষের কর্মের ফল তা সহজেই অনুমান করা যায়। রাস্তাগুলো প্রশস্ত না-হওয়ার কারণে বিপরীতমুখী গাড়ি পাস হওয়ার সময় হঠাৎ অন্য গাড়িকে সাইড দেয়ার জন্য মোড়ে মোড়ে ব্রেক করছে। এভাবেই গাড়ি কখনো বামে কখনো ডানে মোচড় খেয়ে চলার সময় যখন থেমে যাচ্ছে তখন মনে হচ্ছে এই বুঝি গাড়ি ভারসাম্য হারিয়ে নিচে খাদের কিনারে চলে যাবে।
এমন দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখে আমি গোলক ধাঁধার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। আমি ঘোরের ঘরে বেহুঁশ হয়ে আছি কিনা তা যাচাইয়ের জন্য কখনো নিজকে চিমটি কেটে দেখছি আমাদের এ ভ্রমণ বাস্তব না দৃষ্টিভ্রম! সত্যিই, দার্জিলিংয়ে না এলে এসব ভ্রমণ কাহিনী রূপকথা বলে মনে হতো। শুধু প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিতে দৃশ্য অবলোকন করলেই প্রকৃতির সৌন্দর্যের গভীর গহ্বরে প্রবেশ করা যায় না। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য একটা প্রস্তুত মন থাকতে হয়। অবশেষে আমরা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে রাস্তা থেকে দেখতে পেলাম বিভিন্ন রঙের ফুলে শোভিত হয়ে আছে রক গার্ডেন। এখানে পর্যটকদের মন মাতানোর জন্য একসঙ্গে রয়েছে হ্রদ, ঝরনা ও পাহাড়। প্রতি দিন এখানে বিপুলসংখ্যক পর্যটক ভিড় করলেও আমাদের পদাপর্ণের পর চোখে পড়ার মতো কারো আনাগোনা নেই। আমরাই বোধহয় দিনের প্রথম পর্যটক। রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট একটি হ্রদ। পর্যটকদের কেন্দ্র করে আশেপাশে গড়ে উঠেছে ছোট কয়েকটি চা কফির দোকান। রাস্তা থেকে ঝরনার কাছে যেতেই চির চেনা কলরব মুখর ছলাৎ ছলাৎ স্রোতের ধ্বনি আমাদের কানের নিভৃত গহীনে এসে পৌঁছাল। অস্থির মনকে নিমিষেই স্বস্তি দিতে প্রকৃতির রয়েছে এক দুর্দান্ত শক্তি। বিশেষ করে প্রকৃতির অনেক সুন্দরের মাঝে ঝরনা হলো অন্যতম যা ভেতর থেকে অনুভূতিকে জাগ্রত করে। জলধারার কাছে আসার পর দীর্ঘ সময় বিরতিহীন যাত্রার কারণে ক্লান্ত হয়ে থাকা মনে যেন এক প্রশান্তির মলম মেখে দিলো স্রোতস্বিনী ঝরনা।
মানুষ মন খারাপ দূর করতে সবসময়ই ঝরনার পানে ছুটে যায়। ঝরনা মানুষের সকল মন খারাপ, অভিমান আর বুকের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট দূর করার বড় উপশম। বিশাল বিশাল কালো পাথর খ- পড়ে আছে ঝরনার পথ চলার মাঝে। আমি কিছুক্ষণ ঝরনার সামনে দাঁড়িয়ে পানির কলকল মধুর সুরেলা গীত শুনলাম। তারপর পাহাড়ের সুউচ্চ শিখরের দিকে তাকিয়ে একান্ত মনে ভাবছি, ঝরনা কীভাবে পাহাড়ের বুকের পাথুরে ভাঁজ খুলে মায়াবি ছোঁয়া বুলিয়ে খুব যতেœ চূড়া হতে সমতলে পৌঁছে, মানবের পায়ের নিচে ধসে-পড়ে মিশে যাচ্ছে হ্রদের সঙ্গে। ঝরনার শীতল স্পর্শে রুক্ষ কড়কড়া পাহাড় খুঁজে পেয়েছে প্রাণের ছোঁয়া। সত্যিই, প্রেমিকা যেভাবে যুগলবন্দী করে আগলে রাখে তার প্রেমিককে তেমনিভাবে ঘরনাও যেন জাপটে ধরে রেখেছে তার পাহাড়। আর পাহাড়ের বুকের রেখা ধরেই যুগ-যুগ বয়ে চলছে। পাহাড়ের বুকের মৃত্তিকা খুঁড়েই বসবাস গড়েছে ঝরনা। সাংসারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রী যদি ভালোবাসায় যুগলবন্দী হতো পাহাড় আর ঝরনার মতো, তাহলে কপোত-কপোতীর বুকের জমিনে বইত স্রোতস্বিনীর মতো ছন্দময় অনন্ত প্রেরণার আনন্দধারা। ভালোবাসার কোমলতায় মুড়ে দিতে পারত একে অপরের হৃদয়। হঠাৎই পিছন থেকে এক সহকর্মী বলল, চলেন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ঝরনার উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে দেখে আসি।
ঝরনার উচ্চতর সিঁড়ির ধাপগুলো পর্যায়ক্রমে নিচ হতে উপরের দিকে বিস্তৃত করেছে রক গার্ডেন। আমরা এক ধাপ উপরে উঠতেই চোখে পড়ল সিঁড়ির পথের পার্শ্ববর্তী সৌন্দর্যস্থল যা কিনা বেশ খানিকটা কংক্রিট দিয়ে কারুকার্য করে নির্মাণ করা হয়েছে। কারুকার্য শোভিত স্থান এর আশেপাশে বিভিন্ন রকমের ফুলের সমাহারে উদ্যান করা হয়েছে। উদ্যানে ফুলবাগানের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের গা ঘেঁষে বসার স্থান তৈরি করা হয়েছে। ঝরনার নৈসর্গে বন্ধ্যা বন্য পাহাড়ের চারপাশে নানান জাতের ফুল ফুটে থাকার দৃশ্যপট দেখে মনটা ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে।
মনে হচ্ছে, প্রকৃতির মাঝে মানুষের মন ভালো করার এক অদ্ভুত ওষুধ রয়েছে, যা প্রকৃতির মাঝে একান্তভাবে মিশে গেলেই কেবলমাত্র অনুভব করা যায়। সৃষ্টিকর্তা যেন পাহাড় আর ঝরনা তৈরি করেছেন আপন রঙের মাধুরী মিশিয়ে।
আমরা হিমশীতল মেঘ ছুঁতে ছুঁতে সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে যতই উপরে যাচ্ছি মনের রোমাঞ্চ যেন ততই বাড়ছে। পাথরের বুক কেটে সৃষ্ট রাস্তা ধরে আমরা যখন ঝরনার শিখরে পৌঁছালাম তারপর আবারও আমি ঝরনার পানে অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখলাম পাহাড়ের পাথুরে চোয়াল ভিজিয়ে ঝরনা ঝিরিঝিরি ধারায় নিচের দিকে বয়ে চলেছে। ঝরনার সৃষ্ট স্থল কোথা হতে এটা গভীর ঘন জঙ্গলের কারণে নিচ হতে তাকিয়ে পাহাড়ের নিশানা দেখা সম্ভব হলো না। রক গার্ডেনের দৃশ্য অবলোকন শেষে আমাদের গাড়ি নিচ হতে উপরের দিকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে ফিরে চলল দার্জিলিং শহরে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে আমরা শহরে পৌঁছে সকালের নাশতা সেরে নিলাম। পাহাড়ের রাণীর মোহময়ী সৌন্দর্য্য আর মায়াবী আকর্ষণের সম্পূর্ণ স্বাদ পেতে হলে কমপক্ষে চার-পাচদিন অবস্থান করা উচিত দার্জিলিং শহরে, আমরা মাত্র একরাত্রি অবস্থান করেছি।
আমরা দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে দু’টো টাটা সুমো জিপ চার হাজার রুপিতে ভাড়া করলাম। দুরন্ত ও রোমাঞ্চকর পাহাড়ের গা বেয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্গ ভূমি দার্জিলিং থেকে ৫ ঘণ্টায় শিলিগুড়ি এসে পৌঁছালাম। শিলিগুড়ি একরাত অবস্থান করে পরদিন ভোরে বাগডোগরা বিমানবন্দর তারপর কলকাতা হয়ে আবারও দেশের চিরাচরিত কর্মব্যস্ত জীবনে ফিরে এলাম। জীবনের খানিকটা সময় স্বপ্নের মতো সুন্দর জায়গায় কাটানোর শখ সবার মধ্যেই জাগে। আলাদিনের চেরাগের চেয়েও অধিক ক্ষমতাধর হাতের স্মার্টফোন নামক যন্ত্রটিতে ঘষা দিলেই মুহূর্তে ইউটিউব, গুগল ও অন্যান্য মাধ্যমে সব বিনোদন এসে হাজির হয় হাতের মুঠোয়। এসব দর্শনীয় স্থানগুলো ইউটিউবে ভিডিও দেখে আর পত্রিকার নিউজ পড়ে তথ্য সংগ্রহ করে চোখ বুজে কল্পনার জগতে প্রবেশ করে যতোটা সৌন্দর্য দাঁড় করানো যায়, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। অপরিচিত স্থানে গিয়ে মনের ক্লান্তি দূর করে মানুষ নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার করবে এই ভাবনায় মনে মাঝেমধ্যে ভ্রমণের জোয়ার আসে, আবার পকেট শূন্য থাকলে ভাটার টানও পড়ে। আসলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায় টাকা। টাকার অভাবে অনেকে বিদেশ তো দূরের কথা, নিজের দেশটাও ভালোভাবে ঘুরে দেখতে পারেন না। মানুষের কল্পনা আর বাস্তব ভ্রমণের মধ্যে পার্থক্য অনেক। যদি খরচ করার সামর্থ ও ইচ্ছে থাকে তাহলে পর্যটক ও ভ্রমণপ্রেমীরা চোখ বন্ধ করে অল্প টাকা খরচে অনায়াসে পাড়ি জমাতে পারেন অনিন্দ্যসুন্দর সিকিম ও দার্জিলিং শহরের বিভিন্ন স্থান।.ajoymondal325@yahoo.com