গত ৩০ এপ্রিল মেঘনার স্থানীয় সাংবাদিক হাসান মাহমুদ মুক্তির একটি সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুক্তি তার ফেসবুক ওয়ালে টেঁটাবিদ্ধ অবস্থায় একটি শোল মাছ এবং পানিতে সদ্যজাত শোল মাছের একঝাঁক পোনার ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘প্লিজ, এই কাজটি করবেন না। গ্রামের মানুষকে সচেতন হওয়ার জন্য অবদান রাখুন। কতটা ভয়ঙ্কর অপরাধ করছেন, আপনি ভেবে দেখেছেন? লাখো কোটি মাছের পোনা এতিম হয়ে যায় মা শোল মাছটি শিকার করার কারণে। মা মাছটি এর শিশু সন্তানের জন্য প্রাণের মায়া ত্যাগ করে অন্য মাছের কবল থেকে শিশুদের রক্ষা করে। মাছটি নিজেও জানে, এ সময় নির্দয় মানুষ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করবে। জেনেও নিজের জানের মায়া ত্যাগ করে শিশুদের (পোনা) ছেড়ে যায় না। শিশুদের পাহারারত অবস্থায় অমূল বিদ্ধ হলো টেঁটায়।’
বৈশাখ থেকে আষাঢ় শোল-গজারের বাচ্চা দেয়ার সময়। শোলের পোনা লাল আর গজারের পোনা ছাই বর্ণের। শোল মাছের কয়েক লাখ পোনা জটবেঁধে যখন পানিতে ডুব-সাঁতার কাটে তখন মনে হয় কে যেন শিশি থেকে আলতা ঢেলে রেখেছে। শোল মাছের বৈজ্ঞানিক নাম ঈযধহহধ ংঃৎরধঃধ, ইংরেজি নাম ংহধশবযবধফ; গজার মাছের ইংরেজি নাম এৎবধঃ ংহধশবযবধফ,, বৈজ্ঞানিক নাম ঈযধহহধ সধৎঁষরঁং. বর্গের দিক থেকে এরা স্বকেন্দ্রিক জীবের একটি বৃহত্তর গোষ্ঠী, যাদের চলন-বলন স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত; যারা জীবন ধারণের জন্য অন্য জীবের ওপর নির্ভরশীল। হাজার বছর থেকে যে শোল-গজারের দাপটে জলাশয়ের অপরাপর মাছ দৌড়ের ওপর থাকত আজ সেই শোল-গজার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেই দৌড়ের ওপর আছে। গজার মাছের অস্তিত্ব সঙ্কটের বিষয় লিখতে গিয়ে মনে পড়ে, পরাক্রমশালী মুঘল সাম্রাজ্যের কথা। একসময়ে মুঘল সাম্রাজ্যের আওতায় ছিল বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। প্রবল প্রভাবশালী এই সাম্রাজ্যের বার্ষিক রাজস্ব ছিল চার হাজার টন রুপার চেয়েও বেশি। বিশ্বের মোট জিডিপির ২৫ শতাংশ একাই জোগান দিতেন সম্রাট আকবর। সেই সময়ে ইউরোপের বিলাসবহুল শ্রেণীও মুঘল সাম্রাজ্যের ধারে কাছে ঘেঁষতে পারত না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! যে সম্রাট শাহজাহান ২০ বছর ধরে তাজমহল বানালেন শ্বেতপাথর আর হীরা-জহরত দিয়ে, সেই শাহজাহানের উত্তরাধিকারীদের বাস হয়েছিল বস্তিতে। জীবন চলত অনুদানের ছয় হাজার রুপিতে।
মুঘলদের দাপট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার উপমাটা গজার মাছের বেলায় খাটে। ওটঈঘ তালিকায় মিঠাপানির প্রতাপশালী মাছটি আজ বিপন্ন প্রজাতির। গজার ঘাসের মধ্যে বাসা করে ডিম পাড়ে। ডিম পানির ওপর একটির সাথে আরেকটি লেগে থাকে। ডিম ফোটার পর ছানার ঝাঁক কু-লী পাকিয়ে চলে। কালো কু-লী আগলে রাখে বাবা ও মা গজার। টাকি (ছোট আকারের গজার) স্বাধীনভাবে চলাচলের যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত বাবা-মায়ের পাহারা বন্ধ হয় না। সেই শৈশবে বড়শি থেকে শুরু করে পলো, কোঁচ-জুইত্তা পর্যন্ত, গজার মাছ নিধনে কোনো অস্ত্র-প্রযুক্তি বাদ পড়েনি। গজার মাছ ধরা নিয়ে আমার জীবনে যত কাহিনী তত কাহিনী অন্য মাছ নিয়ে হয়নি। কথায় বলে, ‘গজার মাছ খাইলে বিশ্বাস’, এ কথার অর্থ, বাঘের প্রজাতি বলে গজারের শরীরে ভীষণ শক্তি। সাধারণ জাল ছিঁড়ে বের হয়ে যায়। পলো ভেঙে ফেলে। শক্ত হাতে ধরলেও ফসকে যায়, এমনকি বঁটি দিয়ে কাটতে গেলেও চাঁটি মেরে ফসকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বহু ভৌতিক গল্পের প্রচলন আছে গজার মাছ নিয়ে। মেছোভূতের প্রধান খাদ্য গজার মাছ। বিশেষ করে গজার মাছ মুখে করে নেয়ার সময় মুখ থেকে ফসকে ঘরের চালে পড়ার গল্পও শোনা যায়। আমার শৈশবের সাথে শোল-গজারের সম্পর্ক কাল্পনিক নয়। শৈশবে গামছা লুঙ্গি দিয়ে ধরতাম পোনা। বর্ষার শুরুতে খাল-বিলের পাশ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে পানিতে ‘বুদবুদ’ দেখলেই অনুসন্ধান শুরু করে দিতাম। অনুসন্ধানকালে পোনার সাথে দেখা হয়ে যেত শোল-গজারও। পোনা ৮-১০ ইঞ্চি লম্বা (টাকি) হওয়া পর্যন্ত জোটবদ্ধ থাকে। টাকির ঝাঁকের ওপরে কনুই জাল মেরে পানিতে নেমে পড়তাম। জালের ভেতর থেকে বিশেষ কায়দায় ধৃত মাছে নায়ের তলা ভরে উঠত। পরিণত বয়সের গজার ধরতাম কোঁচ ও জুইত্তা দিয়ে। আমাদের গাঁয়ের ঠিক মাঝামাঝি শতবর্ষের মজাপুকুর ছিল। প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট পুকুরটির গভীরতা সম্পর্কে কারো কোনো সঠিক ধারণা ছিল না। শীতকালে পুকুরে মাথা ভাসিয়ে রোদ পোহাতো শ’ শ’ গজার। শুধু গজার নয়, ব্যাঙ, কচ্ছপ, গরু মারা যাওয়ার পর মাঠ ছেয়ে যাওয়া শকুন, আমনের ক্ষেতে টুলুপ ডাকা কোড়া, ঝোপের আড়ালে শরীর লুকিয়ে কোয়াক কোয়াক ডাকা ডাহুকের ডাকও এখন আর শোনা যায় না।
১৯৬০ সালের ঘটনা। স্কুলে আসা-যাওয়া সবে শুরু করেছি। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের সামনে দু’টি ডোবা। স্কুলের বারান্দা ভরাট করতে গিয়ে ডোবা দু’টির সৃষ্টি। শুষ্ক মৌসুমে একটার তলায়ও পানি থাকে না। বৈশাখী ঝড়ের সাথে বৃষ্টি শুরু। বৃষ্টির পানিতে যখন ডোবা দু’টি ভর ভর, তখন ঝোপ-জঙ্গল থেকে দলে দলে ব্যাঙ বেরিয়ে আসে। ঝুপঝাপ শব্দে ডোবার পানিতে নামতে শুরু করে। রাত-দিন এদের ‘ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, ডাকা ডাকিতে পাড়া মুখরিত। আমরা পাড়ে দাঁড়িয়ে ব্যাঙের লম্ফ-ঝম্ফ ও কোলাকুলি খেলা দেখি, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বর্শা বানিয়ে হাতের নিশানা ঠিক করি। অব্যর্থ নিশানা নিয়ে মাঝে মধ্যে প্রতিযোগিতাও হয়। ক্রীড়ারত জোড়া ব্যাঙ লক্ষ্য করে নিশানা ঠিক করার মজাই আলাদা।
কিছু দিন পরেই দেখতাম, ডোবার জলে মরা ব্যাঙ ফুলে উঠেছে। মরা ব্যাঙের পাশেই সাবুদানার মতো থোকা থোকা কী সব ভেসে রয়েছে। ক’দিন পরেই দেখি, সাবুদানাগুলো নেই। কিলবিল করছে কুচকুচে কালো ডুমুরের বীচির মতো অসংখ্য পোনা। ডোবা ভর্তি কিলবিল করা পোনার পেছনে আলপিনের মতো ছোট ছোট লেজ। পোনাগুলো লেজ নেড়ে নেড়ে সারা ডোবায় রাজত্ব করছে। ডোবার পানি কমতে না কমতেই চলে আসে জ্যৈষ্ঠ মাস। আকাশে তুলার মতো পেঁজা পেঁজা মেঘের আনাগোনা। কখনো কখনো মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায় সূর্য। শুরু হয় অবিরাম বৃষ্টি। ক্ষণিক বিরতি দিয়ে ইলশেগুঁড়ি মুষলধারায় পরিণত হয়। বৃষ্টির পানিতে বাড়ির চার পাশের নালা-ডোবা ভরে উঠতে থাকে। ডোবার উত্তর-পূর্ব দিকে একটি কুঁড় (পরিত্যক্ত গভীর জলাশয়)। প্রচলিত আছে, একসময় এ কুঁড়ের নিচে ছিল কামলাদের বাড়িঘর। জনৈক পীর খোয়াজ খিজির আ: জলের অধীশ্বর। কামলারা খোয়াজ খিজির আ:-এর লোক। খিজির আ: কামলাদের দিয়ে নদী ভাঙা-গড়ার কাজ করান। আমাদের গ্রাম নদীর পাড়ে। তাই সবাই কামলাদের সমীহ করে চলেন। কামলারাও কারো কোনো ক্ষতি করেন না। ইনারা নানাভাবে মানুষের সাহায্য করেন। কারো বাড়িতে বড় কোনো কাজকর্ম হলে হাঁড়ি-পাতিল সাপ্লাই দেন। হাঁড়ি-পাতিলের জন্য কুঁড়ের পাড়ে গিয়ে আগের দিন সন্ধ্যায় আবেদন করতে হয়। কামলারা রাতের বেলা হাঁড়ি-পাতিল উঠিয়ে রাখেন। একবার একটি মূল্যবান পাতিল খোয়া যায়। এর পর থেকে কামলাদের হাঁড়ি-পাতিল সরবরাহ বন্ধ। কামলাদের ভয়ে ওই কুঁড়ের পানিতে মাছ ধরা দূরের কথা, কেউ হাত-পাও ভিজায় না। কুঁড় ইয়া লম্বা কচুরিপানায় ভর্তি। কোন আমলের কচুরিপানা কেউ বলতে পারেন না।
কুঁড়ের তিনপাড় ঝোপ-জঙ্গলে ভরা। ভয়ে দিনের বেলায়ও গা ছমছম করে। এক সময় ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর ছিল জ্বিন-ভূতের আখড়া। অসংখ্য জোনাকি জ্বিন-ভূতের আখড়ায় আলো দিত। জ্বিন-ভূতের স্বভাব-চরিত্র মোটেও ভালো ছিল না। ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানাভাবে মানুষের ক্ষতি করত। গাঁয়ের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে খোয়াজ খিজির আ:-এর আশ্রয় নেন। জ্বিন-ভূত খোয়াজ খিজির আ:-এর কথায় অবাধ্য হয়। খিজির আ: শাপ দেন। সেই শাপে জ্বিন-ভূত মর্যাদা হারায়। মর্যাদা হারিয়ে পরিণত হয় গজার মাছ আর কচ্ছপে। (সবই লোক পরস্পর শোনা কথা)
শীতের সকালে কাঁচা রোদে গজার মাছ ভেসে উঠত। অসংখ্য গজার। আমরা গজারের মাথা গুনতাম। গজার বুড়ো কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে শিরদাঁড়া ও মাথা জাগিয়ে রোদ পোহায়। গাব গাছের গোড়ার মতো মোটা ছিল কোনো কোনো গজারের মাথা। একটা দুইটা নয়, শত শত গজার। এর মধ্যে এক জোড়া গজার সবার পরিচিত। গজার দু’টি যেমন বড় তেমন কালো। পরিচিতির কারণ, একটি গজারের মাথার কিছু অংশ সাদা। কী কারণে সাদা কেউ বলতে পারে না। আমরা বলতাম ‘কুঁড়ের রাজা’। মাথার সাদা অংশ রাজমুকুট। রাজমুকুট পরা রাজার পাশেই থাকে রানী। শত মাছের ভিড়ে সবার চোখ রাজা-রানীকে খুঁজত। অসংখ্য গজার মাছ আর কাছিম রোদ পোহানোর সময় কেউ এদের মারা তো দূরের কথা, ঢিল ছুড়ে বিরক্ত করতেও ভয় পেত। ঝোপঝাড়ের সাথে আর ছিল হিজল মাদার জাতীয় জংলাগাছ। জংলাগাছের যেসব ডালপালা কুঁড়ের পানিতে নুইয়ে পড়েছিল সেসব ডালপালা দখল করে রাখত কচ্ছপ। ছোট কচ্ছপকে কাউট্টা আর বড়গুলোকে বলে কাছিম। ড্রামের তলার মতো গোলাকার কোনো কোনো কাছিমের ওজন দেড়-দুই মণের বেশি। শৈশবে দেখতাম কচ্ছপ শিকারিদের। কচ্ছপ শিকারিরা হাতে পাঁচশলা টেঁটা, কাঁধে পাটের ঝুলনা ঝুলিয়ে পাড়ের জঙ্গলে প্রবেশ করত। টেঁটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটির নিচের কচ্ছপ তুলে আনত। ঝুলনা ভর্তি করে নিয়ে যেত। শিকারিরা কুঁড়ের পাড় থেকে কত কচ্ছপ নিয়ে গেছে তার লেখাজোখা নেই।
বর্ষায় কুঁড়ের দক্ষিণ পাড় প্লাবিত হয়। প্লাবিত অংশ দক্ষিণের বিলের সাথে একাকার হয়ে পড়ে। বর্ষার পানিতে প্লাবিত হওয়ার পরেও মাথায় মুকুট পরা রাজা গজার রাজ্য ছেড়ে যেত না। কুঁড়ের উত্তর দিকে চলাচলের কাঁচা সড়ক। পূর্ণ বর্ষায় কখনো কখনো কাঁচা সড়ক তলিয়ে যায়। তখন বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাচল করতে হয়। সাঁকো দিয়ে চলাচলের পথে প্রতি বছরই দু-একটি শিশু সাঁকো থেকে পড়ে যায়। পড়ার সাথে সাথে তলিয়ে যায় গভীর পানিতে। অনেক অনুসন্ধান করেও তলিয়ে যাওয়া শিশুদের হদিস পাওয়া যায় না। স্কুল ঘরটি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে স্থানান্তরের সময় কুঁড়ের পশ্চিম-দক্ষিণ পাড়ে একটা পায়খানা বসিয়েছিল। পাকা পায়খানা। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়া আশপাশের লোকজনও পায়খানাটি ব্যবহার করত। নির্মাণের মাস ছয়েক পর, এক সকালে দেখা গেল, পায়খানা উদাও। কোথায় গেল পায়খানা? নৌকায় চড়ে লম্বা বাঁশলগির সাহায্যে কুঁড়ের তলদেশে শুলুক-সন্ধান করা হয়েছে। অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা বলাবলি করতাম, ‘রাজপুরীতে পায়খানা? রাজা ক্ষুব্ধ, তাই উধাও।’ কুঁড় ও ডোবার মাঝে ছিল একটা চিকন নালা। শুষ্ক মৌসুমে নালাসহ জমিতে কৃষকরা পাট বুনে রাখে। বর্ষার শুরুতে কুঁড়ের সাথে ডোবার প্রথম সংযোগ ঘটে নালার মাধ্যমে। ক’দিন আগে নালায় পানি ঢুকে ডোবা আর কুঁড়ের পানি এক হয়ে গেছে। মেঘ, বৃষ্টি ও বর্ষা আমার প্রিয়। বর্ষার আগমনে নতুন পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উজাতে শুরু করে। দল বেঁধে ছিপ-বড়শি ফেলে নতুন পানিতে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। লেখাপড়া ইচ্ছা করে না, আমার কেবল ইচ্ছা করে ডোবার পাড়ে দাঁড়িয়ে নতুন পানিতে ছিপ-বড়শি দিয়ে দল বেঁধে মাছ ধরা। স্কুলে যাই ঠিকই, মাথায় কিলবিল করে মাছ আর মাছ। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সামনের ডোবার পাড়ে যাই। উজাইন্যা মাছ খুঁজি। ডোবায় কয়েক দিন আগে লেজযুক্ত কালো পোনা দেখেছিলাম, নতুন পানি এসে পোনাগুলো এলোমেলো করে দিয়েছে। উজাইন্যা মাছের সাথে সাপও থাকে। মুখে মাছ নিয়ে কালো ডোরা কাটা ডোরাসাপ প্রায়-ই দেখা যায়। মাছ ও ব্যাঙ ধরার জন্য ঘাসের ফাঁকে সাপ লুকিয়ে থাকে। তাই সাবধানে পা ফেলে ডোবায় উজাইন্যা মাছ ঢুকেছে কি না খোঁজাখুঁজি করছিলাম।
এক স্থানে দেখি, কালো মেঘের মতো একটা কু-লী জট পাকিয়ে পাক খাচ্ছে। পৃথিবী যেভাবে পাক খায় সেভাবে ডোবার ভেতর পরিভ্রমণ করেছে কু-লীটা। অদ্ভুত ও বিস্ময়কর ধূসর রঙের বস্তুটি আমাকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। ঘোর থেকে বের হওয়ার জন্য বস্তুটির কাছে যেতে চাই। একটু একটু ভয়ও লাগছে। পানিতে নামতে শুরু করি। ঘূর্ণায়মান বস্তুটির কাছে গিয়ে মাথা নুইয়ে চোখ ফেলতেই ঘোর আরো বেড়ে যায়। দেখি, অসংখ্য রেণু গায়ে গায়ে জড়াজড়ি করে ঘুরপাক খাচ্ছে। পানি নড়ে ওঠায় কালো মেঘের মতো জটবাঁধা কু-লী দূরে সরে যেতে শুরু করে। রেণুগুলো কালো ছাইয়ের মতো নানা আকার ধারণ করে বেশ দূরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই অদ্ভুত বস্তুটি নানা আকৃতি ছেড়ে পুনরায় গোলাকার আকৃতি ধারণ করে আস্তে আস্তে পাড়ের দিকে আসে। আমিও আস্তে আস্তে হাঁটুপানি থেকে রান পানিতে নেমে আসি। অদ্ভুত বস্তুটির একেবারে কাছে এসে পড়েছি। এমন সময় আমার ডান পায়ের গোড়ালীতে কী যেন আঘাত অনুভব করি। আঘাতটি ভাঙা কাচ বা শক্ত কাঁটা দিয়ে সজোরে আঁচড় দিলে যেরকম বোধ হয় ঠিক সেরকম। আঘাতের সাথে সাথে পিচ্ছিল কী যেন পায়ের পাতার অর্ধেক কামড়ে ধরে আমাকে ডোবার পানিতে নামিয়ে নিতে চাচ্ছে। প্রচ- ব্যথা আর আতঙ্কে ডাক-চিৎকারসহ পাড়ে লুটিয়ে পড়ি। দংশিত স্থান থেকে রক্ত বের হতে দেখে আমার কান্নার জোর আরো বেড়ে যায়।
আমার চিৎকারে স্কুল থেকে শিক্ষকসহ শিক্ষার্থী বের হয়ে আসেন। রক্তাক্ত পা দেখে সবাই ভয় পেয়ে যায়। সবাই মনে করেছিল, আমাকে সাপ কামড়েছে। নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখার পর বুঝতে পারে, এটা সাপের কামড় নয়। অল্পক্ষণেই আবিষ্কার হয়ে পড়ে, আমাকে মাছে কামড়েছে। গজার মাছ ডিম দেয়ার সময় হলে গভীর পানি ছেড়ে ফসলের জমি কিংবা ডোবা-নালায় চলে আসে। বিশেষ করে ধান ও পাট ক্ষেতে আবর্জনা জড়ো করে ডিম ছাড়ে। ডিম থেকে পোনা বের হলে শুরু হয় পাহারা। গজার যেভাবে রাক্ষসের মতো অপরাপর মাছ খায়, সুযোগ পেলে গজারের পোনাকেও অপরাপর মাছ খেয়ে ফেলে। হয়তো নিজের কৃতকর্মের কথা ভেবেই পেটে ডিম এলেই গজারের আরাম হারাম হয়ে যায়। অন্য মাছের নাগালের বাইরে চলে যায়। মাছের পেটে ডিম এলেই মাছ অস্থির হয়ে পড়ে। ঘন ধানক্ষেত বা পাটক্ষেতে কিংবা নিরিবিলি স্থানে দাঁত দিয়ে ঘাস বা আবর্জনা কেটে ছড়িয়ে রাখে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আবর্জনায় ডিম ছাড়ে। গজার শিকারি ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে ডিমের অবস্থান বুঝার সাধ্য নেই। ছয়-সাত দিনের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। আহার-নিদ্রাসহ নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভুলে মা ও বাবা গজার বাচ্চাদের আগলে রাখে। শিশুদের নিরাপত্তা বিঘিœত হলে ভুলে যায় জীবনের নিরাপত্তার কথা। বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্যই পায়ে কামড়েছে। মাছটা এই ডোবাতেই আছে বলেই কেউ কেউ কুঁড়ের সাথে ডোবার সংযোগ নালাটি জাল দিয়ে বন্ধ করে দেয়। দেখতে না দেখতেই কয়েকজন কোচ, টেঁটা, পলোসহ নানা প্রকারের জাল নিয়ে আসে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই মানুষ কামড়ানো গজারটি ধরা পড়ে। গাব গাছের গোড়ার মতো মাথা বিশিষ্ট মাছটি প্রচ- আক্রোশে তড়পাচ্ছিল। অভিযান শেষ, সবাই উঠে আসে ডোবা থেকে। এর মধ্যে ঘোষণা এলো, গজার মাছ কখনো একা থাকে না। জোড় গজার এই ডোবায়ই রয়ে গেছে। আবার নামে কাদাজলে। অল্পক্ষণের মধ্যেই পলোয় ধরা পড়ে জোড় গজার। মাছটা এতই বড় যে, পলোর ভেতর ঠাঁই হচ্ছিল না। কয়েকজন মিলে চেপে ধরেছিল। অনেক চাপাচাপির পর কাবু করে ডাঙায় তোলা হয়। সবাই ভিড় করে দেখতে আসে। অনেকের প্রশ্ন, এত বড় মাছ এ ডোবায় মরতে এলো কেন? উত্তর, কেন আসবে না! পোয়াতি হলে গজার আর গজার থাকে না, পাগল হয়ে যায়। জ্ঞানহারা পাগলেরা যে রকম উল্টাপাল্টা কাম করে পোয়তি গজারও সে রকম উল্টাপাল্টা কাম করে। পাগলা গজার দেখার জন্য লোকজন ভিড় করতে থাকে। আলিশান গজারটা নিস্তেজ হওয়ার পর সবাই দেখে, মাথার অর্ধেক সাদা। কুঁড়ের রাজা রানীসহ ধরা পড়েছে। রাজ দম্পতি নিজের শিশুর নিরাপত্তার জন্য রাজ্য ছেড়ে উঠে এসেছিল ডোবায়। এক দিকে মনুষ্যজাত মৎস্যরাজের প্রাণ কেড়ে নিলো, অপর দিকে রাজ দম্পতি ধরতে গিয়ে টুনটুনি ডোবার ঘনকাদাজলে হারিয়ে যায় মেঘের মতো জটবাঁধা রেণুগুলোও।’ পরিশেষে, সম্পূর্ণ প্রতিকূল অবস্থায় বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জনকারী গজার মাছ নির্বংশের জন্য আমরাই দায়ী। ফ্রোজেন ও খামারজাত শোল-গজার ছাড়া প্রকৃতি থেকে মিঠাপানির শোল-গজার হারিয়ে গেছে কবেই। ডোবা-নালা ও খাল-বিলে যে কয়েকটা অবশিষ্ট আছে এই প্রজনন মৌসুমে বাচ্চার মায়ায় বাইরে এলে নিধন হয় নির্দয় মানুষের হাতে। শক্তিশালী এ মাছটি রক্ষার উদ্যোগ না নিলে একদিন এই মাছটির নাম-নিশানাও মুছে যাবে অভিধানের পাতা থেকে।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক E-mail: adv.zainulabedin@gmail.com