জনসংখ্যার চাপে বসতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানীর প্রয়োজন মিটাতে ক্ষুদ্রাকৃতি এ বাংলাদেশের বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে-ক্রমেই, সংকোচিত হয়ে আসছে বনভূমির পরিমাণ। অভাব দেখা দিচ্ছে কাঠ, বাঁশ, ফল-মূল এবং ঔষধ-পত্র তৈরীর প্রয়োজনীয় বনজ দ্রব্যাদির। এভাবে আর ক’বছর চলতে থাকলে দেশে বনভূমির পরিমাণ শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার পরিনাম হবে ভয়াবহ। মানুষসহ প্রাণীকূল বেঁচে থাকবেনা, দেখা দিবে বিপর্যয়, বিধ্বস্ত হবে সভ্যতা, বিপন্ন হবে দেশ ও জাতির অস্তিত্ব। আমাদের দেশে প্রতি বছর ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রচুর পরিমানে গাছের চারা রোপন করা হয়। খরচ করা হয় কোটি কোটি টাকা। তার মধ্যে ক’টা গাছের চারা বেঁচে থাকে আর বড় হয় তা পরীক্ষা, পর্যালোচনা করলে এবং পত্র-পত্রিকার সংবাদাদি নিয়ে গবেষণা করলে সার্বিক হাল অবস্থা সহজেই আঁচ করা যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে বৃক্ষ রোপনই শেষ নয়, প্রয়োজন যতœ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষনের ব্যবস্থা করা। অপ্রিয় হলেও সত্য, আমরা এদিকে খুব কমই দৃষ্টি দেই। বনভূমি ধ্বংসের বিপরীতে বনাঞ্চল সৃষ্টির প্রয়াসে যেটুকু করা প্রয়োজন আমরা তা করছি না। প্রয়োজনীয় উৎসাহ-উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমি দীর্ঘদিন ধরে বনাঞ্চল সৃষ্টি এবং পরিবেশের উপর গবেষণা ও পর্যালোচনা করে আসছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন স্থানে বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণ ও রোপন করে তা রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছি। আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছি এবং এ ব্যাপারে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তার আলোকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি সুচিন্তিত সুপারিশ পেশ করছি।
সুপারিশমালা ঃ ১). আমাদের দেশে এপ্রিল-মে মাস হতেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়। তাই এ সময়ে বেশি গাছের চারা রোপন করা উচিত। নিদিষ্ট সময় বেঁধে না দিয়ে পহেলা মে থেকে বর্ষাকাল পর্যন্ত বৃক্ষ রোপন মৌসুম হিসাবে গণ্য করে এ সময়ে বৃক্ষচারা রোপন করতে হবে। তাহলে রোপিত চারা বৃষ্টির মৌসুমে চার/পাঁচ মাসের মধ্যে বড় হয়ে গরু-ছাগলের নাগালের বাইরে চলে যাবে। ২). স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা-মসজিদসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, বসতবাড়ী, রাস্তার পাশে, নদীর তীরে, বেড়িবাঁধে, উপকূল বেষ্টনীতে বাধ্যতামূলকভাবে ফলজ ও বনজ গাছের চারা রোপন করার ব্যবস্থা করতে হবে। রোপনকৃত এসব গাছের চারা দেখাশুনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মহলসমূহের উপর ন্যস্ত করতে হবে। পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকতে হবে। সরকারী খাস জমি, টিলা বা মহালসমূহ, পতিত জমি এবং চা বাগানসমূহের অনাবাদী জমিতে বনাঞ্চল সৃষ্টির দায়িত্ব বন বিভাগের উপর ন্যস্ত করতে হবে। বনাঞ্চল সৃষ্টির জন্য এ জমি লভ্যাংশের ভিত্তিতে দীর্ঘ মেয়াদী লীজও দেয়া যেতে পারে। ৩). শহরে বাসা-বাড়ীর আঙ্গিনা ও গ্রামাঞ্চলে গাছের চারা রোপন ও রক্ষণাবেক্ষনের জন্য সকল শ্রেণীর মানুষকে সচেতনতার মাধ্যমে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে হবে এবং মওসুমের শুরু হতে সরকারী নার্সারী থেকে বড় আকারের পর্যাপ্ত গাছের চারা স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা এরপর সকল বিভাগ, জেলা ও থানা পর্যায়ে নার্সারী প্রতিষ্ঠা করে পর্যাপ্ত বৃক্ষচারা মজুদ রাখতে হবে, যাতে সাধারণ ক্রেতারা তা সহজেই স^ল্পমূল্যে সংগ্রহ করতে পারে। ৪). বৃক্ষচারা রক্ষণাবেক্ষনে কড়া নজর রাখতে হবে এবং বিভাগীয় প্রধান ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় হতে কম করে হলেও মাসে একবার রোপিত বৃক্ষচারা পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। জেলা, বিভাগ ও জাতীয পর্যায়ে ‘ভিজিলেন্স টিম’ থাকতে হবে-যাতে রোপিত চারা রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা হচ্ছে কিনা, তা তদারকি ও এ মহৎ কাজে সংশ্লিষ্ট মহলকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিবেন। রোপিত বৃক্ষের চারা রক্ষণাবেক্ষণে বা পরিচর্যায় কোন প্রকার গাফিলতি বা আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হলে অথবা অযতœ অবহেলায় গাছের চারা নষ্ট হলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখতে হবে-তাহলেই বনাঞ্চল সৃষ্টিতে সফলতা আসবে। ৫). দেশে কর্মরত সকল এনজিওকে (বেসরকারী সংস্থা) প্রতি বছর তাদের কর্ম এলাকায় যে কোন স্থানে ২-৫ কিলোমিটার রাস্তায় বাধ্যতামূলক বৃক্ষ চারা রোপন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। রোপিত চারা পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ এর দায়িত্বও তাদের উপরই ন্যস্ত থাকতে হবে। ৬). অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে সামাজিক বনায়ন কর্মসুচীকে জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে ক্ষুদ্রাকারে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। ৭). আগামী তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত জরুরী প্রয়োজন ব্যতীত স্থানভেদে গাছ ও বাঁশ কাটা বন্ধ রাখতে হবে। অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় ও বিলাস দ্রব্যাদির মত প্রতিবেশী দেশসমূহ হতে প্রয়োজনীয় কাঠ আমদানী করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমরা জানি, মালয়েশিয়া ও জাপানের মতো উন্নত দেশও যেখানে তাদের মোট জমির বেশীরভাগই বনে আচ্ছাদিত তারাও তাদের বনাঞ্চল ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করে বিদেশ থেকে কাঠ আমদানী করে থাকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও প্রচুর কাঠ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানী করে থাকে অথচ তাদের দেশে বনভূমির অভাব নেই। সে দেশে বনাঞ্চলকে সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে। ৮). স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যাকে পাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। ছুটির দিন শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা বৃক্ষরোপন, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষনে উদ্বুদ্ধকরণ কাজে সহায়তা করতে পারেন। মাঝে মধ্যে অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাঠ পর্যায়ে এমনকি হাট-বাজার সমূহে সেমিনার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে-সবাইকে বুঝাতে হবে বৃক্ষ নিধন এবং বনভূমি উজাড়ের পরিনাম কত ভয়াবহ হতে পারে। ৯). মসজিদের ইমাম সাহেবগণ প্রতি শুক্রবার জু’মার নামাজের সময় এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে গাছপালা বা বনভূমির প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করে কথা বলতে পারেন যা অত্যন্ত ফলপ্রসু পদক্ষেপ হবে, কারণ আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ এখনো ইমামগণকে শ্রদ্ধার সাথে দেখে, সম্মান করে এবং মনোযোগ সহকারে তাদের কথা শুনে। এ ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনও বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। অবশ্য এ জন্য ইমাম প্রশিক্ষণকেন্দ্রে বিশেষ প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ১০). ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার এবং অন্যান্য সকল সার্ভিস ক্লাব ও সমাজ উন্নয়নমূলক সংগঠনকে বৃক্ষ রোপন, রক্ষণাবেক্ষন ও পরিচর্যায় সক্রিয় করে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। ১১). দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোতে বিশেষ করে পত্র-পত্রিকা, বেতার-টেলিভিশনে বৃক্ষরোপন, রক্ষণাবেক্ষন, পরিচর্যা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার সপক্ষে জোর প্রচারনা চালাতে হবে এবং বৃক্ষ নিধনকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ১২). সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধনকৃত সকল ক্লাব ও সংগঠনকে বাধ্যতামূলকভাবে বৃক্ষরোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত করতে হবে। এসব ক্লাবকে নিবন্ধন ও অনুদান দেয়ার সময় বৃক্ষ রোপনের শর্ত আরোপ করা যায়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাভূক্ত ক্লাব, সমিতি, প্রতিষ্ঠান সমূহ, মহল্লায় মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায়, বিপথগামী তরুণ ও যুবকদের সংগঠিত করে বৃক্ষরোপণ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে হবে। জনস্বার্থে তরুণদের এ কাজে স¤পৃক্ত করা গেলে সমাজের বহু সমস্যার সমাধানও হবে। এক্ষেত্রে জবাব দিহিতার ব্যবস্থা রাখতে হবে। শিক্ষিত বেকার যুবকদের নার্সারী ব্যবসা এবং বৃক্ষরোপণের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে হবে। ১৩). প্রতি জেলা, বিভাগীয় শহর এবং থানা পর্যায়ে মওসুমের শুরুতে বৃক্ষমেলার আয়োজন করতে হবে এবং মেলা হতে সাধারণ মানুষ যাতে স^ল্পমূল্যে বৃক্ষচারা সংগ্রহ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ১৪). পৌরসভা, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, ইউনিয়ন পরিষদ, আয়কর বিভাগ প্রভৃতি সংস্থা জনগণ হতে রাজস^ সংগ্রহ করে। এ ক্ষেত্রে একটি নিয়মনীতি প্রণয়ন করা যেতে পারে। যেমন একটি বাড়ীতে কটি গাছ আছে- তা রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে কি না? তার প্রজাতি ও সংখ্যা অনুপাতে কর রিবেট দেয়া যেতে পারে। এতে করে জনগণ স^তঃস্ফুর্তভাবে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় উৎসাহিত হবেন। পরোক্ষভাবে দেশ ও জাতি লাভবান হবে। ১৫). দেশের সকল প্রান্ত বিশেষ করে সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা, খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর, শেরপুর,ময়মনসিংহসহ সকল জেলা হতে অবৈধ করাতকল উচ্ছেদ করতে হবে। নতুন করাতকল লাইসেন্স প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ এবং ক্ষেত্র বিশেষে করাতকল লাইসেন্স প্রদান নিষিদ্ধ করতে হবে। জরুরী ভিত্তিতে ২০১২ সালের করাতকল বিধিমালা সংশোধন করতে হবে। ১৬). নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাড়ীর প্ল্যান পাশ করার সময় প্রতি বাড়ীতে জায়গার অনুপাতে বিভিন্ন ফলজ ও ঔষধি গাছ রোপন করার ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারেন। এতে লোকজন উৎসাহী হবেন। ১৭). জাতীয়ভাবে ছাড়াও বিভাগীয় পর্যায়ে বৃক্ষ রোপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যায় ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান অধিকারীকে পুরস্কৃত করতে পারলে লোকজন আরো উৎসাহী ও অনুপ্রাণীত হবেন। ১৮). ‘একটি গাছ কাটার আগে তিনটি গাছ রোপন করি’, তার মধ্যে ১টি ফলজ, ১টি ঔষধি ও ১টি বনজ। এ শ্লোগানে সমাজের সকল স্তরের মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ১৮). দেশের বন বিভাগে বিশেষ করে সিলেট বিভাগে লোকবলের প্রচুর অভাব রয়েছে। কাজের গতি সম্প্রসারণ, নার্সারী সৃষ্টি এবং বন সংরক্ষণে আরও লোকবলের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিনীত অনুরোধ থাকল।
উপরে বর্ণিত সুপারিশমালা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সততা ও আন্তরিকতার সাথে বাস্তবায়িত করতে পারলে বনাঞ্চল সৃষ্টি করে দেশ ও জাতিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। পরিবেশ থাকবে সুস্থ, সুন্দর, সবল। প্রাণীকূলের বসবাস উপযোগী বনাঞ্চল সৃষ্টির প্রয়াসে এবং পরিবেশের উন্নয়নে সকলকে অবশ্যই আন্তরিক ও উদ্যোগী হতে হবে, তাহলে সাফল্য আসবেই।