শীতের সকাল। বুড়িগঙ্গা নদীর এই দিকটায় তেমন ভিড় নেই। নদীটাও বেশ শান্ত। ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় মানুষজন এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে। ওপার থেকে এপারে আসছে। সকালের সোনালি মিষ্টি রোদ নদীর পানিতে পড়ে আকাশ আর পানির মধ্যে এক মিতালিবন্ধন সৃষ্টি করেছে। এভাবে দাঁড়িয়ে নাবিল ভাবছে, একটা ছোট্ট নৌকায় করে ওপারে গেলে কেমন হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। সে একটা নৌকায় উঠে বসলো। শান্ত নদীর পানি নৌকার মাঝির বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ছোট ছোট ঢেউ তুলছে। নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে ওপারে। দূরে লঞ্চ আর বড় বড় ইঞ্জিন নৌকার হুইসেল বাজছে। নাবিল ভাবে এই বুুড়িগঙ্গা নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল নগরী ঢাকা। কিন্তু ঢাকাবাসী আজ এই বুড়িগঙ্গাকে গিলে খাচ্ছে। নদী ভরাট করে গড়ে তুলছে বড় বড় অট্টালিকা। নদীর তীরের কলকারখানার ময়লা-বর্জ্য দূষণ ছড়াচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। যাদের দেখার কথা তারাই তো রাক্ষসের মতো নদীটাকে গিলে খাওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত। নদীর পানির মিষ্টি শব্দটা এখন আর নেই। দূষণের তা-বে মাঝে মাঝে নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে উৎকট পচা গন্ধ।
: ‘ভাই নামেন।’ মাঝির ডাকে নাবিল চোখ ফিরিয়ে দেখে নৌকা তীরে ভিড়েছে। সে নদীর তীর ধরে একা একা হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। চোখের সামনে একটি প্রাচীন ভবনের খ-াংশ। আস্তর খসে বেরিয়ে পড়েছে পুরনো দিনের ইট। অন্ধকার তিনটি প্রকোষ্ঠ। নাবিল ভাবছেÑ এই নদীর তীরে এই ভাঙা প্রাসাদটি কার? সে আস্তে আস্তে সামনে এগোয়। দেখে প্রাসাদের ভেতর থেকে ধোঁয়া আসছে। আরো এগোয়। প্রাসাদের সামনে এক বয়স্ক মহিলা রান্না করছেন। চুলা থেকে ধোঁয়া আসছে। সে আরো এগিয়ে যায়। মহিলাকে ডাকে: ‘চাচি। এটা কি আপনাদের বাড়ি?’ তিনি প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘বাবা আপনি কারা? আমাদের বাড়ি?’
নাবিল আবার জানতে চায় : ‘চাচি এই রাজপ্রাসাদ এইগুলো এমন ভাঙা কেন?’ তিনি উত্তর দেন: ‘সে অনেক কথা বাবা, বলা যাবে না।’ নাবিল বাড়ির সামনে কোন নামফলক আছে কি না, তা খোঁজাখুঁজি করে। না সে তেমন কিছু দেখতে পায় না।
: চাচি, আমি কি ভেতরে আসতে পারি।
: আসেন
নাাবিল বাড়ির ভেতরে যায়। তিনটি পরিবার বাড়িতে বাস করে। সে সরু সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠে। সিঁড়ির কোঠর থেকে একটি পাখি উড়ে গিয়ে শজনে গাছের ডালে বসে। নাবিল খুব ভালো করে লক্ষ করে ঝোপঝাড়ে ঘেরা বাড়িটির আঙিনায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি নারিকেল গাছ, একটি বড় নিমগাছ। শজনে গাছটি তার নরম শাখা আর পাতা ঝুলিয়ে আছে। ডালে কয়েকটি ছোট পাখি বসে আছে। দেখে মনে হয় পাখিগুলোর সাথে তার দারুণ মিতালি। এই ভাঙা প্রাসাদের চারপাশে অনেক বড় বড় অট্টালিকা। তাহলে এই প্রাচীন বাড়িটি আসলে কারÑ নাবিলের মনে বার বার এই প্রশ্ন উঁঁকি দিচ্ছে। আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে।
বাড়ি থেকে বের হয়। সামনে একটি মুদিদোকান। দোকানের রেডিওতে গান বাজছে;
‘ একূল ভাঙে ওকূল গড়ে
এই তো নদীর খেলা (রে ভাই)
এই তো বিধির খেলা।
সকাল বেলার আমির রে ভাই
ফকির সন্ধ্যাবেলা।
সেই নদীর ধারে কোন ভরসায়
(ওরে বেভুল) বাঁধলি বাসা সুখের আশায়
যখন ধরল ভাঙন পেলিনে তুই
পারে যাবার ভেলা।
এই দেহ ভেঙে হয় রে মাটি
মাটিতে হয় দেহ
যে কুমোর গড়ে সেই দেহ
তার খোঁজ নিল না কেহ।
রাতে রাজা সাজে নট-মহলে
দিনে ভিক্ষা মেগে পথে চলে
শেষে শ্মশান-ঘাটে গিয়ে দেখে
সবই মাটির ঢেলা
এই তো বিধির খেলা রে ভাই
ভব-নদীর খেলা॥’
গানের আবহে নাবিল হারিয়ে যায়। গান শেষে দোকানির কাছে জানতে চায় : ‘চাচা, এই বাড়িটি কার?’
: কোন বাড়ি?
: এই যে ভাঙা প্রাসাদটি কার?
: আপনি গবেষক?
: না। ছাত্র। ঢাকা কলেজে পড়ি। এদিকটায় বেড়াতে এসেছি।
: এটা হাবেলি প্রাসাদ।
: কি বললেন, বা হাউলি প্রাসাদ?
: কেউ বলে হাবেলি, কেউ হাউলি আবার কেউ কেউ জিঞ্জিরা প্রাসাদ, ঘসেটি বেগমের কয়েদখানাও কয়।
: ঘসেটি বেগম নামটি শোনার সাথে সাথে নাবিল চমকে ওঠে!
নাবিল ভাবে তাহলে তো এটি একটি ঐতিহাসিক বাড়ি। এই বাড়ির সাথে মিশে আছে বাংলাদেশের অনেক অজানা ইতিহাস। আবার সেই বাড়িতে যায়। তার মোবাইল ফোনে ঝটপট কয়েকটি ছবি তুলে নেয়।
২.
নাবিলের রিডিং রুম। পড়ার টেবিলের পাশে কম্পিউটার টেবিল বরাবর ডানে বুকসেলফ। বামপাশে ছোটখাটো। দেয়ালঘেঁষে একটি ড্রেসিং টেবিলও আছে। সকালে বুড়িগঙ্গার ওপারের জিঞ্জিরা প্রাসাদ থেকে আসার পর কিছুতেই পড়াতে মন বসাতে পারছে না নাবিল। তার মনপবনের ঘোড়াটা সব সময় চলে যাচ্ছে প্রাসাদে। তার মনটা আবার আনচান করছে টাইমমেশিনের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সময়ের সীমানা পাড়ি দিতে। সে চাইলেই কি আর সেই স্বপ্নের ঘোড়া আসবে। এমন সব সাত-পাঁচ ভাবনায় তার মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। মা কয়েকবার ডেকে গেছেন খাবার জন্য। কিন্তু কি করে তাকে বোঝাবে এখন তার কোনো ক্ষুধা নেই। কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
: ‘আসসালামু আলাইকুম। প্লিজ ওপেন দ্য ডোর…’ কলিংবেলটার রোবটিক মানবিক কণ্ঠস্বর শুনে নাবিল বুঝলো তার বাবা এসেছেন। তার বাবা একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা। অফিস শেষ করে ফিরতে তার প্রায়ই রাত ১০-১১টা বাজে। এবার আর না খেয়ে থাকার উপায় নেই। তাই সে দৌড়ে দরজার কাছে যায়। দরজা খুলে দেয়। তার বাবা ড্রেস পাল্টে ডাইনিং টেবিলে বসেন। নাবিলও বসে তার পাশে। চুপচাপ দু’জন খাওয়া শেষ করে। নাবিল আবার ওর পড়ার টেবিলে বসে। না, পড়ায় মন বসছে না। বইটা খোলা রেখেই কম্পিউটার অন করে। ইন্টারনেট সংযোগটা ঠিক আছে কি না, পরীক্ষা করে দেখে। তারপর সকালবেলা মোবাইলে তোলা ছবিগুলো দিয়ে গুগলে সার্চ দেয়।
ফলাফল পেতে খুবটা একটা বেগ পেতে হয় না। গুগল তথ্যভা-ার থেকে সে জানতে পারে, ‘এটি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। চার শ’ বছর আগে নির্মিত জিঞ্জিরা প্রাসাদের একটি ভঙ্গুর অংশ। বাংলার মোগল সুবাদার দ্বিতীয় ইবরাহিম খান (১৬৮৯-১৬৯৭) প্রাসাদটি বানিয়েছিলেন। স্থানীয় লোকজনের ভাষায় এলাকাটি ‘হাউলি’ নামে পরিচিত। হাউলি শব্দটি ফারসি হাভেলি শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ আবাসিক এলাকা। আর জিঞ্জিরা শব্দটি আরবি জাজিরা (উপদ্বীপ) শব্দের বিকৃত রূপ। স্থানটি নদী ও পরিখা দিয়ে পরিবেষ্টিত হওয়ায় এ রকম নামকরণ বলে মত ঐতিহাসিকদের।
এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ঢাকা কোষ বইয়ের তথ্যানুসারে, সুবাদার ইবরাহিম খান ঢাকার বাইরে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ তীরে হাউলি গ্রামে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বাগান, হাম্মামখানা (স্নানঘর) সংবলিত প্রাসাদ তৈরি করেন। এখানে আসার জন্য বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করেন। এই বইয়ের তথ্য অনুসারে, ১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলী খান বাংলার দেওয়ানি মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নিলে জিঞ্জিরা প্রাসাদের অবনতি শুরু হয়। বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, জিঞ্জিরা প্রাসাদে ছিল মূল প্রাসাদ ভবন, আয়তাকার সুবিস্তৃত দ্বিতল হাম্মাম, দক্ষিণের সদরে প্রহরীকক্ষসহ দ্বিতল প্রবেশ ফটক এবং দুটি অষ্টকোণী পার্শ্ব বুরুজ। পলেস্তারা দেয়ালঘেরা কক্ষগুলো ছিল আয়তাকার এবং ওপরে কুঁড়েঘর আকৃতির চৌচালা খিলানাকার ছাদ। অনেক বেদনাবিধুর ঘটনার নীরব সাক্ষী এই জিঞ্জিরা প্রাসাদ। ইতিহাসের বইপত্রে পাওয়া যায়, নবাব সরফরাজ খানের (১৭৩৯-১৭৪০) পতনের পর তার মাতা, স্ত্রী, বোন, পুত্র, কন্যাসহ হারেমের কিছু নারীকে এখানে বন্দী করা হয়। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস যে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর আলিবর্দী খানের প্রধান রানি শরীফুন্নেসা, সিরাজের মা আমেনা বেগম, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অন্যতম নেপথ্য কারিগর খালা ঘসেটি বেগম, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগম ও কন্যা কুদসিয়া বেগম ওরফে উম্মে জোহরাকে জিঞ্জিরা প্রাসাদে এনে কড়া পাহারায় রাখা হয়। জনশ্রুতি আছে, নবাব মীর জাফর আলী খানের পুত্র মীর সাদেক আলী খান ওরফে মীরনের নির্দেশে জমাদার বকর খান মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়ার অজুহাতে ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে প্রাসাদ থেকে নৌকায় তুলে ধলেশ্বরী নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করে।’
নাবিল কম্পিউটারের স্ক্রিনে ডুবে আছে। তার কোনো দিকে খেয়াল নেই। অনেকক্ষণ ধরে কে যেন দরজায় নক করছে। সে দিকে সে খেয়ালই করেনি। দরজা খুলে নাবিল অবাক। দরজার সামনে দাঁড়ানো ঘোড়া। নাবিল তো অবাক এই রাতদুপুরে চার তলার ওপরে ..
: ‘কি ব্যাপার এত অবাক হচ্ছো যে? কথা দিয়েছিলাম, যখন ডাকবে এসোÑ ঠিক আসবো।’ নাবিল ঠিক মনে করতে পারছে না। সে বার বার মাথা চুলকাচ্ছে। বিষয়টি ঘোড়ার নজর এড়ায় না।
ঘোড়াটি বলে : ‘ঐ যে জাদুঘরের সেই টাইমমেশিন ঘোড়া, যাকে নিয়ে তুমি ইতঃপূর্বে ভ্রমণে বের হয়েছিলে। মনে পড়ছে না?’ এবার নাবিলের মনে পড়ে যায়।
: হ্যাঁ মনে পড়েছে। তুমি সেই মনপবনের ঘোড়া। তোমার ওপর সওয়ার হলে এক সাথে সময় ও স্থান দু’টিই পাড়ি দেয়া যায়, কারণ তুমি টাইমমেশিন ঘোড়া। তুমি এসে বেশ করেছো। তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন।
: জানি তুমি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলে ভ্রমণ করতে চাও, ঠিক আছে চলো।
৩.
নাবিল ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে অবাক হয়ে যায়। সে এ কী দেখছে। প্রচ- শীত আর দারিদ্র্যপীড়িত এ কোন দেশ। নাবিল ঘোড়ার কাছে প্রশ্ন করে : ‘তুমি এ আমায় কোথায় নিয়ে এলে।’
ঘোড়া উত্তর দেয়: ‘এই হলো পনেরো শতকের ইউরোপ। ব্রিটেনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর লন্ডনও তখন মুর্শিদাবাদের তুলনায় একটি বড় গ্রাম।’
: কেন কেন?
: কারণ শিল্প বিপ্লবের তখনও শুরু হয়নি। কৃষিকাজ, মাছ ধরাই এই সময়ের ইউরোপবাসীর বলতে গেলে একমাত্র বৈধ পেশা।
: বৈধ মানে?
: বৈধ মানে, বৈধ।
: অবৈধ পেশাও ছিল নাকি?
: ছিল না মানে, তারা ডাকাতি, দস্যুপনা, লুটপাট চালাতো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও।
: বল কি, সুসভ্য এই জাতি?
: হ্যাঁ, সুসভ্যরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে নিজের সমুদ্রসীমানায় লুটপাটও করতো। সীমানার বাইরে গিয়ে সুযোগ পেলে গোটা দেশটাকেই লুট করতোÑ এ ইতিহাস তো তোমার অজানা নয়।
: মানে?
: কেন, তোমাদের দেশটা যে ওরা দখল করেছিল তা ভুলে গেছো।
: না, সেই ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে..
: ঠিক ঠিক মনে আছে তোমার।
নাবিল ভাবে প্রচ- শীত থেকে বাঁচতে ইট পাথরে বানানো কুটিরগুলোতে কয়লার আগুন জ্বেলে বাস করতো ইংল্যান্ডের মানুষ। সে সময় কাজের বড় অভাব ছিল ওদের দেশে। জীবিকার কারণে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে রানির সনদ নিয়ে পাড়ি জমাতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। সেই সময়ের ধনী ও সমৃদ্ধ দেশগুলোর দিকে ছিল তাদের নজর। ভারতবর্ষ তখন ছিল পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ও ধনী দেশ। ভারতের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল সমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে সেরা। ইউরোপবাসী ভারতবর্ষে আসার পথ না চিনলেও তাদের কাছে এই সমৃদ্ধ দেশটির খবর অজানা ছিল না। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনেই তারা নতুনের সন্ধানে ব্যস্ত থাকতো। শত অভাব-অনটন আর দারিদ্র্যের মধ্যেও তারা লেখাপড়া, গবেষণা ও কাজের সন্ধানে সাত-সাগর তেরো নদী পাড়ি দিতে ভয় পেত না। হয়তো এই দরিদ্রতাই তাদেরকে এই সাহস জুগিয়েছে। সুখের সোনার হরিণ ধরতে জীবনবাজি রাখার শক্তি দিয়েছে। তাই তো ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে সাগরে জাহাজ ভাসিয়ে কলম্বাস চলে গেছেন আমেরিকায়। সফল হয়েছেন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দ্য গামা।
: ‘কী ভাস্কো দ্য গামার কিভাবে ভারতবর্ষে এসেছিলে তোমার মনে আছে।’ ঘোড়া প্রশ্ন করেÑ
: হ্যাঁ, অনেক আগে শুনেছিলাম আসাদ মিরণ মামার কাছে ‘ভাস্কো দ্য গামার ‘দখল গল্প’
: বল দেখি কেমন মনে আছে?
: তবে শোন, ভারতের এক সময়ের সমৃদ্ধশালী রাজ্য কালিকট। বাণিজ্যিক বন্দর বা ঘাট হিসেবে রাজ্যটির সমৃদ্ধির সুনাম পৃথিবীর নানা দেশে বিস্তৃত ছিল। বন্দরটির ওপর চোখ পড়লো নৌশক্তিতে বলীয়ান দেশ পর্তুগালের। ১৪৮৭ সালে রাজা দ্বিতীয় জন গুপ্তচরের মাধ্যমে বন্দরটি সম্পর্কে খোঁজ নেন। কয়েক বছর পর ১৪৯৭ সালে পর্তুগিজরা ভারতর্ষের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য জাহাজ সাজিয়ে তৈরি হয়। এই বণিক দলের অধিনায়কের নাম ছিল ‘ভাস্কো দ্য গামা’। নামটি তখন অনেকের কাছেই পরিচিত ছিল। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে তিনিই প্রথম লিসবন থেকে উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে আফ্রিকা উপকূলে আসেন। তারপর মোজাম্বিক ও মোম্বাছা হয়ে উত্তরের দিকে যাত্রা করে মালিন্দী এসে পৌঁছান। সে সময় ভাস্কো দ্য গামা সেখানে একজন নৌ-পরিচালকের খোঁজ পান। যার সমুদ্র, জ্যামিতিক ও ভৌগোলিক জ্ঞানে তিনি বিস্মিত হয়ে যান। আর ইনি হলেন আরবের বিখ্যাত সমুদ্রবিজ্ঞানী ও নাবিক ইবনে মজিদ। এই সেই ব্যক্তি যিনি ভাস্কো দ্য গামাকে পথ দেখিয়ে, নির্দেশনা দিয়ে ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন। ইতিহাসের পাতায় ভাস্কো দ্য গামাকে ভারতে আসার জলপথের নায়ক বলা হয়। ভাস্কো দ্য গামা ১৪৯৮ সালের ২০ মে ভারতের দক্ষিণ উপকূল কালিকটের কাছে এসে নামেন। এটাই তার ভারতবর্ষে প্রথম পদার্পণ। ভারতবর্ষের মাটিতে ভাস্কো দ্য গামার হাত ধরে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির প্রথম বীজটি রোপিত হয়।
পর্তুগিজ জাহাজগুলো ছিল উন্নত ধরনের। জাহাজের ওপর কামান সজ্জিত ছিল। বন্দরের লোকজন তেমনটি আগে কখনো দেখেনি। তারা অবাক হলো ‘জিনিস’টি কী? তবে সেখানে বসবাসরত আরব বণিকরা কিন্তু কামানের সাথে পরিচিত ছিল। কারণ আরব বণিকরা সেসময় দেশ-বিদেশ সফর করে বেড়াতো। তারা স্থানীয়দের এর বৃত্তান্ত বুঝিয়ে বলেন। বিষয়টি কালিকটবাসীকে ভাবিয়ে তোলে। পর্তুগিজদের আসল উদ্দেশ্য কী?
১৪৯৭ সালের ৮ জুলাই ভাস্কো দ্য গামা ৪টি জাহাজ নিয়ে ভারতবর্ষের উদ্দেশে যাত্রা করেন। দু’টি জাহাজ কামান দ্বারা সজ্জিত ছিল। কেপ অব গুড হোপ ছাড়িয়ে তারা ভারত মহাসাগরে এসে পৌঁছালেন। তারপর মোজাম্বিক যেতে বেগ পেতে হলো না। কিন্তু তারপরই শুরু হলো কঠিন এক সমুদ্রযাত্রা। কোনোরকম তখন মিলিন্দীতে পৌঁছানোর পর সেই বিখ্যাত নাবিক মজিদ ভাস্কো দ্য গামাকে ভারতবর্ষের কালিকট রাজ্যে নিয়ে যান। সমস্ত যাত্রাপথে ভাস্কো দ্য গামার মোট সময় লাগে ১০ মাস ১২ দিন। তিনি কালিকটের রাজা জামোরিনের কাছে কালিকট বন্দরের সাথে বাণিজ্য করার অনুমতি চান। শান্তিকামী জামোরিন কামান সজ্জিত জাহাজ দেখে এমনিতেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি অনুমতি দেন। কিন্তু তাতে ভাস্কো দ্য গামা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি একটি অন্যায় দাবি করে বসেন। তা হলো, বন্দরের প্রচলিত শুল্কের দায় থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। ভাস্কো দ্য গামা আরো কিছু বিষয় নিয়েও সেই যাত্রায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। এ বন্দরে আরব বণিকরা পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নেয়, এমনকি রাজ্যসভার সাথেও তাদের বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। মুসলিমদের এই প্রভাব ভাস্কো দ্য গামা মোটেও ভালো চোখে দেখলেন না। আরেকটি বিষয় নিয়েও তার ভুল ভাঙলো। পোপ ও পর্তুগিজদের ধারণা ছিলÑ ভারতবর্ষের মানুষ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত, কিন্তু এবার দেখে তাদের সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তার প্রাথমিক সফরের সমস্ত বৃত্তান্ত দেশে ফিরে রাজা ডোম ম্যানুয়েলকে জানালেন। তারা বুঝলেন সেখানে আধিপত্য বিস্তার করতে হলে তাদের বিতাড়িত করতে হবে। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ সামনে খোলা নেই। ভাস্কো দ্য গামার প্রথম সাফল্য, লোভ আর লাভের জন্য দ্বিতীয়বারের জন্য পর্তুগিজরা ভারত যাত্রার প্রস্তুতি নিলো। এবারে প্রস্তুত করা হলো ৩৩টি জাহাজ ও ১,৫০০ জন যোদ্ধা। নেতৃত্ব দিলেন পেড্রো আলভারেজ ক্যার্বোল। তাকে ম্যানুয়েল আদেশ দিয়ে পাঠালেন যে, কালিকটের রাজার কাছে একটি বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অনুমতি নিয়ে আসার জন্য। কালিকটের রাজা জামোরিন অনুমতি দেন। কিন্তু পর্তুগিজদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তারা স্থানীয় লোকদের ওপর অত্যাচার শুরু করলো। দেখতে দেখতে অবস্থার চরম অবনতি হলো। ……চলবে