কামান প্রযুুক্তির ব্যবহার মধ্যযুগে বাংলার সামরিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং চমকপ্রদ একটি ঘটনা। কামান প্রযুুক্তি বলতে মূলত এমন এক যুদ্ধকৌশলকে বোঝায়, যার সাহায্যে সিলিন্ডার আকৃতির ধাতব ফাঁপা নল সহযোগে এবং বারুদের অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে বৃহৎ গোলাকার পি-কে উত্তপ্ত করে, নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সজোরে আঘাত করা সম্ভব। বাংলা এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কামান ব্যবহারের অসংখ্য প্রমাণ থাকলেও ঠিক কবে থেকে এ অঞ্চলে কামান প্রযুুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছিল সেই সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য নেই বললেই চলে। সাধারণভাবে সবাই ধরে নিয়েছেন যে মোগল সম্রাট বাবরের হাত ধরে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের যুদ্ধে সর্বপ্রথম উপমহাদেশে কামানের ব্যবহার শুরু হয় এবং এই মোগলদের হাত ধরেই বাংলায় কামান প্রযুক্তির প্রচলন ঘটে। কিন্তু প্রচলিত এ ধারণা পুনর্বিবেচনা করার যথেষ্ট দাবি রাখে। কামান প্রযুক্তির মূল উপাদান হচ্ছে বারুদ, যা চীন দেশ থেকে ভারতবর্ষে এসেছিল। এই দুই অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে মোগলদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও অনেক আগে থেকেই বঙ্গভূমির সঙ্গে চীনের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। বিশেষত রূপা ও কড়ি আমদানির সূত্র ধরে দক্ষিণ চীনের সঙ্গে বাংলার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। গুপ্তযুগে বিভিন্ন বাণিজ্যপথে রূপা পু-্রনগরে (বর্তমান মহাস্থান) আমদানি করা হতো। তরফদারের মতে, বাংলার সুলতানদের রৌপ্য মুদ্রায় ব্যবহূত রূপার সম্ভাব্য উৎস ছিল চীনের ইউনান প্রদেশের ‘ন্যান-চাও’ এবং মিয়ানমারের ‘বডউইন’ খনি। বাংলায় মোগল আগমনের অনেক আগেই এ বাণিজ্য পথগুলোর মধ্য দিয়ে কামান প্রযুক্তির বিস্তার ঘটার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া সমসাময়িক বেশকিছু লিখিত উৎস থেকেও বাংলায় মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার আগে কামান প্রযুক্তি ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ত্রিপুরার ইতিহাস গ্রন্থ ‘রাজমালা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, ষোলো শতকের দিকে (সম্ভবত ১৫১৩-১৪ খ্রি.) ত্রিপুরার রাজা ধন্যমানিক্যের সঙ্গে সংঘটিত এক যুদ্ধে বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্ কামান ব্যবহার করেছিলেন; যার স্মৃতি বহন করছে বর্তমান ত্রিপুরার আগরতলা শহরের কামান চৌমোহনীতে সংরক্ষিত একটি কামান। কামানটি ত্রিপুরার সাধারণ মানুষের কাছে হুসেন শাহের কামান নামেই পরিচিত। পর্তুগিজ বিবরণেও সমসাময়িক বাংলায় কামান ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগিজরাই প্রথম চট্টগ্রামে আগমন করেন। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ গভর্নর ‘জন দ্য সিলভিরা’র নেতৃত্বে তারা প্রথম চট্টগ্রাম আক্রমণ করেন এবং উপকূলের কাছে থাকা ধান বোঝাই নৌকা হস্তগত করার চেষ্টা করেন। সেই সময় তাদের প্রতিহত করতে চট্টগ্রামের তৎকালীন গভর্নর স্থল থেকে অস্ত্র (কামান) নিক্ষেপ করেছিলেন। এভাবে প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়ে পর্তুগিজদের চট্টগ্রাম আক্রমণ ব্যর্থ হয়। বাংলায় কামান প্রযুক্তি ব্যবহার প্রসঙ্গে বাবরনামার বিবরণও যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। এ এস বেভেরিজ অনূদিত বাবরের আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’র উদ্ধৃতি দিয়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালী দাবি করেছেন ওই গ্রন্থে নাকি স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে, ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪-৫ মে খরিদ নামক স্থানে বাবরের সঙ্গে বাংলার সুলতান নুসরত শাহের সংঘর্ষ হয়েছিল। এই যুদ্ধ প্রসঙ্গে বাবরনামায় বাবরের উদ্ধৃতি ছিল এ রকম, ‘বাঙালিরা কামান দাগাইতে পটু, এখন আমরা ইহা পরীক্ষা করিলাম। তাহারা নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করিয়া কামান দাগায় না, বরং এলোমেলোভাবে গুলি চালায়।’
বাংলায় কামান প্রযুক্তি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে প্রাপ্ত একটি কামান বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। জাদুঘরের মূল ভবনের সামনে প্রদর্শিত এ কামান অপরাপর কামান থেকে একেবারেই ভিন্ন ধরনের। অলংকরণবিহীন এ কামানের ব্যারেলের গায়ে একটি আরবি লিপি এবং মাজল ফেস ও মাজল সোয়েলের ওপর বিক্ষিপ্তভাবে ‘শেখান্তে’ ধরনের সংক্ষিপ্ত কিছু ফারসি লিপি রয়েছে। মূল আরবি লিপির পাঠ হলো: ‘ফরমাইশ ইসলাম শাহেনশাহ আল সুলতান সনা ৯৪৫’। ফার্সি লিপিগুলো পুরোপুরি পাঠ করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত এগুলো কামানে ব্যবহূত বারুদের পরিমাণ বা নির্মাণ সম্পর্কিত। এ ধরনের লিপি বাংলা ও আসামের অনেক কামানেই দেখা গেছে। কামানের মূল আরবি লিপিতে উৎকীর্ণ ৯৪৫ হিজরি (১৫৩৮ খ্রি.) তারিখটি বাংলার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে বাংলার ইতিহাসে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দকে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ এর স্বাধীন সুলতানি শাসনের শেষ সময়কাল হিসেবে ধরা হয়। এর পরপরই বাংলা কিছুকালের জন্য আফগান শাসক শেরশাহের অধীনে চলে যায়। লিপিটিতে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো শাসকের নাম উল্লেখ না থাকলেও উৎকীর্ণ ‘আল সুলতান’ ও ৯৪৫ হিজরি সনের ব্যবহার দেখে যথেষ্ট যৌক্তিকভাবে ধারণা করা যেতে পারে কামানটি ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময় তৎকালীন শাসকের নির্দেশে নির্মিত হয়েছিল এবং এই শাসক গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এছাড়া বাহ্যিক অবয়ব ও ভৌত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও এই কামানটি পরবর্তী শাসক শেরশাহের কামানের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাংলায় প্রাপ্ত শেরশাহের কামানগুলো নির্মাণ উপকরণ, নির্মাণশৈলী, আকার, আকৃতি, ওজন ও অলংকরণের দিক থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যম-িত। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত শেরশাহের তিনটি কামান এবং বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত শেরশাহের দুটি কামানের সবগুলোর মাজলই ব্যাঘ্র মস্তকসদৃশ, যেন এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে পরাস্ত করতে শেরশাহের সাহস ও শক্তিমত্তাকে প্রতীকীভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া শেরশাহের কামানে সাধারণত ফার্সি লিপির ব্যবহার দেখা যায় এবং লিপিযুক্ত সব কামানেই কামান নির্মাতা হিসেবে সৈয়দ আহমেদ রুমীর নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। ধারণা করা যায়, শেরশাহ তার কামানের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য রুমীকে নিযুক্ত করেছিলেন। তবে তিনি কোথাকার অধিবাসী ছিলেন তা যথেষ্ট গবেষণার দাবি রাখে। গবেষক শামসুদ্দিন আহমেদের মতে, সৈয়দ আহমেদ রুমী সম্ভবত এশিয়া মাইনর বা তুর্কির অধিবাসী ছিলেন। আর বালাসুব্রমনিয়ম, সৈয়দ আহমেদ রুমীকে বাবরের অন্যতম সেনাপ্রধান ওস্তাদ আলী কুলী খানের পুত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এভাবে লিপিতাত্ত্বিক ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের সাপেক্ষে বলা যায়, শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে প্রাপ্ত কামানটি আফগান শাসক শেরশাহের নয়, বরং শেষ স্বাধীন সুলতানি শাসক গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিভিন্ন উৎসে আলাউদ্দিন হুসেন শাহসহ বিভিন্ন স্বাধীন সুলতানি শাসকদের সময়ে কামান ব্যবহারের কথা উল্লেখ থাকলেও এতদিন পর্যন্ত বস্তুগতভাবে তার প্রামাণিকতা পাওয়া যাচ্ছিল না। এক্ষেত্রে কামানটি বাংলার কামান ব্যবহারের ইতিহাসকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এছাড়া বর্তমান আসামের গৌরীপুরে মাতিয়াবাগ প্রাসাদে একটি আদি বাংলা লিপিযুক্ত কামান রয়েছে। উৎকীর্ণ লিপিটি হলো ‘শ্রী শ্রী রঘুদেব নারায়ণস্য শাকে ১৫১৪’, যা ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দের সমসাময়িক। লিপিভাষ্য অনুযায়ী ধারণা করা যায়, কামানটি কোচ শাসক রঘুদেব নারায়ণের রাজত্বকালের (১৫৮১-১৬০৩ খ্রি.)। এখানে উল্লেখ্য, আসামে প্রথম মুসলিম অনুপ্রবেশ হয়েছে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে, সেই হিসেবে ওই কামানটি মুসলিম অনুপ্রবেশের সাত বছর আগেই এ অঞ্চলে কামান প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রমাণ বহন করছে। এভাবে বিভিন্ন প্রতœতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক উৎসের ভিত্তিতে বেশ দৃঢ়ভাবেই বলা যায় বাংলা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার বহু আগেই কামান প্রযুক্তির প্রচলন হয়েছিল।
তবে মোগল শাসনামলে বাংলায় কামান প্রযুক্তির কৌশলগত ও ধাতুবিদ্যাগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় হুসেন শাহী বংশের শাসনকাল থেকে মোগলদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলায় ব্যবহূত অধিকাংশ কামানই তামা-সংকর কাঁসা বা পিতল দ্বারা তৈরি ছিল। ছাঁচে ঢালাই করে নির্মিত কাঁসা বা পিতলের তৈরি এই কামানগুলো তুলনামূলক হালকা ওজনের ও মাঝারি আকৃতির হওয়ায় নদীমাতৃক বাংলায় সহজেই নৌপথে পরিবহন করা যেত। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে প্রাপ্ত কামান, শেরশাহের কামান, ঈসা খানের কামান, আসামের ধুবড়ির রঘুদেব নারায়ণ ও পরীক্ষিত নারায়ণের কামান প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। অন্যদিকে মোগল যুগে সাধারণত লৌহ নির্মিত কামান বেশি ব্যবহূত হয়েছে। এ সময় লোহাকে উত্তপ্ত করে পেটাই করে জোড়া দিয়ে অনেক বড় বড় কামান তৈরি করা হয়েছে। মোগল যুগে প্রাপ্ত পেটাই লোহার কামানগুলো তৎকালীন সময়ের লৌহ ধাতুবিদ্যার উন্নয়নের এক চমৎকার উদাহরণ। মোগল যুগে ধাতুশিল্পীরা এতটাই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে বৃহদাকার বিভিন্ন কামান তৈরির জন্য লোহাকে উত্তপ্ত করে পিটিয়ে জোড়া দিয়ে কামানের অবয়ব তৈরি করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বর্তমান মুর্শিদাবাদে রক্ষিত মোগল কামান ‘জাহানকোষা’, ঢাকার ‘কালে খাঁ’ বা ‘কালে জমজম’, ‘বিবি মরিয়ম’ প্রভৃতি কামানের কথা উল্লেখ করা যায়। পেটাই লোহার কামানগুলো তুলনামূলকভাবে ওজনে ভারী এবং এগুলো সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের চেয়ে দুর্গ প্রতিরক্ষার কাজে বেশি ব্যবহূত হয়েছে।
এছাড়া প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, মোগল আমলে জাহাঙ্গীরনগরে স্থানীয়ভাবে সম্ভবত বেশকিছু কামান নির্মিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বর্তমান মুর্শিদাবাদে সংরক্ষিত ‘জাহানকোষা’ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পেটাই পদ্ধতিতে লৌহপি-কে জোড়া দিয়ে কামানটি তৈরি করা হলেও অসাধারণ শৈল্পিক দক্ষতায় এর বহিরাবরণ এমনভাবে মসৃণ করা হয়েছে যে তাতে পেটাইয়ের কোনো দাগ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এছাড়া লোহার কামান হওয়া সত্ত্বেও এর গায়ে বিন্দুমাত্র মরিচা পড়েনি, বরং উজ্জ্বল রক্তিম আভাযুক্ত বহিরাবরণ এর অনন্য সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছে। কামানটির গায়ে ফার্সি লিপিতে লেখা বেশকিছু পিতলের ফলক সংযুক্ত রয়েছে। যার অধিকাংশই বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত। উনিশ শতকের দিকে জনৈক মেজর জি ডি শাওয়ার্স এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রথম জাহানকোষার কামানলিপি সম্পর্কে নিবন্ধ লেখেন। পরবর্তীকালে তারাপদ সাঁতরা তার একটি প্রবন্ধে ওই ফার্সি লিপির পাঠ ব্যবহার করলেও তাতে সূত্রনির্দেশ অনুপস্থিত ছিল। জাহানকোষার গায়ে উৎকীর্ণ ফার্সি লিপি থেকে জানা যায়, কামানটি হিজরি ১০৪৭ জমাদিউস সানি সনে (অক্টোবর, ১৬৩৭ খ্রি.) সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে জাহাঙ্গীরনগরে (বর্তমানে ঢাকা) দারোগা শের মুহম্মদ ও ইন্সপেক্টর হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে জনার্দন কর্মকার কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। কামানটি একসময় ঢাকায় অবস্থিত ছিল। শাওয়ার্স এবং নিয়োগীর নিবন্ধে উনিশ শতকের দিকে বটগাছে জড়িয়ে থাকা জাহানকোষার চিত্র রয়েছে। ধারণা করা হয়, নওয়াব মুর্শিদ কুলি খানের সময় কামানটিকে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে এটি মুর্শিদাবাদে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত রয়েছে।
মোগল আমলের পেটাই লোহায় নির্মিত অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ কামান হলো ‘কালে খাঁ’ বা ‘কালে জমজম’ ও ‘বিবি মরিয়ম’। বিখ্যাত ভূগোলবিদ রেনেল তার ‘মেময়ার্স’ বা ‘স্মৃতিকথায়’ ঢাকার এই দুটো বৃহদাকার কামানের কথা উল্লেখ করেছেন। ড’য়েলির মতে, সতেরো শতকে বারবার মগ ও আরাকান দস্যুদের হামলা প্রতিহত করার জন্য কামান দুটি নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সময়ে মোগল সুবাদার মীর জুমলা কামান দুটিকে বুড়িগঙ্গার দুপাশে স্থাপন করেছিলেন। এর মধ্যে কালে খাঁ বা কালে জমজমকে রাখা হয়েছিল বুড়িগঙ্গার মাঝে মোগলানি চরে এবং বিবি মরিয়মকে বড় কাটরার সামনে সোয়ারীঘাটে। বর্তমান কালে জমজমের অস্তিত্ব আর নেই। নদীভাঙনে ধীরে ধীরে মোগলানি চরের অস্তিত্ব ক্রমশ বিলীন হতে থাকে। এরই একপর্যায়ে সম্ভবত ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চরটির সঙ্গে সঙ্গে কালে জমজমও বুড়িগঙ্গার তলদেশে হারিয়ে যায়। তবে বিবি মরিয়ম এখনো সগৌরবে টিকে আছে, যদিও এর অবস্থান একাধিকবার পরিবর্তিত হয়েছে। ১৮৩২ সালের দিকে ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াল্টার্স আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সোয়ারীঘাট থেকে তুলে এনে কামানটিকে চকবাজারে একটি বেদির ওপর স্থাপন করেন। ১৯১৭ সালে ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর নলিনীকান্ত ভট্টশালীর প্রচেষ্টায় বিবি মরিয়ম পুনরায় সদরঘাটে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৭ সালে আরো এক দফা এর অবস্থান পরিবর্তিত হয়। এ সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীদের সহায়তায় ‘ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ মরিয়মকে গুলিস্তানের কাছে ডিআইটি এভিনিউতে স্থাপন করে। সর্বশেষ আশির দশকে এটি স্থান পায় ঢাকার ওসমানী উদ্যানে।
কালে খাঁ বা কালে জমজম হারিয়ে গেছে আর বিবি মরিয়মের ওপর পুরু আলকাতরার স্তর দেয়ায় কামান দুটিতে কোনো লিপি ছিল কিনা তা জানা সম্ভব নয়। বিশাল আকৃতির এই দুটি কামানের নির্মাতা ও নির্মাণের স্থান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা বেশ কঠিন। সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর উল্লেখ করেছেন মোগল সুবাদার মীর জুমলা ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে আসাম অভিযান থেকে প্রচুর পরিমাণে বড় ও ছোট আকৃতির কামান অধিকৃত করে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে একটি বৃহদাকার কামান ছিল যাকে বিবি মরিয়মের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে হয়। বিবি মরিয়মের নির্মাতা প্রসঙ্গে মুর্শিদাবাদে রক্ষিত জাহানকোষা কামানটির কথা পুনরায় স্মরণ করা যেতে পারে। উৎকীর্ণলিপি থেকে জানা যাচ্ছে, পেটাই লোহার এ কামান জনার্দন কর্মকার কর্তৃক জাহাঙ্গীরনগরে নির্মিত হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য, আফগান দলনেতা খাজা উসমানের সময়কালে সিলেটের রাজনগর লৌহশিল্পের জন্য উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল। এ রাজনগরের একজন বিখ্যাত কারিগর ছিলেন জনার্দন কর্মকার। ফলে ধারণা করা যায় সম্ভবত ঢাকায়ই স্থানীয়ভাবে মোগল প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে কালে খাঁ জমজম ও বিবি মরিয়ম কামান দুটি নির্মিত হয়েছিল।
বাংলার কামানগুলো কেবল এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ইতিহাস এবং সামরিক কৌশলের দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এগুলো স্থানীয় কারিগরদের ধাতব প্রযুক্তি এবং অসাধারণ শিল্প দক্ষতারও এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ। দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক কামানই আর নেই, তামা ও পিতলের অত্যধিক দাম থাকার জন্যেও অনেক কামান গলিয়ে ফেলা হয়েছে। সংরক্ষণের নামে অনেক কামানের ওপর খুব মোটা রঙের প্রলেপ দিয়ে তার লিপি লোকচক্ষুর আড়ালে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আর তাই এখনো যে কামানগুলো টিকে আছে, সেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ এবং বিস্তারিত গবেষণা এখন সময়ের দাবি। (সূত্র: সিল্করোড,বণিকবার্তা)
তথ্যসূত্র: এম আর তরফদার, ট্রেড, টেকনোলজি অ্যান্ড সোসাইটি ইন মেডিয়েভ্যাল বেঙ্গল, ঢাকা: ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল আর্ট, ১৯৯৫, পৃ. ৩১-৫৬
জে. জে. এ. ক্যামপোস, হিস্ট্রি অব দ্য পর্তুগিজ ইন বেঙ্গল, ফার্স্ট এডিশন, পাটনা: জোনাকি প্রকাশন, ১৯৭৯, পৃ. ২৯
নলিনীকান্ত ভট্টশালী, ‘নূতন বাদশাহী আমলের কামান’, প্রবাসী, পৌষ ১৩২৮, ১৯২২, পৃ. ৩১৩-৩১৮
প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়, সাবিকুন নাহার ও কবিতা দেবী, ‘ক্যাননস অব গৌরীপুর, আসাম: আর্কিওমেটালার্জিক্যাল স্টাডিজ’, প্রতœতত্ত্ব, ভলিউম-২১. ঢাকা: প্রতœতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৫, পৃ. ৫৩-৫৯
প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় ও সাবিকুন নাহার, প্রতœধাতুবিদ্যার আলোকে বাংলার কামান: একটি পর্যলোচনা, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর পত্রিকা, ২য় সংখ্যা, ঢাকা: বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ডিসেম্বর ২০২২।
মুনতাসীর মামুন, ‘ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামান’, ঢাকা গ্রন্থমালা-৯, ঢাকা: ঢাকা নগর জাদুঘর, ১৯৯১, পৃ ৫৮-৬৩
সাবিকুন নাহার ও প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়, আর্লিয়েস্ট ডেটেড ক্যানন অব মেডিয়াভ্যাল বেঙ্গল: আ রি-ইভ্যালুয়েশন, জার্নাল অব বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ভলিউম ৫, ঢাকা: বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ২০১৩, পৃ. ২৬
সাবিকুন নাহার, সুরজিত লাহিগী এবং প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘প্রি-মোগল ক্যাননস অব বেঙ্গল: আ রি-ইভ্যালুয়েশন’, প্রতœ সমীক্ষা, নিউ সিরিজ ৫, কলকাতা: সেন্টার ফর আর্কিওলজিক্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড ট্রেনিং, ২০১৪, পৃ. ৫৩-৭১
স্যার চার্লস ড’য়েলি, ঢাকার প্রাচীন নির্দশন (শাহ্ মুহম্মদ নাজমুল আলম অনূদিত), ঢাকা: একাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স, ১৯৯১
সৈয়দ মুহাম্মদ তাইফুর, গ্লিম্পস অব ওল্ড ঢাকা, ঢাকা, ১৯৫৬, পৃ. ১৭৮-১৭৯,সাবিকুন নাহার: সহযোগী অধ্যাপক, প্রতœতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়