শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০২:৩৮ অপরাহ্ন

গণতন্ত্র লাইনচ্যুত হলে রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে বাধ্য

জামালউদ্দিন বারী :
  • আপডেট সময় শনিবার, ২০ মে, ২০২৩

রাষ্ট্র হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা কিছু প্রতিষ্ঠানের সুসংবদ্ধ কর্মতৎপরতা, যা মূলত জনগণের সেবা এবং অভিপ্রায়কে প্রতিফলিত করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই ধারণা আরো স্বচ্ছভাবে প্রতিফলিত হওয়ার কথা। কিন্তু আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় জনগণের স্বাভাবিক অভিপ্রায়ের চিরায়ত অভীষ্ঠ থেকে রাষ্ট্রের লক্ষ্যচ্যুতি ঘটে চলেছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। আর এই লক্ষ্যচ্যুতির মধ্য দিয়ে দেশে দেশে মানুষে মানুষে বৈষম্য এবং রাজনৈতিক-সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে এক সময়ের ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত একেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র এখন ব্যর্থ রাষ্ট্রের পরিনতি গ্রহণ করতে চলেছে। আঞ্চলিক বৈভিন্নতার নিরিখে ঔপনিবেশোত্তর বিশ্বে গণতান্ত্রিক মননশীলতা ও আধুনিক মানুষের চিন্তার জগত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধানের কারণে রাষ্ট্রের কাছে মানুষের সাধারণ প্রত্যাশা ও ব্যর্থতার দূরত্ব সমরৈখিক নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জিডিপি’র মানদ-ে ইউরোপের শিল্পোন্নত হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামকে যেমন ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা দেয়া হয়, একভাবে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং সামাজিক শৃঙ্খলার বিচারে বিশ্বের এক নম্বর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও এখন ব্যর্থ রাষ্ট্রের অভিযোগ বহণ করতে হচ্ছে। মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদাররা জনগণকে যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন সেই প্রত্যাশিত ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে। ইভিল অস্বচ্ছ পুঁজিবাদের গ্যাঁড়াকলে আটকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রস্ত রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে। নিজেদের দেশের নাগরিকদের সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা-সংকট ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো উপেক্ষা করে মহাদেশ-মহাসমুদ্র পেরিয়ে দেশে দেশে যুদ্ধ ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার পেছনে বছরে শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করছে দেশটি। জিডিপি’র পরিমানের দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের আকার বিশ্বে এক নম্বর হলেও শতকরা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগে আরো অন্তত ১০টি দেশ রয়েছে, যে সব দেশের সরকারের ঋণের পরিমান জিডিপির শতকরা ২২১ শতাংশ থেকে ১২৫ শতাংশের মধ্যে। গত বছরের হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ জিডিপির ১২৮ শতাংশ প্রায়। ডলারের অংকে এর পরিমান ২৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের আকার চীন, জাপান, জার্মানীর সম্মিলিত মোট অর্থনীতির সমান। এটি ২০২২ সালের প্রথম দিকের হিসাব। গত একবছর এ অংক আরো কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বেড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যয়ভার মার্কিনীদের ঋণের আকারকে আরো স্ফীত করে চলেছে। এই যুদ্ধ রাশিয়া-ইউরোপসহ বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলের অর্থনীতিতে নেতিবাচক সৃষ্টি করে চলেছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও বড় অর্থনীতির দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ঋণগ্রস্ত।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সদ্যোজাত শিশুসহ প্রত্যেক নাগরিককে প্রায় ৮০ হাজার ডলারের ঋণের দায় বহন করতে হচ্ছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে পরাশক্তি ধনী দেশগুলো টিকে থাকলেও ঋণগ্রস্ত গরিব রাষ্ট্রগুলো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভেনিযুয়েলা, গ্রীস, শ্রীলঙ্কা, সুদান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বহুগুণ বেশি রাষ্ট্রীয় ঋণের বোঝা নিয়েও জাপান, বেলজিয়াম কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা তেমন নড়বড়ে নয়। মার্কিন ডলারের আধিপত্য এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বশংবদ রাষ্ট্রগুলো ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা নিয়েও দিব্যি প্রভাবক শক্তি হিসেবে টিকে থাকতে পারছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইতালি, সিঙ্গাপুর কিংবা রাশিয়ার চেয়ে অনেক কম রাষ্ট্রীয় ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কায় বড় ধরণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধের পেছনেও হয়তো সে দেশের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং জাতিগত বিভেদই মূলত দায়ী। ন্যুনতম অর্থনৈতিক সংকট দেশের অভ্যন্তরে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভেদ-বৈরীতা- অসহিষ্ণুতার মাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে রাষ্ট্রকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। পারমানবিক সক্ষমতা এবং চীনের মত অর্থনৈতিক পরাশক্তির সমর্থন না থাকলে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এতদিনে হয়তো পাকিস্তানেও বড় ধরণের অস্থিতিশীলতা ও চরম বিপর্যয় দেখা দিত। সুদানে সরকারি সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহী আধা সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলার একটি জ্বলন্ত উদাহরন। রমজান মাসের শেষদিকে শুরু হওয়া দুইপক্ষের যুদ্ধে ইতিমধ্যে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সুদান থেকে তাদের কূটনীতিক ও নাগরিকদের সরিয়ে নিতে বিশেষ জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এমনিতেই দেশটি আফ্রিকার অন্যতম দরিদ্র ও ঋণগ্রস্ত দেশ। এই গৃহযুদ্ধের কারণে রাজনৈতিক বিভাজন ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেশটিকে আরো অনেক পিছিয়ে দিবে। গত দশকে লিবিয়ায় খলিফা হাফতারের বিদ্রোহী গ্রুপ পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট আঞ্চলিক সরকার ও বিদ্রোহী গ্রুপগুলো সহায়তা দিয়ে বিভেদকে উস্কে দেয়ার পাশাপাশি সংঘাত দীর্ঘায়িত করেছিল। মূলত মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুর পর থেকে লিবিয়ায় সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করেছে। পশ্চিমাদের অর্থায়ণ ও নিয়ন্ত্রণে থাকা বিদ্রোহী গ্রুপগুলো দেশের স্থিতিশীলতার জন্য বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লিবিয়ার বিদ্রোহী মিলিশিয়া এবং মিশরের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সুদানের বিদ্রোহী মিলিশিয়াদের মদত দেয়ার খবর থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, এই সংঘাতের পেছনের পশ্চিমাদের এজেন্ডা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাহ্যিকভাবে শান্তির মধ্যস্থতাকারী ভ’মিকা পালন করলেও বাস্তবে তার এজেন্ডা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, রাজনৈতিক পক্ষগুলোর অসহিষ্ণুতা এবং প্রতিবেশিদের রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশে চলমান গণতন্ত্রহীনতার জন্য ভারত ও চীনের মত আঞ্চলিক শক্তির পক্ষপাতমূলক অবস্থানকে দায়ী করা যায়। বিশ্বের অন্যতম বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও নিকটতম প্রতিবেশি হিসেবে ভারত যদি বিতর্কিত ভূমিকার বদলে জাতিসংঘ ও পশ্চিমাদের সাথে সহযোগিতামূলক ভূমিকা গ্রহণ করত তাহলে বাংলাদেশে ২০১৪ সালে একতরফাভাবে ১০ম জাতীয় নির্বাচন সম্ভব হতো না। গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে বাংলাদেশের বিচ্যুতি এমন দীর্ঘায়িত হতনা। গণতান্ত্রিক অধিকার ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার কায়েমের জন্য যে দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। স্বাধীনতাত্তোর সরকার গণতন্ত্র হরণ করায় স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক শক্তি জনরোষের শিকার হয়েছিল। যে দেশে সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দলের জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল। জনগণের প্রাণের দাবি ও প্রত্যাশাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সে দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাহ্য করে রাজনৈতিক বিভেদ উস্কে দেয়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির নিলর্জ্জ হস্তক্ষেপ ছাড়া এটি কখনো সম্ভব ছিল না।
অর্থনৈতিক সামর্থ্য, সামরিক শক্তি এমনকি পারমানবিক সক্ষমতার চেয়ে নাগরিকদের ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ কোনো রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌম শক্তি হিসেবে টিকে থাকার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে জনগণকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা অত:পর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বিরোধী মত দমনে রাষ্ট্রশক্তির ব্যবহার, দমন-পীড়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠন এবং বিদেশে পাচার করে দেশের কর্মসংস্থান ও সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিকভাবে অনিরাপদ করে তোলার মধ্য দিয়ে দেশকে একটি অনিবার্য গণবিস্ফোরণের দিকে ঠেলে দেয়া হয়। অনেক সম্ভাবনাময় একটি দেশ আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা সম্পর্কে দেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলো যথেষ্ট সচেতন না হলে এ ধরণের সংকট এড়ানো অসম্ভব হতে পারে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেন বা সুদানের মত শতকরা ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশকেও একই ধরণের সংকটের মুখে ঠেলে দিয়ে কায়েমী স্বার্থ হাসিলের আধিপত্যবাদের নীল নকশা সম্পর্কে দেশের নাগরিক সমাজ ও সব রাজনৈতিক দলকে সজাগ-সচেতন থাকতে হবে। শুধুমাত্র দু’তিন মাসের নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা কিংবা একদিনের আপাত: সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মানে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক ও নিরপেক্ষ সাংবিধানিক ব্যবস্থা। নির্বাচিত সরকার, সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও প্রশাসনের সব সেক্টরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, সাধনা ও সুদীর্ঘ ত্যাগের বিনিময়ে একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে ওঠে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ও সাংবিধানিক নিরপেক্ষতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলে কোনো কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠি গণতন্ত্রের শক্তিকে লাইনচ্যুত করতে পারেনা। প্রায় আড়াইশ বছরের গণতান্ত্রিক ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২০২০ সালের নির্বাচনের পর জনগণের রায়ের বিপক্ষে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্রপন্থী বর্ণবাদী এজেন্ডা সফল হয়নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি পুলিশ ও সরকারি বাহিনীর কমিটমেন্ট এবং বিচারবিভাগের স্বাধীনতা তথা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার ভারসাম্য অটুট থাকার কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অশুভ এজেন্ডা সফল হয়নি। শত শত উগ্রবাদী সন্ত্রাসী হোয়াইট হাউজের ক্যাপিটল ভবন দখল করতে গিয়ে ভাঙ্গচুর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বিবৃত্ত করতে পুলিশ ও বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী জনতার উপর গুলি বা ম্যাসাকার চালায়নি। লাঠিচার্জ ও টিয়ারসেল ও রাবার বুলেট দিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছে মাত্র। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শত শত মামলা করে নিজের পক্ষে একটিও রায় হাসিল করতে পারেননি। দলীয় বিবেচনায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিয়োগ দেয়া বিচারকরাও বিবেক বিসর্জন দিয়ে কোনো ফরমায়েশি রায় দিতে পারেননি। এখানেই মার্কিন গণতন্ত্রের স্বার্থকতা ও বিজয়। তবে পুুঁজিতন্ত্রের গণবিরোধী কালোহাত বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থার উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সদা তৎপর রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ছাড়া অব্যাহত লুন্ঠন, দুর্নীতি, বিরোধি মত দমন, মানবাধিকার হরণ, নির্বিচার গুম-খুন, অর্থপাচার ও নির্বাচনের নামে প্রহসন সৃষ্টি করা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ও সমাজে সম্ভব নয়।
কোনো ফ্যাসিবাদী বা স্বৈরশাসক তার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে প্রথমেই জনগণের স্বাধীন ইচ্ছা ও মতামতের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করে থাকে। তারা বিশেষ প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে রাষ্ট্র সরকার এবং বিশেষ কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডাকে একাত্ম করে তোলে। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একই অভিন্ন কর্তৃত্বের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানের পরিনত করতে সচেষ্ট হয়। ফিলিস্তিনীদের জমি জবরদখল করে পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ মদত ও ষড়যন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পশ্চিমা ধারার গণতন্ত্র বিদ্যমান রয়েছে। সেই গণতন্ত্র এখন চরম হুমকির সম্মুখীন। ভারতের বিজেপি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরাইলের বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু একই ধারা ও ঘরানার বর্ণবাদী, উগ্রবাদী নতুন ধরার সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শাসনের উদগাতা। বিশ্বের তিনটি অঞ্চলে গণতন্ত্রের নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই তিনটি দেশের এই তিনজন শাসকের দ্বারা গণতন্ত্রের ভবিষ্যত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ভোটের মাধ্যমে ট্রাম্পকে বিদায় করতে পারলেও নরেন্দ্র মোদি ও নেতানিয়াহুকে বিদায় করার পথ অনেকটাই সঙ্কুচিত করে তোলা হয়েছে। ইসরাইলের জনগণ যথেষ্ট সচেতন হলেও ভারতের নি¤œবর্ণের অশিক্ষিত জনগণ হিন্দুত্ববাদের দ্বারা চরমভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছে। ইসরাইলের নেসেটে সুপ্রীম কোর্টের স্বাধীনতা খর্ব করার একটি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে চারমাস ধরে নজিরবিহিন গণআন্দোলনে রাজপথ দখলে রেখেছে সে দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ। তেল আবিবের রাস্তায় মাসের পর মাস ধরে লাখ লাখ মানুষের বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সরকারের নির্বাহী বিভাগের সাথে বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে ভারসাম্যহীন করে তোলার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলার এজেন্ডা রয়েছে। ইসরাইলী জনগণ সেই এজেন্ডার বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলনে নেমেছে। জনগণ সুপ্রীমকোর্টের ক্ষমতাকে নেসেটের হাতে ন্যাস্ত করতে রাজি নয়। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ন্যুনতম সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে সর্বোচ্চ আদালত এবং জাতীয় সংসদকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করলেও দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের নিরবতার কারণে গণতন্ত্র নির্বাসিত। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে যে দেশ স্বাধীনতা ও সংবিধানের মূল মন্ত্র ছিল গণতন্ত্র, সাম্য, সুশাসন ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হলে সে দেশের সরকার সংবিধান পরিবর্তন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের ভারসাম্য নষ্ট করে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলতে পারেনা। বাংলাদেশে আজকের গণতন্ত্রহীনতার জন্য দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল, দুর্নীতিপরায়ন আমলাতন্ত্র দায়ী। সম্ভাব্য সংকটে ঊটপাখির মত বালিতে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকা নাগরিক সমাজ, দলদাস গণমাধ্যমের দায়ও কম নয়। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে না পারলে আমাদের রাষ্ট্র রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে একটি অনিবার্য সংঘাত-বিশৃঙ্খলা ও ব্যর্থতার শিকার হবে।
bari_zamal@yahoo.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com