ফরাসি কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার অনরে দে বালজাকের জন্ম ১৭৯৯ সালে। চোখের সামনের জগৎকে নিখুঁত বর্ণনায় তুলে আনেন বালজাক। মনে হতে পারে, তিনি চরিত্রদের সামনে থেকে সরাসরি দেখছেন। বাস্তবতার প্রত্যক্ষ চিত্র আঁকার জন্য বালজাককে ইউরোপীয় সাহিত্যে যাঁরা প্রথম বাস্তববাদিতায় ব্যবহার করেন তাঁদের অন্যতম মনে করা হয়। তাঁর চরিত্রদের বিশেষ পরিচিতি হলো তাদের বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। অপ্রধান চরিত্ররাও জটিল, নৈতিক দিক থেকে রহস্যঘেরা এবং মানুষ হিসেবে পূর্ণাঙ্গ; এমনকি প্রাণহীন বস্তুও তাঁর রচনায় ব্যক্তির গুণাবলিসম্পন্ন। অনেক লেখার পটভূমি ফ্রান্স।
তাঁর লেখার প্রভাব পড়েছে অনেক বিখ্যাত লেখকের ওপর। এমিল জোলা, চার্লস ডিকেন্স, গুস্তাভ ফ্লবেয়ার, জ্যাক কেরুয়াক, হেনরি জেমস প্রমুখ তাঁর প্রভাবে আলোকিত। চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়া ও এরিক রোহমার এবং দার্শনিক ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের ওপরও পড়েছে তাঁর প্রভাব। তাঁর লেখা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র।
মা-বাবার বয়সের পার্থক্য বালজাক ও তাঁর অন্য ভাই-বোনের বাল্যকালের অভিজ্ঞতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। বিয়ের সময় তাঁর বাবার বয়স ৫০ বছর ছিল আর মায়ের ছিল ১৮ বছর। জন্মের পর থেকে প্রথম চার বছর শিশু বালজাককে নার্সের কাছে রাখা হয়। বাড়িতে ফিরিয়ে আনার পরও মা-বাবার নৈকট্য থেকে নিরাবেগ দূরত্বে রাখা হয় কয়েক ভাই-বোনকে। ছেলেবেলার এই অভিজ্ঞতা বালজাকের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
ছেলেবেলা থেকেই বালজাক ছিলেন স্বাধীন চিন্তার অধিকারী। স্কুলের পড়াশোনার প্রচলিত নিয়ম-কানুন মনের মতো ছিল না। স্কুলের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে কষ্ট হতো। স্কুলের পড়াশোনার পর আইনে নবিশি লাভের উদ্দেশে পাঠানো হলে তিনি বুঝতে পারেন, প্রাণহীন আইন পাঠ অতিমাত্রায় মামুলি এক কর্ম। নিজেকে লেখক হিসেবে পুরোপুরি নিবেদনের আগে তিনি আরো কয়েকটি পেশায় নিয়োজিত হওয়ার চেষ্টা করেন। বই প্রকাশনার কাজ করেন, ছাপাখানার কাজ করেন, ব্যবসায়ী হিসেবে, সমালোচক এবং রাজনীতিক হিসেবেও নিজের পেশা শুরুর চেষ্টা করেন; কিন্তু সবগুলোতেই ব্যর্থ হন। ‘লা কমেডি হিউমেইন’ উপন্যাসে তাঁর বাস্তব জীবনের নানা সমস্যার কথা বলা হয়েছে। ছেলেবেলার অন্যান্য ঘটনার মতো স্কুলের অভিজ্ঞতার কথা, নিজের জীবন এবং চারপাশের মানুষদের কথাও তিনি এ উপন্যাসে হাজির করেছেন। এ ছাড়া ভাদোমের ওরেটোরিয়ান গ্রামার স্কুলের স্মৃতি এবং বই পড়ার অভিজ্ঞতার কথা আছে ‘লুই লাম্বার্ত’ উপন্যাসে।
১৮১৬ সালে বালজাক ভর্তি হন সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তাঁর আধুনিক ইতিহাস, ফরাসি ও ক্ল্যাসিক সাহিত্য এবং দর্শনের ওপর যথাক্রমে ফ্রাঙ্কো গিজো, আবেল ফ্রাঙ্কো ও ভিক্টর কুজা—এ তিনজন বিখ্যাত প্রফেসর তাঁর স্বাধীন চিন্তাশক্তিকে তীক্ষতা ও গতিশীলতা দান করেন। বেশ কয়েকটি উপন্যাস লেখার পর ১৮৩২ সালে ‘লা কমেডি হিউমেইন’ লেখার ধারণা তাঁর মাথায় আসে। ১৮১৫ থেকে ১৮৪৮ সালের ফরাসি সমাজের নানা দিক উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে এগুলোতে। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম এটি। ১৮৫০ সালে তিনি মারা যান।