রংপুরের বিষমুক্ত ও অতি সুমিষ্ট আঁশহীন হাঁড়িভাঙা আম এবার নির্দিষ্ট সময়ের ১০ দিন আগেই বাজারে আসছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ২০ জুনের পরিবর্তে ১০ জুন গাছ থেকে আম পারা শুরু হবে। বুধবার (৭ জুন) দুপুরে এ সংক্রান্ত নোটিশ জারি করেছে রংপুর জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এরআগে সোমবার আম পারার সময় এগিয়ে নেয়ার জন্য রংপুরের জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন চাষিরা। তাদের দাবি ছিল ২০ জুনের পরিবর্তে ১০ জুন থেকে বাজারে হাঁড়িভাঙা আম সরবরাহের ব্যবস্থা করা। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন জানান, পদাগঞ্জ থেকে হাঁড়িভাঙা আম চাষিরা একটি স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। তাতে তারা দাবি করেছিলেন হাঁড়িভাঙা আম বাজারজাতে ২০ জুনের পরিবর্তে ১০ জুন করা। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, অনাবৃষ্টির কারণে আম পাকা শুরু হয়েছে, আম পরিপুষ্ট হয়েছে। আমের সাইজও ছোট হয়ে যাচ্ছে। আম বাগানে রাখা যাচ্ছে না। সেকারণে সরকার নির্ধারিত ২০ জুন যদি আম বাজারজাত শুরু হয়, তাহলে অনেক আম বাগানেই পেকে নষ্ট হয়ে যাবে। এতে আম চাষি, বাগানি ও ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়বে। ফলে তারা তারিখ এগিয়ে আনার দাবি জানান। ডিসি আরও জানান, স্মারকলিপি পাওয়ার পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে বিষয়টি নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। তারা সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাদের প্রতিবেদনের আলোকে ২০ জুনের পরিবর্তে এবার হাঁড়িভাঙা আম ১০ জুন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারজাত করা হবে। চিত্রলেখা নাজনীন বলেন, আবহাওয়ার কারণেই মূলত আগেই হাঁড়িভাঙা আম এবার পেকেছে। সেকারণে এই সিদ্ধান্ত। তিনি আমচাষি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের পরিপুষ্ট ও মানসম্মত আম যথাসময়ে নিয়ম মেনে বাজারজাত করার আহবান জানান। জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণের এ সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আমচাষি, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। হাঁড়িভাঙা আমচাষি পরিষদের সভাপতি আব্দুস সালাম সরকার জানান, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা জেলা প্রশাসনকে স্মারকলিপি দিয়ে বাজারজাতের তারিখ ২০ জুনের পরিবর্তে ১০ জুন করার দাবি জানিয়েছিলাম। প্রশাসন আমাদের আবেদনটি বিবেচনায় নিয়েছেন, এ জন্য আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে কৃতজ্ঞ। এদিকে, এ বছর হাঁড়িভাঙা আমের ফলন ভালো হলেও অনাবৃষ্টি-অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে গতবারের তুলনায় এবার পাওয়া যাবে ছোট আকারে আম। তবে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি বিপণন ও পরিবহন এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার দাবি এই অঞ্চলের আম চাষিদের। আর কৃষি বিভাগ বলছেন, এই আম বিক্রি করে অর্থনৈতিক খাতে যুক্ত হবে ২৫০ কোটি টাকারও বেশি। মিঠাপুকুর উপজেলার আখিরাহাট, পদগঞ্জ, মাঠেরহাট, বদরগঞ্জের গাপোলপুর, লাগেরহাট, সর্দারপাড়া, রংপুর নগরের বড়বাড়ী, সদর উপজেলার সদ্যপুস্করণী ইউপিরকাটাবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বিশাল বিশাল বাগানে সারি সারি আম গাছ। এবার জেলার এসব এলাকায় প্রায় ৩ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে সব জাতের আমের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে রয়েছে হাঁড়িভাঙা আম। ধান-তামাকের জেলা রংপুরে এখন হাঁড়িভাঙা আমকে ঘিরে বেকারের সংখ্যা কমেছে। বিশেষত জেলার বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুরের লালপুর, পদাগঞ্জ, তেকানিসহ আশপাশের গ্রামের বেকার যুবকরা এখন আম ব্যবসায় জড়িয়ে বেকারত্ব দূর করেছেন। অনেকে আবার উদ্যোক্তা হিসেবে হাঁড়িভাঙার বাজার সম্প্রসারণ ও চাষাবাদ বাড়ানোর জন্য কাজ করছেন। তরুণ উদ্যোক্তা ও আমচাষি মেহেদী হাসান পলাশ বলেন, প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে আম চাষ শুরু করেছিলাম। লাভবান হওয়ার পর থেকে এখন বাণিজ্যিকভাবে হাঁড়িভাঙা আমের চাষাবাদ ও ব্যবসা করছি। নিজের পাশাপাশি এলাকার অন্যদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে চেষ্টাও করছি। টেকসই অর্থনীতির জন্য হিমাগার স্থাপন, আধুনিক আমচাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন, গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনসহ হাঁড়িভাঙাকে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান জানান হাঁড়িভাঙা আমের সম্প্রসারক আব্দুস সালাম সরকার। তিনি বলেন, সরকার প্রধানের উদ্যোগে দেশ-বিদেশে হাঁড়িভাঙা আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। আমরা এতে খুশি। তবে আর একটু দৃষ্টি দিলেই হাঁড়িভাঙাকে ঘিরেই এই অঞ্চলের অর্থনীতি আরও সচল হবে। এজন্য সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি বিপণন ও পরিবহন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি। এবার জেলায় আম উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৭৩০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে হাঁড়িভাঙা আমের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন আম। আবহাওয়া ভালো থাকলে শুধু হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি করে ২০০-২৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারবেন এ জেলার আমচাষিরা। বিগত কয়েক বছর ধরে রংপুর অঞ্চলকে সমৃদ্ধির দিকে নেওয়া সুস্বাদু, মিষ্টি ও রসালো ফল হাঁড়িভাাঁর কদর এখন দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। মৌসুমের শুরুতে হাঁড়িভাঙার চাহিদা বেশি থাকায় এর দাম কিছুটা বেশি থাকবে।
সেক্ষেত্রে প্রতি কেজি হাড়িভাঙ্গা আম ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে পারে। বাজারে হাড়িভাঙ্গা কেনা ছাড়াও বড় বড় বাগান মালিকদের সঙ্গে সরাসরি এবং অনলাইনের মাধ্যমে যোগাযোগ করেও আম সরবরাহ করা যাবে। রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছেন, এবারে রংপুর অঞ্চলে হাঁড়িভাঙার ফলন ভালো হয়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে আম আকারে কিছুটা ছোট হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, সারা দেশে জনপ্রিয়তার তালিকায় থাকা এ আম আবহাওয়া ভেদে এবার নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পরিপক্ক হতে শুরু করেছে। একারণে বাগান মালিকরা এবার গাছ থেকে হাঁড়িভাঙা আম ১০ জুন থেকে পাড়তে পারবেন। তখন থেকে বাজারজাতও করা যাবে। জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের বাজারজাত করতে যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয়, সেটি মনিটরিং করা হবে। বিশেষ করে পরিবহনে ব্যবসায়ীদের কোনো হয়রানির শিকার হতে না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি সরকারি পরিবহন সুবিধার বিষয়টিও দেখা হবে।