বিশ্ব শান্তিরক্ষীর ভূমিকায় নারীর অংশগ্রহণ অপরিহার্য এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীরা বিশ্ব মাতা এবং প্রতিটি গৃহের সাম্রাজ্ঞী। প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু অসাধারণ গুনাবলি তাদের রয়েছে যা দিয়ে একজন পুরুষের চেয়েও বাড়তি কিছু অবদান তারা রাখতে পারেন যে কোন গঠনমূলক কর্মকান্ডে। জাতিসংঘে মিশনে নারীদের অংশগ্রহণ তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর রেখেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশী নারীযোদ্ধাদের অবদান বিশ্ব শান্তিরক্ষার ইতিহাসে আরো একটি গৌরবদীপ্ত অঙ্গীকারের মাত্রা যোগ করেছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মত ২০০০ সালে বাংলাদেশ পুলিশের পাঁচজন সদস্য পূর্ব তিমুরে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেয় এবং কৃতিত্ব ও সাফল্যের সাথে তাদের কর্তব্য সম্পন্ন করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডরোথিয়া হালদার প্রথমবারের মত লাইবেরিয়া শান্তি রক্ষা মিশনে নারী শান্তিরক্ষী হিসাবে অংশগ্রহণ করেন এবং সফলতার স্বাক্ষর রাখেন।
২০০৬ সালে আইভরিকোষ্ট শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের তিনজন নারী অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল নীলুফার, লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেবুন্নেসা এবং মেজর নাজমা (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) প্রথমবারের মত অংশ নিয়ে বহুজাতিক শান্তিরক্ষীর প্রাংগনে মাতৃভূমির মুখ উজ্জ্বল করেন। এরপরে ২০১০ সালে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ পুলিশের একটি নারী কন্টিনজেন্ট হাইতি শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেয়। তারা দক্ষতা ও সফলতার সাথে এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন যা নারী ক্ষমতায়নে এক মাইল ফলকের সূচনা করে। এই কন্টিনজেন্টের ১৬৮ জন সদস্যের সবাই ছিলেন নারী। বিশ্ব শান্তিরক্ষা মিশনে এ ছিল এক বিরল ঘটনা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে প্রথম বারের মত নারী কমান্ডার- কর্নেল নাজমার( পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) নেতৃত্বে বাংলাদেশ লেবেল-টু হাসপাতাল আইভরিকোষ্টের মাটিতে দক্ষতা ও সফলতার সাথে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে।
জাতিসংঘের ইতিহাসে তিনিই প্রথম মিলিটারি মেডিকেল কমান্ডার। তিনি এবং তার ইউনিট সদস্যরা সারা বিশ্বের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (তদকালীন কর্নেল) নাজমা জাতিসংঘের বিশেষ সম্মাননা এবং পুরষ্কার লাভ করেন। এর পরের বছর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দুজন নারী পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তামান্না ও নাইমা জাতিসংঘ মিশনে এক অনন্য সাধারন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। কঙ্গো শান্তি মিশনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম নারী পাইলট তারা। তাদের এই দক্ষ এবং সাহসী অংশগ্রহণ নারী ক্ষমতায়ন এবং নেতৃত্বকে করেছে আরো বেশি মহিমান্বিত এবং অগ্রগণ্য। ২০১৭ সালে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে কর্নেল আমিনা, ২০১৮ সালে কর্নেল নাজমা এবং ২০২১ সালে কর্নেল তানিয়ার যুগান্তরী নেতৃত্ব জাতিসংঘে নারীদের ভূমিকাকে আরো দীপ্যমান করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই তিন নারী কমান্ডার প্রশ্নাতীত ভাবে প্রমাণ করেছেন বিশ্বশান্তি রক্ষায় নারীরা অনন্য। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলস ভাবে তারা শান্তির সুরভি ছড়িয়েছেন অশান্ত আফ্রিকার মাটিতে। সেন্ট্রাল আফ্রিকায় বাংলাদেশের আর এক অদম্য নারী শান্তিরক্ষী কর্নেল জেবুন।
একজন খ্যাতিমান রেডিওলজিস্ট হয়েও বাংলাদেশের মেডাল প্যারেডে তিনি সফল প্যারেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জাতিসংঘের সেন্ট্রাল আফ্রিকার ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী প্যারেড কমান্ডার। বহুজাতিক শান্তিরক্ষীদের মূহুর্মূহ করতালিতে তিনি প্রমাণ করেছিলেন বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীরা সব ক্ষেত্রেই অদম্য- অপরাজেয়। সেদিন সুদীপ্ত হাতে তিনি তুলে ধরেছিলেন মহান পতাকা মাতৃভূমির।
জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী প্রেরণে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। মহান মাতৃভূমির এই গৌরবগাথাকে আরো বেশি আকাশছোঁয়া করেছে নারী শান্তিরক্ষীদের সুদক্ষ এবং তেজদীপ্ত অংশগ্রহণ। এ পর্যন্ত মোট -৬১২ জন নারী শান্তিরক্ষী অত্যম্ত সফলতার সাথে যুদ্ধ কবলিত এবং বিপদ সংকুল দেশগুলোতে কঠিনতম এই দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বজন স্বদেশ হতে হাজার হাজার কিলোমিটার দুরে কঙ্গো, মালি, লাইবেরিয়া, আইভরিকোষ্ট, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, পশ্চিম সাহারার মত বিপদসংকুল দেশগুলোর শান্তি রক্ষায় গৌরবোজ্জ্বল দীপ্ত পদচারণা তাদের।
নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মূলক কার্যক্রম পূর্ণতা পেত না। নারী শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘের দৃষ্টিসীমাকে বাড়িয়ে দ্বিগুন করেছে। তারা ভিন্ন এক অবস্হান ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থেকে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম মূল্যায়ন করেছে। তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় নারীরাও একটি রোল মডেলের ভূমিকা রাখতে পারে। জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ সংঘাত কবলিত আফ্রিকার দেশগুলোতে তারাও একজন পুরুষ শান্তিরক্ষীর মত অবদান রাখতে পারে। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের এই অবদান আরো বেশি। যুদ্ধ কবলিত দেশগুলোর বিদ্রোহীরা নারী শান্তিরক্ষীদের উপর অধিক আস্হাশীল হওয়ায় নারীরা সহজেই তাদের বিপথগামী পথ থেকে ফেরাতে পারেন। যুদ্ধ যৌন সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুরা খুব সহজেই তাদের সমস্যার কথা একজন নারী শান্তিরক্ষীর কাছে খুলে বলতে পারেন, এমনকি পুরুষেরাও। নারী শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের পিছিয়ে পড়া সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য অনুপ্রেরনীয় দৃষ্টান্ত রাখছে। তারা অনুকরণীয় উদাহরণ রাখছে-মেয়েরাই এখন দেশ, জাতি ও বিপন্ন মানবতার নিরাপত্তা দিতে পারে।
এ ছাড়াও বাংলাদেশী নারী শান্তিরক্ষীরা শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের বাইরেও অনেক জনসেবা ও জনহিতকর কাজে তাদের প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। নারী শিক্ষা, নারীর স্বাস্থ্য, গর্ভকালীন সেবা, শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যা ও পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদির উপর শিক্ষা ও সচেতনতা মূলক ক্লাশ ছাড়াও ম্যালেরিয়া, এইডস ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাসহ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছে। প্রকৃতি প্রদত্ত সূত্রেই নারীরা গভীর চেতনা ও পর্যবেক্ষণশক্তির অধিকারী। তারা মানুষের না বলা কথাগুলোও শুনতে পারে। বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীরাও প্রাকৃতিক ভাবে এই ক্ষমতায় বলিয়ান। অতিমানবিক এই ক্ষমতাবলেই তারা জয় করেছে সুদুর আফ্রিকার প্রত্যন্ত মানুষের হৃদয় মন । জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের অস্থিতিশীল পরিবেশে নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়ন এবং জেন্ডার মূলধারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
সৃষ্টির শুরু হতেই কল্যাণময়ী নারীরা জগত সংসারের কল্যাণ কামনায় প্রতিশ্রুতিশীল অবদান রেখেছে। মেধা, মননশীলতা, দুরদর্শিতা, সৃজনশীলতা ও সার্বিক মানবিক গুনাবলিতে একজন নারী অনেকটাই এগিয়ে। পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে তারা। বাংলাদেশের নারীরা কোমলে কঠিনে এক অনন্য মানব সত্তা। জাতিসংঘের বহুজাতিক শান্তিরক্ষীর প্রাঙ্গণে তারা অর্জিত সন্মান ও মর্যাদায়, সুদীপ্ত গৌরবে আকাশ ছোঁয়া করেছে মাতৃভূমি ও মহান পতাকার মান। সবার হৃদয় গহীনে গ্রন্থিত হয়েছে — বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশী নারীরাই অসাধ্য সাধন করেছে। জাতিসংঘে তাদের অবদান অপরিহার্য। লেখক: কথাশিল্পী, কলামিস্ট, গবেষক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক চিকিৎসক।