শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ১২:০৪ পূর্বাহ্ন

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সুভাষ মুখোপাধ্যায়
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০২৩

(Subhash Mukhopadhyay) ছিলেন একজন বাঙালি কবি ও গদ্যকার যিনি বাংলাদেশের সাহিত্যপ্রেমীদের কাছেও খুব প্রিয়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখ অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে মামাবাড়িতে। তার পিতার নাম ক্ষিতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মা যামিনী দেবী। পিতা ছিলেন সরকারি আবগারি বিভাগের কর্মচারী; তার বদলির চাকরির সুবাদে কবির ছেলেবেলা কেটেছিল পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। তার ছেলেবেলার প্রথম দিকটা, যখন তার বয়স তিন-চার, সে সময়টা কেটেছে কলকাতায়, ৫০ নম্বর নেবুতলা লেনে। একটা ভাড়াবাড়ির দোতলায় যৌথ পরিবারের ভিড়ের মধ্যে। প্রথমে নওগাঁর স্কুলে এবং পরে কলকাতার মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন ও সত্যভামা ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেন। ভবানীপুরের মিত্র স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সক্রিয় রাজনীতি করার মানসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।
নিজের বাল্যকাল সম্পর্কে এক চিঠিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমার শৈশব কেটেছে রাজশাহীর নওগাঁয়। বাবা ছিলেন আবগারির দারোগা। নওগাঁ শহর ছিল চাকরি, ব্যবসা, নানা বৃত্তিতে রত বহিরাগতদের উপনিবেশ। হিন্দু-মুসলমান এবং বাংলার নানা অঞ্চলের মানুষজনদের মেলানো-মেশানো দিলদরাজ আবহাওয়ায় আমরা একটু অন্যরকমভাবে মানুষ হয়েছিলাম। একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে যৌথ জীবন। সব সম্প্রদায়েই এমন সব মানুষের কাছে এসেছি যাঁরা স্বধর্মে গোঁড়া, কিন্তু মানুষের সম্বন্ধে উদার। আমার অক্ষরপরিচয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা নওগাঁয়। পড়েছি মাইনর স্কুলে। পাঠ্যবইয়ের চেয়েও বেশি পড়েছি পাঠাগারের বই। সেই সঙ্গে আমাকে শিক্ষা দিয়েছে খেলার মাঠ, গান আবৃত্তি অভিনয়ের মঞ্চ। নওগাঁ শহরের জীবন আমার ব্যক্তিত্বের গোড়া বেঁধে দিয়েছিল।’
১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স-সহ বিএ পাস করেন। পরে আশুতোষ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নে প্রয়াসী হন। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকা-ে যুক্ত থাকার ফলে পঠনপাঠন বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কবি শিক্ষকরূপে লাভ করেন কবি কালিদাস রায় ও কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক মুরলীকৃষ্ণ বসুকে। বিদ্যালয়ে বন্ধুরূপে পেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রমানাথ রায়, পরিমল সেনগুপ্ত, রমাকৃষ্ণ মৈত্র প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে। আরো পরে কর্মজীবনে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় কবি বিষ্ণু দে, সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু, কারাজীবনের সঙ্গী আব্দুর রজ্জাক খান, সতীশচন্দ্র পাকড়াশী, উর্দু সাহিত্যিক পারভেজ শহীদী, চারু মজুমদার, গিরিজা মুখোপাধ্যায়, চিন্মোহন সেহানবীশ প্রমুখের।
রাজনৈতিক ও কর্মজীবন: ১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদল-এর সক্রিয় সদস্যরূপে যোগ দেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এই সময় কবি সমর সেন তাকে দেন হ্যান্ডবুক অব মার্কসিজম নামে একটি গ্রন্থ। এটি পড়ে মার্কসীয় রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন কবি। ১৯৩৯ সালে লেবার পার্টির সঙ্গে সংযোগ হয় তার। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক। পরে ছাত্রনেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্ররোচনায় লেবার পার্টি ত্যাগ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪২ সালে পান পার্টির সদস্যপদ। এই সময় সদ্যগঠিত ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের সাংগঠনিক কমিটিতে কবি বিষ্ণু দে-র সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তারপর মাসিক ১৫ টাকা ভাতায় সর্বক্ষণের কর্মীরূপে যোগ দেন পার্টির জনযুদ্ধ পত্রিকায়। ১৯৪৬ সালে দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে যোগ দেন কবি। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে বহু কমিউনিস্ট বন্দীর সঙ্গে দু-বার কারাবরণ করেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। এই সময় তিনি সামিল হন দমদম জেলের অনশন ধর্মঘটে। ১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসে পান মুক্তি।
মুক্তির পর কবির জীবনে দেখা দেয় প্রচ- অর্থকষ্ট। একটি নতুন প্রকাশন সংস্থায় মাত্র ৭৫ টাকা বেতনে সাব-এডিটর নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৫১ সালে সেই চাকরি ত্যাগ করে পরিচয় পত্রিকার সম্পাদনার দায?িত্ব গ্রহণ করেন। এই বছরই পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন সুলেখিকা গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ১৯৫২ সালে সস্ত্রীক কবি ওঠেন বজবজ এলাকার শ্রমিক বস্তির একটি মাটির ঘরে; আত্মনিয়োগ করেন সেই অঞ্চলের চটকল মজুর সংগঠনের কাজে। পরে কলকাতার বন্দর অঞ্চলে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের কাজও করেন। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হলে তিনি থেকে যান পুরনো পার্টিতেই। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হলে আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে দ্বিতীয়বার কারাবরণ করেন। এই দফায় ১৩ দিন কারারুদ্ধ ছিলেন কবি। মাঝে কিছুকাল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে একযোগে সন্দেশ পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন তিনি।
সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে একে একে লিখে গেছেন অগ্নিকোণ, চিরকুট, কাল মধুমাস, ফুল ফুটুক, যত দূরেই যাই, ছেলে গেছে বনে, জল সইতে, একটু পা চালিয়ে ভাই প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ; হাংরাস, অন্তরীপ, হ্যানসেনের অসুখ বা ঢোলগোবিন্দের আত্মদর্শন প্রভৃতি গদ্যরচনা; চিঠি জুড়ে জুড়ে লেখা চিঠির দর্পণে-এর মতো অপ্রচলিত কাঠামোর উপন্যাস। অনুবাদ করেছেন নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা ও হাফিজ-এর কবিতা, চর্যাপদ ও অমরুশতক ইত্যাদি।
শেষজীবন: বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে শেষ জীবনে। কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে হন বিতর্কিত।
১৯৭০-এর দশক থেকে তার রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিবর্তন সাধিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অকুণ্ঠ সমর্থন জোগালেও তিনি পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনকে সমর্থন করেননি; কে কোথায় যায় উপন্যাসে এই আন্দোলনের প্রতি তার বিরূপতা ব্যক্ত করেছিলেন। সমর্থন করেন ১৯৭৭ সালের জরুরি অবস্থাকে। এই সময়েই অ্যাফ্রো-এশীয় লেখক সমিতির কাজের চাপে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন থেকে দূরে সরে আসতে থাকেন কবি। ১৯৮১ সালে রণকৌশল ও অন্যান্য কিছু রাজনৈতিক প্রশ্নে পার্টির সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেন। এরপর থেকেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলির সঙ্গে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লাভ করেন তার সান্নিধ্য। ফলে সৃষ্টি হয় বিতর্ক। স্রোতের বিপরীতে চলে পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের কাছে সমালোচিত হন এ-যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এই বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি।
যকৃৎ ও হৃদপি-ের অসুস্থতার কারণে দীর্ঘকাল রোগভোগের পর ২০০৩ সালে কলকাতায় তার প্রয়াণ ঘটে। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী ছাড়াও তার তিন পালিতা কন্যাকে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য: তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি কবি। আধুনিক বাংলা কাব্যজগতে চল্লিশের দশকের অন্যতম কবি হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৪০-এ প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ প্রকাশের মধ্য তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে নতুন সুর নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মানুষের বৈষম্যলাঞ্চিত দুর্দশার বিরূদ্ধে দ্রোহ তাঁর কবিতার মূল সুর। ‘পদাতিক’ প্রারম্ভে ছিল ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য কাঠফাঁটা রোদে সেঁকে চামড়া’। কথ্যরীতিতে রচিত তার কবিতা সহজবোধ্যতার কারণে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর আনুকূল্য লাভ করে। মানবিক বোধ ও রাজনৈতিক বাণী তার কবিতার অন্যতম প্রধান অভিমুখ। পদাতিক কাব্যগ্রন্থের মে দিনের কবিতা কেবল শ্রমিক শ্রেণির এক বিজয়কাব্য নয়, এতে ব্যক্ত হয়েছে ঔপনিবেশবাদের উচ্ছেদসাধনের ঋজু প্রত্যয় –
“শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা;
মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না –
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা।
প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয়, হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন আত্মা।”
তার কাব্যভাষা নিরলংকার। নিজ উপলব্ধি ও প্রত্যয় তিনি গদ্যের সুরে ব্যক্ত করেছেন। এক স্বতন্ত্র উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর। অগ্রজ আধুনিক কবিদের মতো তিনি দুর্বোধ্য নন, দুরূহ নন। সহজেই তার কবিতা পড়া যায়, বোঝা যায় এবং অনুভব করা যায়। চল্লিশের যুদ্ধ-দাঙ্গা-তেভাগা-মন্বন্তর সঙ্কুলিত রাজনৈতিক টালমাটালের যুগসন্ধিক্ষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেনÍ
“আমি আসছি
দুহাতে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে আমি আসছি।
সঙীন উদ্যত করেছ কে? সরাও।
বাধার দেয়াল তুলেছ কে? সরাও।
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে আমি আনছি
দূরন্ত দুর্নিবার শান্তি।”
জগৎজুড়ে যে পথে ‘শান্তি’ আনা সম্ভব, সেই পথেররেখা তার কাছে ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। তার কবিতায় সেই পথনির্দেশিকাও আছে। কবিতাটির নাম, ‘বাঁয়ে চলো, বাঁয়ে’Í
“বাঁয়ে চলো ভাই,
বাঁয়ে
কালো রাত্রির বুক চিরে,
চলো
দুহাতে উপড়ে আনি
আমাদেরই লাল রক্তে রঙিন সকাল।”
কখনো কখনো প্রতীয়মান হয় তার কবিতা চড়া সুরে বাঁধা। চল্লিশের দশক থেকে তার অ-রোম্যান্টিক গদ্যপ্রধান কাব্যভঙ্গী পরবর্তীকালের কবিদের কাছে অনুসরণীয় হয়ে ওঠে। সমাজের তৃণমূল স্তরে নেমে গিয়ে সেই সমাজকে প্রত্যক্ষ করে তবেই কবিতা রচনায় প্রবৃত্ত হতেন তিনি। আদর্শ তার কবিতাকে দিয়েছিল পরিব্যাপ্ত জনপ্রিয়তা। তবে কবিতার মাধ্যমে একটি বার্তা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে তিনি অক্ষরবৃত্তের চালে আধুনিক কবিতার গদ্যঋদ্ধ নতুন রূপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠার পর কারাবন্দী হন তিনি। এ পর্যায়ে লিখেছিলেন ‘শতাব্দীলাঞ্ছিত আর্তের কান্না/ প্রতি নিশ্বাসে আনে লজ্জা।’ বেশ কিছু সময় পরে আবার লিখেছিলেন ‘লেনিন যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,/শতাব্দী শেষ হয়ে আসছেÍ/একটু পা চালিয়ে, ভাই, একটু পা চালিয়ে।।’ তার কাব্যভাষায় প্রচলিত ছন্দের কাঠামো ছিল না। তবে ছিল ছন্দের প্রাণবন্ত স্পন্দন।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার দৃষ্টান্ত
পদাতিক: পদাতিক গ্রন্থের বধূ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের স্নিগ্ধ রোম্যান্টিকতার বিপরীত ধ্বনি শোনা যায়; কতকটা কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো গানের অনুষঙ্গে
“ইহার মাঝে কখন প্রিয়তম
উধাও; লোক লোচন উঁকি মারে
সবার মাঝে একলা ফিরি আমি
-লেকের জলে মরণ যেন ভালো।”
চিরকুট: চিরকুট কাব্যটি বাংলা ফ্যাসিবিরোধী সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। শুধু ফ্যাসিবিরোধিতাই নয়, এই কাব্যে উঠে এসেছে ভারতের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের স্মৃতি। স্ফুলিঙ্গ, জবাব চাই, প্রতিরোধ প্রতিজ্ঞা আমার, ফের আসবো, এই আশ্বিনে, চিরকুট প্রভৃতি কবিতায় আছে বিশ্বাস, বলিষ্ঠতা, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ আবার আবেগের বিধুরতাও। ঘোষণা কবিতায় দেখা যায় –
“গঙ্গার জোয়ার এসে লাগে

ভল্গার তীরের স্পর্শ,
চোখে নব সূর্যোদয় জাগে;
মুক্তি আজ বীরবাহু
শৃঙ্খল মেনেছে পরাভব;
দিগন্তে দিগন্তে দেখি
বিস্ফোরিত আসন্ন বিপ্লব।”
অগ্নিকোণ: ১৯৪৮ সালে পার্টির দৈনিকের টাকা তোলার জন্য কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লেখেন মাত্র পাঁচটি কবিতার সংকলন অগ্নিকোণ। কবির ভাষায়, “রাজনীতিকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির জন্যেই অগ্নিকোণের প্রকাশ”। এই কাব্যে কবি উদ্বেল হয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুক্তিসংগ্রামের সংবাদে –
“লক্ষ লক্ষ হাতে
অন্ধকারকে দু’টুকরো ক’রে
অগ্নিকোণের মানুষ
সূর্যকে ছিঁড়ে আনে।”
অগ্নিকোণ ও ফুল ফুটুক কাব্য রচনার মধ্যবর্তী সময়ে কবি উপলব্ধি করেন এক চরম নান্দনিক সত্য:
“সেই শিল্পই খাঁটি শিল্প, যার দর্পণে জীবন প্রতিফলিত। তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে যা কিছু সংঘাত সংগ্রাম আর প্রেরণা, জয়, পরাজয় আর জীবনের ভালোবাসা, খুঁজে পাওয়া যাবে একটি মানুষের সব কটি দিক। সেই হচ্ছে খাঁটি শিল্প যা জীবন সম্পর্কে মানুষকে মিথ্যা ধারণা দেয় না। কবিতার গদ্যের আর কথা বলবার ভাষার বিভিন্নতা নতুন কবি স্বীকার করেন না। এমন এক ভাষায় তিনি লেখেন – যা বানানো নয়, কৃত্রিম নয়, সহজ, প্রাণবন্ত, বিচিত্র গভীর, একান্ত জটিল – অর্থাৎ অনাড়ম্বর সেই ভাষা।”
এই সত্য প্রতিফলিত হয় তার পরবর্তীকালের কাব্যগুলিতে। কমিউনিজমের বাঁধা বুলি ছেড়ে তিনি চিত্রকল্প নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষায় রত হন এই কাব্যগুলিতে। ফুল ফুটুক কাব্যের আরও একটা দিন কবিতায় অন্ধকারের এক আশ্চর্য ছবি আঁকেন কবি,
“জলায় এবার ভাল ধান হবে –
বলতে বলতে পুকুরে গা ধুয়ে
এ বাড়ির বউ এল আলো হাতে
সারাটা উঠোন জুড়ে
অন্ধকার নাচাতে নাচাতে।”
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্মাননা প্রাপ্তি: দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বঞ্চনা ও অসম্মান অনেক জুটলেও সাহিত্যের অঙ্গনে সম্মানিতই হয়েছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার পান ১৯৬৪ সালে; ১৯৭৭ সালে অ্যাফ্রো-এশিয়ান লোটাস প্রাইজ; ১৯৮২ সালে কুমারন আসান পুরস্কার; ১৯৮২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রদত্ত মির্জো টারসান জেড পুরস্কার; ১৯৮৪ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ওই বছরেই পান সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু পুরস্কার ও ১৯৯২ সালে ভারতীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।[৭] ১৯৯৬ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা সাহিত্য অকাদেমী ফেলোশিপ পান সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত করেছিল তাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম দ্বারা।
এছাড়াও প্রগ্রেসিভ রাইটার্স ইউনিয়নের ডেপুটি সেক্রেটারি ও ১৯৮৩ সালে অ্যাফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের সাধারণ সংগঠক নির্বাচিত হন কবি। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি ছিলেন সাহিত্য অকাদেমির একজিকিউটিভ বোর্ডের সদস্য। সত্তরের প্রথম ভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাসিবুল ইসলাম ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়: কবি ও কবিতা’ শিরোনামে একটি অভিসন্দর্ভ লেখেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে এটি প্রথম গবেষণা। এর পর তাঁকে নিয়ে বহু লেখালিখি ও গবেষণা হয়েছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নামানুসারে নামাঙ্কিত কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশনের সম্মুখভাগ। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ পদাতিক-এর নামানুসারে ২০০৯ সালে শিয়ালদহ-নিউ জলপাইগুড়ি এক্সপ্রেসের নাম রাখা হয় “পদাতিক এক্সপ্রেস”। ২০১০ সালের ৭ অক্টোবর কলকাতা মেট্রো নিউ গড়িয়া স্টেশনটি কবির নামে উৎসর্গ করে, এই স্টেশনটি বর্তমানে কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন নামে পরিচিত।-উৎস: যঃঃঢ়ং://িি.িনরংযষবংযড়হ.পড়স/৭৩৬৫/




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com