শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৩ পূর্বাহ্ন

বিদায় হজ্বের প্রীতিময় ভাষণ

এম এ কবীর
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ২০২৩

এ বছর হজ্বের পুরো কার্যক্রম সহজ করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে সৌদি আরব। তথ্য-প্রযুক্তি হজ্ব কার্যক্রমকে একেবারে বদলে দেবে বলে জানিয়েছেন দেশটির হজ্ব ও ওমরাহ বিষয়ক উপমন্ত্রী আবদুল ফাত্তাহ। তিনি বলেছেন, এবার স্মার্ট ব্রেসলেটের মাধ্যমে হজ্বযাত্রীদের ট্র্যাকিং ও ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ‘নুসুক’ অ্যাপের মাধ্যমে হজ্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সেবা নিতে পারবেন হাজিরা। তা ছাড়া তাফবিজ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। হাজিদের মক্কার বাসা থেকে হজ্বের পবিত্র স্থানগুলোতে অবস্থান এবং সেখান থেকে মসজিদুল হারামে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে অ্যাপটি সহায়তা করবে। এ বছর প্রায় ২০ হাজার বাস হজ্বযাত্রীদের পরিবহনসেবা দেবে। এসব বাস সারিবদ্ধ করা হলে তা প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরত্ব তৈরি করবে।
২০ লাখের বেশি হজ্ব যাত্রী এসব বাসে করে হজ্বের পাঁচ দিন যাতায়াত করবেন। হজ্ব মৌসুমে চারটি অঞ্চলের ১৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৩২ হাজার চিকিৎসক হজ্বযাত্রীদের চিকিৎসা দেবেন। হজ্বের সময় স্বাস্থ্যসেবা দিতে আরাফায় ৪৬টি, মিনায় ২৬টি, হজ্বের স্থানগুলোর রাস্তার পাশে ছয়টি এবং জামারাতে ১৬টিসহ মোট ৩২টি হাসপাতাল ও ১৪০টির বেশি স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। এবার বিশ্বের ১৪ লাখের বেশি হজ্বযাত্রীর জন্য বিভিন্ন কোম্পানির ৪০০টিরও বেশি পরিষেবা প্যাকেজ রয়েছে। এসব প্যাকেজের আওতায় আবাসন, খাদ্য ও ক্যাটারিং ব্যবস্থা করা হয়েছে। হজ্বের স্থানগুলোতে এবার হাজিদের চলাচল সহজ করতে এক হাজার ইলেকট্রিক স্কুটারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশটির ট্রান্সপোর্ট জেনারেল অথরিটি (টিজিএ) দ্বিতীয় বছরের মতো পরিবহনব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে এবার তা চালু করেছে। হজ্ব যাত্রীদের সুরক্ষায় স্কুটারের চলাচলের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট ট্র্যাক। তা অন্যান্য যানবাহন ও পথচারীদের পথ থেকে পুরোপুরি পৃথক। এসব স্কুটারে করে কাদানা স্টেশন থেকে মাহবাস আল-জিন টানেলে যাওয়া যাবে; এর কাছেই অবস্থিত মসজিদুল হারামের বাব আলী স্টেশন। স্কুটার চালানো শেখাতে সেখানে রয়েছে বিশেষজ্ঞ দল।
হজ্বের সময় উচ্চ তাপমাত্রা থেকে সুরক্ষায় হজ্বযাত্রীদের ছাতা ব্যবহারের পরামর্শ দেন দেশটির জনস্বাস্থ্যবিষয়ক উপমন্ত্রী হানি জোখদার। অসুস্থ হজ্বযাত্রীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত রোগী এবং গর্ভবতী নারীদের জন্য আমার পরামর্শ হলো, তারা যেন নিজেরাই জামারাতে পাথর ছুঁড়তে না যান, বরং তাঁদের পক্ষ থেকে অন্য কাউকে এ কাজের জন্য নিযুক্ত করা উচিত। নতুবা রোদের মধ্যে দীর্ঘ পথ হাঁটলে তাঁরা বড় ধরনের স্বাস্থঝুঁকিতে পড়তে পারেন।’
৬৩২ খ্রিস্টাব্দে এক লক্ষ সাহাবা নিয়ে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) হজ্ব সম্পন্ন করেন। এটাই তাঁর জীবনের প্রথম ও শেষ হজ্ব। হজ্বের আরাকান আহাকাম পালন উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ (সা.) মিনা, মুজদালিফা, আরাফাত ও কাবাঘরে অবস্থানের সময় জনসমক্ষে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন।
এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি তাঁর ২৩ বছরের রিসালতের মূল বিষয়বস্তু জনগণের কাছে তুলে ধরেন। জাতিসংঘেরও শত শত বছর আগে ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইট, ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস অ্যাক্ট, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার (Universal Declaration of Human Rights) চৌদ্দশত বছর আগে মানবতার ঝা-াবাহী নবী (সা.) সর্বপ্রথম মানুষের আর্থসামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার ঘোষণা করেন। পরস্পর বিরোধী ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে নবী (সা.)-এর এ ঐতিহাসিক ভাষণ সমগ্র মানবমন্ডলী ও অখন্ড মানবতার এক চূড়ান্ত উত্তরণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) শতাব্দীর এমন এক ক্রান্তিকালে এ ভাষণ দেন; যখন গোটা দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজে বর্ণপ্রথা, বর্ণবৈষম্য, বংশকৌলীন্য ও আভিজাত্যের দম্ভ মানুষকে গৃহপালিত জন্তু অথবা বিশেষ বৃক্ষের চেয়ে হীন পর্যায়ে নিয়ে আসে। রাসূলুল্লাহ (সা.) মানুষের মনন ও মানসিকতায় এ কথা চিত্রায়িত করতে সক্ষম হন যে, সৃষ্টিজগতে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান, সম্মানের যোগ্য ও ভালোবাসার পাত্র হলো মানুষ। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, ‘ হে জনগণ নিশ্চয় তোমাদের প্রভু এক। তোমাদের পিতা (আদম আ:) এক। প্রত্যেকে আদমের সন্তান আর আদমের সৃষ্টি মাটি হতে। সাবধান! অনারবের ওপর আরবের কিংবা আরবের উপর অনারবের, কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কিংবা শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।
যার মধ্যে আল্লাহ ভীতি আছে, সেই শ্রেষ্ঠ’ অর্থাৎ জাতি বা বর্ণভেদ শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ নয়। একমাত্র আল্লাহ ভীতি শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। যে যত বেশি আল্লাহ ভীরু ও পরহেজ্বগার সে তত বেশি শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী (আল-বায়ান ওয়াৎ তিবঈন, ১খ., পৃ.২২৯)। বর্ণবাদ মানবতার জন্য এক বিরাট অভিশাপ। বর্ণবৈষম্যের ছোবল থেকে মানবতাকে মুক্ত করতে তিনি ঘোষণা করেন –
‘হে জনগণ! আল্লাহকে ভয় কর। কোন কর্তিত নাসা কাফ্রি গোলাম তোমাদের আমির নিযুক্ত হলে, তিনি যদি তোমাদের আল্লাহর কিতাব অনুসারে পরিচালিত করে, তবে তার কথা শুনবে এবং আনুগত্য করবে’। কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস হযরত বেলাল (রা.)কে মদিনার মসজিদের মুয়াজ্জিন নিয়োগ করে তিনি বর্ণবাদের সমাধি রচনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ শিক্ষার ভূমিকা কালজয়ী ও বিশ্বজনীন। এর আবেদন আন্তর্জাতিক ও অসাম্প্রদায়িক
নবীজি (সা.) সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যেসব নীতিমালা প্রণয়ন করেন, বিদায় হজ্বের ভাষণে তিনি ফের তাঁর অনুসারীদের স্মরণ করিয়ে দেন। এগুলোর কঠোর অনুশীলন সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম। বিদায় হজ্বের ভাষণে মানবিক নীতিমালাগুলো জনগণের সামনে পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘কারও কাছে কোনো আমানত জমা থাকলে মালিককে তা ফেরত দিতে হবে’ (আল-বিদায়া, ৫ খন্ড পৃ. ২০২)।
তিনি বলেন, ‘হে লোক সকল! আল্লাহ প্রতিটি হকদারের অধিকার আদায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন (অর্থাৎ মিরাসের অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন) আর ওয়ারিসের জন্য ওসিয়ত করা বৈধ নয়’ (আবু দাউদ,২ খন্ড. পৃ .১২৭, নং ২৮৭০)। ‘ সাবধান। অপরাধী নিজ অপরাপধের জন্য দায়ী। সাবধান! পিতার অপরাধে পুত্র দায়ী নয় এবং পুত্রের অপরাপধে পিতাও দায়ী নয়’। ‘ধারনেয়া বস্তু প্রত্যার্পণযোগ্য; দুধপানের জন্য দানের পশু ফেরতযোগ্য; ঋণ আদায় অপরিহার্য এবং জামিনদার ক্ষতিপূরণের জিম্মাদার’ (তিরমিজি, ৪ খন্ড., পৃ. ৪৬১, ১৩৫,৪৩৩)।
‘তোমাদের পূর্বে আমি হাওযে কাউছারে কাছে পৌঁছাব। অন্যান্য নবীর উম্মতের থেকে আমার উম্মতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় আমি গৌরবান্বিত হবো। সুতরাং আমাকে লজ্জায় ফেলো না। আমি অনেকের মুক্তির কারণ হবো (অর্থাৎ আমার সুপারিশের ফলে বহু মানুষ নাজাত লাভ করবে)। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করবো, হে প্রভু! আমার অনুসারীদের রক্ষা করুন। তিনি উত্তরে বলবেন, তুমি জানো না তোমার মৃত্যুর পর তারা দ্বীনের ব্যাপারে কী ধরনের বিদ’আত সৃষ্টি করেছিল’। ‘হে জনগণ! সাবধান! দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্বে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে’। (ইবনে মাজাহ ২ খ., পৃ. ১০০৮, নং ৩০২৯)।
‘ হে মানবমন্ডলী! আমার কথা শোন! আমি আমার কথা পৌঁছিয়েছি? আমি তোমাদের কাছে দু’টি বস্তু রেখে যাচ্ছি, এগুলো দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে (অনুসরণ করলে) ধরলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না; তা হলো ‘আল্লাহর কিতাব’ ও ‘আমার সুন্নাত’ (জীবনাদর্শ)। (আরেক বর্ণনায় ‘আমার পরিবারবর্গ)। নিঃসন্দেহে ‘সাদাকাত’ আমার নিজের জন্য, আমার পরিবারবর্গের জন্য এবং আমার বংশধরদের জন্য অবৈধ। স্বীয় উষ্ট্রীর কেশর হতে একটি চুল হাতে ধারণপূর্বক তিনি বলেন, দৈর্ঘ্য ও ওজনে এ পরিমাণ ‘সাদাকাত’ও যদি গ্রহণ করা হয়, তা হলে গ্রহীতার ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হবে’ (ইবনে খালদুন, ২ খ., পৃ . ৪৭৯)। ‘তোমাদের মা, তোমাদের পিতা, তোমাদের বোন, তোমাদের ভাই, তোমাদের নিকটাত্মীয় এবং পরবর্তী নিকটাত্মীয়ের সাথে সদাচরণ করবে’।
‘যে সন্তান তার পিতা ব্যতীত অন্য কারো নামে বংশসূত্র দাবি করবে কিংবা দাস-দাসী নিজের মনিব ব্যতীত অন্য কাউকে মনিব সাব্যস্ত করবে, তার উপর কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর লানত এবং সকল ফিরিশতা ও মানুষের অভিশাপ; আল্লাহ তার কোনো নফল কিংবা ফরজ (ইবাদত) কবুল করবেন না’ (আল-বিদায়া, ৫ খ., পৃ . ১৭১)। ক্ষমা ঘোষণা- ‘হে জনগণ! আমার কাছে জিবরাঈল এলেন এবং আল্লাহর পক্ষ হতে সালাম পেশ করে বলেন, আরাফাত ও পবিত্র স্থানে অবস্থানকারীদের ত্রুটি বিচ্যুতি আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন’।
উমর ইবন খাত্তাব (রা:) জানতে চাইলেন; এটি কী (কেবল) আমাদের বিশেষত্ব? রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করবে (হজ্ব করবে) তাদেরও ক্ষমা করে দেয়া হবে’ (আত-তারগীব, ২ খ., পৃ. ২৩১)।
বিদায় হজ্বের সময় আরাফাতের ময়দানে নি¤েœাক্ত আয়াত নাজিল হয়: ‘ আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন মনোনীত করলাম’ (সূরা মায়িদা : ৩)।
তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, ‘ আমার ব্যাপারে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে (বলো তো) তোমরা তখন কী বলবে? উপস্থিত লোকজন বলল, আমরা সাক্ষ্য দেব যে, আপনি অবশ্যই পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। আপনি (উম্মতকে) নসিহত করেছেন এবং আপনি দায়িত্ব (যথাযথ আমানত) পালন করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর ‘শাহাদাত’ আঙুল আকাশের দিকে তুলে এবং সমবেত জনতার দিকে নামিয়ে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘হে আল্লাহ সাক্ষী থেকো! হে আল্লাহ সাক্ষী থেকো’।
আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে প্রদত্ত রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিদায় হজ্বের ভাষণ ছিল যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক। আধুনিক যুগের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এ ঐতিহাসিক ভাষণের আবেদন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা যদি তাঁর ভাষণের শিক্ষাগুলো অনুসরণ করি তাহলে জুলুমের অবসান হয়ে মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ নিশ্চিত হবে। নিজের অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি সমাজের অপরাপর সদস্যদের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকা জরুরি, যাতে কারো প্রতি যেন জুলুম না হয়। মানবতার বিপর্যয়ে বিক্ষুব্ধ বিশ্ব পরিস্থিতিতে দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে নবী (সা.) প্রদত্ত বিদায় হজ্বের ভাষণের অনুশীলন পৃথিবীকে আবাদযোগ্য, সুন্দর ও প্রীতিময় করে গড়ে তুলতে পারে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com