রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২১ পূর্বাহ্ন

ইহ ও পরকালে সফলতার নিশ্চয়তা

সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০২৩

বিশ্বনবী সা: যে পথ আমাদেরকে বলে দিয়েছেন, যে শিক্ষামালা নিয়ে তিনি আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছেন, যে মহাগ্রন্থ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন, এগুলোর ওপর আমল করে আমরা ইহ ও পরকালের সফলতা অর্জন করতে পারি। আমরা যত বড় জ্ঞানীই হই, যত বড় দার্শনিকই হই, জ্ঞানী-গুণী ও সুপ-িতের যা-ই হই না কেন, এ ছাড়া ইহকালেও সফলতা অর্জন করতে পারব না এবং পরকালেও সফল হতে সক্ষম হবো না। মহানবী সা:-এর অনুসরণের মধ্যেই সফলতার নিগূঢ় রহস্য নিহিত রয়েছে। তারই পথে সাফল্য ও সফলতা বিদ্যমান। তারই পথ সৌভাগ্যের পথ। বিশ্বনবী সা: যে পথের নির্দেশ করেছেন সে পথেই রয়েছে আমাদের সফলতা ও নিষ্কৃতি।
আমাদের জ্ঞান আমাদেরকে কী বুঝায়? আমাদের জ্ঞান আমাদের বুঝায়, আজকের দর্শন, আজকের ব্যবস্থাপনা এবং আজকের শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতি রয়েছে। আমাদের মন আমাদেরকে এই পন্থা বলে দেয়। এই দর্শন হৃদয়ে বদ্ধমূল করার চেষ্টা চালায়। সে আমাদেরকে জ্ঞানগত এই সমাধান দেয় যে, কিসের দুনিয়া এবং দুনিয়ার চিন্তা? কিসের জাতিস্বার্থ? কিসের জাতি? কিসের প্রতিষ্ঠান? কোথায় মুসলমানদের সমস্যা? পৃথিবীতে মুসলমানদের সমস্যা কোথায়? হিন্দুস্তানের মুসলমানদের সমস্যা কোথায়? খাও দাও ফুর্তি করো! অধিকহারে উপার্জন করো এবং সন্তানদের জন্য অধিক হতে অধিক সম্পদ রেখে যাও। ভালো মানের বাড়ি ও বাংলো নির্মাণ করো। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করো। বিদেশে পাড়ি জমাও। কিসের চিন্তায় তুমি ডুবে আছো? কিসের পরিণাম? কিসের পরকাল? কোথায় জাতির স্বার্থ? জাতীয় সমস্যার চিন্তা কেন? মুসলমানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন? এই ঝক্কি, ঝামেলা ও দুশ্চিন্তায় যদি আমরা পড়ি, তাহলে শান্তি মতো দু’মুঠো ভাতও খেতে পারব না! পান করতে পারব না। এটা তো পুরাতন জ্বর! এই জ্বর আমরা কেন ক্রয় করতে যাব? আমরা ‘খাও দাও ফুর্তি করো’ নীতিতে বিশ্বাসী! এটি ইউরোপের দর্শন। ফুর্তি করার দর্শন, ইউরোপের দর্শন।
আমাদের মন আমাদেরকে বলে : আমাদের বড় সমস্যা ব্যক্তিগত সমস্যা। জাতিগত সমস্যা নয়। সামাজিক সমস্যা নয়। মুসলিম উম্মাহর সমস্যা নয়, বরং সমস্যা হলো এককের। জায়দ, আমর ও বকরের। যেসব সমস্যা চিহ্নিত করা হয় সেগুলো জাতির প্রতিটি ব্যক্তির সমস্যা। জাতীয় সমস্যা নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা আমাদের বলে- জাতিগত কোনো সমস্যা নেই। সুতরাং এটিই ইহকাল এবং এটিই পরকাল। এটিই ভালো এবং এটিই মন্দ। এর ফলে খাবারের যা কিছু পাওয়া যায় তাই খাওয়া হয়। খাবারের জন্য অনেক কিছুই পাওয়া যায়। পরিধান করার জন্য অনেক কিছুই পাওয়া যায়। কিন্তু এই জীবন জন্তু-জানোয়ারের জীবন।
বানরের জীবন কী? গাধার জীবন কী? মহিষের জীবন কী? নির্বিচারে পানাহার করে নেয়! কতক জন্তু নিজের বাচ্চার খবর নেয় না। এমনও দেখা যায়, বাচ্চা মুখ দিলে মা বাচ্চার মুখ থেকে খাবার কেড়ে নেয়। বাচ্চাকে খেতে দেয় না। এটি পশুত্বের দর্শন। এমনটি আমাদের মন আমাদেরকে বলে। শয়তান আমাদের কর্মকে সজ্জিত করে দেখায়। সে বলে, অন্যদের চিন্তায় তোমরা কেন বিগলিত হচ্ছ? সব সময় অন্যদের চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থাকবে কেন? এই ব্যথা ও ব্যাধির মাধ্যমে যে বিগলিত হয় সে সবসময় বিগলিত হতেই থাকে। এই দুশ্চিন্তা তার হাড্ডিকেও গলিয়ে দেয়। এটি আমাদের অন্তর আমাদেরকে বলে।
আমাদের মন আমাদেরকে বলে- কিসের মরণ এবং কিসের পুনরুত্থান? আমাদের পার্থিব জীবনই একমাত্র জীবন। আমরা মরি-বাঁচি এখানেই এবং আমরা পুনরুত্থিত হবো না। এসব কিছু ক্রীড়া-কৌতুক। এটিই পৃথিবীর জীবন। আজ আমরা জীবিত আছি। কাল মরে যাব। কোথায় জাতীয় সমস্যা? কোথায় সামাজিকতা? কোথায় জাতির স্বার্থ? কিসের শিক্ষা ও দীক্ষা? এ দেশে কী হচ্ছে? আগামী দিনে কী হবে? আগামী প্রজন্মের কোন দশা হবে? আমাদের ওপর কী দায়িত্ব? আমাদের ওপর কেবল এতটুকু দায়িত্ব যে, আমরা পানাহার করব। আনন্দ বিনোদন করব। সন্তানদেরকে লেখাপড়া করানো, তাদেরকে সফল মানুষ বানানো, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? এ দেশে কী হতে যাচ্ছে? আগামী দিনে মুসলমানদের কী হতে পারে? এসব চিন্তা আমরা করতে যাব কেন? এই দর্শন আত্মকেন্দ্রিকতার, স্বার্থবাদিতার ও পাশবিকতার। যখন কোনো জাতি এই দর্শন মেনে নেয় এবং নিজের স্বার্থের পেছনে লেগে যায় তার পরিণতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়।
একটি ছোট পরিবার। কিন্তু সেই পরিবারও আজ সঙ্কুচিত হচ্ছে। আমি নিজের জীবনেই দেখতে পেয়েছি যে, পরিবার দিন দিন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়েছে। আগের দিনের চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই, ফুফাতো ভাই ও মামাতো ভাইয়ের পরিবারের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। যখন মানবতার সম্পর্ক ছিল তখন পুরো ভ্রাতৃত্বের সাথেই সম্পর্ক ছিল। গ্রামের প্রতিটি শিশুকে নিজের শিশু বলে মনে হতো এবং প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজের ভাই বলে গণ্য করা হতো। এরপর যখন বস্তুবাদ মানুষের মধ্যে চেপে বসেছে তখন এমন দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে যে, যদি এক মহল্লার কোনো শিশু অপর মহল্লার কোনো শিশুকে আঘাত করেছে, তাহলে অপর মহল্লার লোকেরা রুষ্ট হয়ে গেছে। তারা ক্রোধান্বিত হয়ে বলেছে, আমাদের মহল্লার বাচ্চাকে প্রহার করার সাহস সেই মহল্লার শিশু কোথায় পেল? কিভাবে সে এমন কাজ করতে পারল? আমাদের মহল্লার শিশুর দিকে চোখ উঠিয়ে দেখার দুঃসাহস সে কোথায় পেল? এরপর এই মহল্লার লোকেরা সেই মহল্লার লোকদের সাথে জার্মান ও ইংরেজদের লড়াইয়ের মতো সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হলো! উভয় মহল্লায় তুমুল সংঘর্ষ হলো।
প্রথমে এমন সংঘর্ষ বংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রথমে বংশের মধ্যে লড়াই হলো। আপন মামাতো ভাইদের মধ্যে লড়াই হলো। আপন খালাতো ভাইদের মধ্যে লড়াই হলো। আপন ফুফাতো ভাইদের মধ্যে লড়াই হলো। মামাতো ভাই, খালাতো ভাই, ফুফাতো ভাই ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে পরস্পরে লড়াই হলো। এভাবে লড়াই শুরু হলো। এরপর এমন একটি সময় এলো, ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই হলো। মায়ের পেটের ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের লড়াই হলো।
আমরা এবং আপনারা যে সময়ে অবস্থান করছি এ সময়টি হলো সন্তানদের সাথে লড়াই করার সময়! স্বার্থের দর্শন অন্তত এটিই বলে। ব্যক্তিস্বার্থের পূজা যদি এভাবেই চলতে থাকে, জীবনের সফর যদি এভাবেই চলমান থাকে, তাহলে আপনারা দেখতে পাবেন পিতা-পুত্রের মধ্যেও লড়াই হচ্ছে। পিতা-পুত্রের হাত থেকে খাবার ছিনিয়ে খাবে। দুর্ভিক্ষের সময় এমন ঘটনাও দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, নিজের সন্তানকে মা-বাবা ভুনা করে খেয়ে নিয়েছে! বিক্রয় করে খেয়েছে। এটি হলো অজ্ঞতা ও জাহেলিয়াতের চূড়ান্ত পর্যায়! যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে এমন সময় আসবে যে, সন্তানের মুখ থেকে মানুষ ছিনিয়ে খাবে। স্বার্থপূজার অবস্থা এমনই হয়ে থাকে। উদরপূজার দরুন সম্পর্কের অবনতি ঘটতে ঘটতে এমন পর্যায়ে চলে এসেছে, নিজের সন্তানের সাথেও স্বার্থের হিসাব-নিকাশ চলছে। এ অবস্থাও এক সময় শেষ হয়ে যাবে। সন্তানও থাকবে না। এরপর নিজের সাথে লড়াই করা হবে। নিজের সাথে স্বার্থোদ্ধারের চেষ্টা করা হবে। তখন হাত হাতকে সাহায্য করতে চাইবে না। গতকাল আমরা জামিয়া ইসলামিয়ায় দেখতে পেয়েছি, শিশুরা মুখের সাহায্যে পয়সা উঠিয়ে ক্রীড়া করেছে। স্বার্থপূজা এভাবে চলতে থাকলে হাত হাতকে সাহায্য করতে চাইবে না। হাত মুখকে লক্ষ করে বলবে, খাবার তুমি গ্রহণ করবে। আহার করার স্বাদ তুমি ভোগ করবে। অতএব, আমি কেন তোমার কাছে খাবার এনে দেবো? জমিনের ওপর শয়ন করে মুখ দিয়ে নিজে নিজে খেয়ে নাও! পয়সা উঠানোর পর জামিয়া ইসলামিয়ার শিশুছাত্ররা পালিয়ে গেছে। এটি ছিল তাদের আনন্দ বিনোদন। তাদের এই ক্রীড়ার মতো উপহাস সাধারণ মানুষের মধ্যেও পরিলক্ষিত হবে। এসব বাচ্চা যেভাবে খেলা দেখিয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে সাধারণ মানুষও এমনভাবে স্বার্থের খেলায় অবতীর্ণ হবে। হাত মুখকে সাহায্য করবে না। পা বলবে- আমি কেন অগ্রসর হয়ে তোমাকে খাবার খাওয়াব? পেটের ওপর ভর করে তুমি খাবারের কাছে যাও। খাবার তো তুমি খাবে। স্বাদ তুমি উপভোগ করবে। সুতরাং কষ্টটাও তুমিই করো। আমি কেন কষ্ট করে ক্লান্ত হবো? সাপ যেমন পেটের ওপর ভর করে চলে খেতে যায় ঠিক তেমনিভাবে তুমিও খেতে চাইলে পেটের ওপর ভর করে খাবারের কাছে যাও! স্বার্থের দর্শন এমনটিই বলে। এই অভিশপ্ত বস্তুবাদ ও স্বার্থবাদিতা হতে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ব্যক্তিস্বার্থ, বস্তুবাদ ও স্বার্থবাদিতার দরুন পৃথিবীর অবস্থা কেমন হয়? জাহান্নামের চেয়েও হেয়তর ও কষ্টকর হয়ে যায়। কেউ কারো চিন্তা করে না। কেবল নিজে এগিয়ে যেতে চায়। মনে করুন, ইঁদুর, বানর ও বলদের মতো এদিকে-সেদিকে মুখ মারতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে কোনো কাজ হবে না। কোনো সমস্যার সমাধান ঘটবে না। সুবিচার ও অবিচার শব্দের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। কেউ কারো অধিকার স্বীকার করবে না। ত্যাগ, কোরবানি ও পরার্থপরতা দিন দিন এক প্রাচীন উপাখ্যানে পরিণত হবে। এক অতীত দাস্তানে পরিণত হবে। কোথায় সুবিচার আর কোথায় অবিচার? কোথায় ত্যাগ-তিতিক্ষা? আল্লাহর নবী হজরত মুহাম্মদ সা: আমাদেরকে বস্তুবাদ, স্বার্থবাদ ও আত্মকেন্দ্রিকতার বিপরীতে এক নতুন জীবন বিধান দান করেছেন। তিনি আমাদেরকে জীবনযাপন করার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। এটি আবার কোন ধরনের জীবনযাপন যে, কেবল পানাহার ও ভোগবিলাস করা হবে? স্বার্থচিন্তা করা হবে? আত্মকেন্দ্রিকতা অবলম্বন করা হবে? এটি কোনো জীবন নয়। এমন জীবনের ওপর অভিশাপ বর্ষিত হোক। জন্তু-জানোয়ারের জীবনের ওপর অভিসম্পাত। বকরির জীবনের ওপর অভিশাপ। কিন্তু প্রকৃত মানুষের জীবনের ওপর আল্লাহ তায়ালার করুণাধারা বর্ষিত হোক। সে কেমন মানুষ যার অন্তরে মানুষের প্রতি দরদ নেই? সমবেদনা ও ব্যথা নেই? কেবল নিজের স্বার্থের চিন্তায় ব্যস্ত থাকে? আপন সন্তানকে আহার করানোর চিন্তায় বিভোর থাকে? আজকের পৃথিবীর অবস্থা এমন যে, অন্য কারো পেট ভরছে কি-না এটি দেখতে দ্বিতীয়জন প্রস্তুত নয়। ভাষান্তর : আবদুল কাইয়ুম শেখ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com