শান্তি রক্ষা মিশন নিয়ে জাতিসংঘ ও মালির সামরিক জান্তার মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল বেশ কয়েক বছর ধরে। ২০২১ সালে রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে মিত্রতা করার পর থেকে শান্তিরক্ষীদের ওপর মালি সরকারের একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে অচলাবস্থা তীব্র আকার ধারণ করে। এরূপ পটভূমিতে গত শুক্রবার আফ্রিকার দেশ মালিতে শান্তি রক্ষা মিশনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করে জাতিসংঘ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মালির সামরিক জান্তা সরকারকে রাশিয়ার পক্ষ থেকে সম্ভবত এই বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, ভাড়াটে যোদ্ধা ও সেনা সরবরাহকারী ওয়াগনার গ্রুপ যুদ্ধবিধ্বস্ত মালিতে কাজ চালিয়ে যাবে, যাতে করে স্থিতিশীলতা আসবে, মালি শান্ত হবে। সত্যিই কি তাই? শুরুতেই বলে রাখা দরকার, শান্তিরক্ষী বাহিনীর চলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, ওয়াগনার গ্রুপের ওপর আরো বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়বে মালি। এক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ দমনের লড়াইয়ে ওয়াগনার সেনাদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে থাকবে ক্রমাগতভাবে। এই অবস্থায় যেহেতু মালির উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিয়মিত হামলা অব্যাহত আছে এবং খোদ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বিদ্রোহ-বিবাদে জড়িয়ে ওয়াাগনারের প্রধান প্রিগোশিনের ‘মধুর বন্ধন ছিঁড়ে গেছে’, সেহেতু মালির ভবিষ্যৎ কোন পথে হাঁটতে চলেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থেকেই যায়।
ইসলামপন্থি বিদ্রোহীদের দমন করতে ২০১৩ সাল থেকে মালিতে অবস্থান করছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের উপস্থিতিকে ভালোভাবে নেয়নি মালি কর্তৃপক্ষ। মালির শাসকেরা বহুদিন ধরে বলে আসছিলেন, সব শান্তিরক্ষীকে মালি ছেড়ে যেতে হবে। ‘মালিতে নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতিসংঘের বাহিনী কার্যত ব্যর্থ হয়েছে’Íমালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদোলায়ে দিওপের মুখ থেকেও শোনা গেছে এমন নানা মন্তব্য। তার দাবি, ‘জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশন মালির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এমন সব গুরুতর অভিযোগ করে আসছে, যাতে করে শান্তি, ঐক্য ও দেশের পুনর্গঠন পড়ছে বড় ধরনের বাধার মুখে।’ এই যখন অবস্থা, তখন শান্তিরক্ষী বাহিনীকে ‘কালবিলম্ব না করে’ মালি ছাড়ার আহ্বান জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিওপ।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জাতিসংঘ ও মালির সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা “টানাপোড়েনের সম্পর্ক” আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মালিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা মাথাচাড়া দিতে পারে নতুন করে।’ অর্থাৎ, সন্ত্রাস-উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মালির জান্তা সরকার কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, তা-ই দেখার বিষয়। প্রশ্ন আছে আরেক জায়গায়! রাশিয়া বা পুতিনের সঙ্গে ওয়াগনার প্রধানের উত্তপ্ত সম্পর্কের কথা যদি না-ও ধরা হয়, মালির বর্তমান প্রেক্ষাপটে ওয়াগনার গ্রুপের কার্যকারিতা নিয়ে কথা বলার সুযোগ রয়েছে বইকি। মনে রাখতে হবে, বিদ্রোহের আগুনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ওয়াগনার বাহিনী কেবল স্থলযুদ্ধে পারদর্শী, আকাশ হামলায় তারা কার্যত ‘অক্ষম’। অর্থাৎ, শান্তিরক্ষী বাহিনীর মালি থেকে চলে যাওয়া এবং ওয়াগনারের ওপর মালির নির্ভর করার অর্থ হচ্ছে অনিশ্চয়তার বৃত্তে দেশটির ভাগ্য ঝুলে যাওয়া!
অনেকে হয়তো রয়টার্সের একটি প্রতিবেদন লক্ষ করে থাকবেন। রাশিয়ার সঙ্গে ওয়াগনার গ্রুপের সাম্প্রতিক বিদ্রোহ ইতিমধ্যে মালি ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের (সিএআর) জন্য যে কূটনৈতিক সমস্যা ডেকে এনেছে, তা তুলে ধরা হয়েছে ঐ প্রতিবেদনে। বলা হচ্ছে, আফ্রিকার দেশগুলোতে ‘ভাড়াটে বাহিনী ক্রমবর্ধমানভাবে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাইছে!’ এই সংবাদ দেশগুলোর নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ বটে!
একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। মালি থেকে ফরাসি সেনারা চলে যাওয়ার পর দেশটিতে লাইমলাইটে আসে ওয়াগনার গ্রুপ। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মালির বছরের পর বছর ধরে চলে আসা লড়াইয়ের মাঠে সরব হতে থাকে ভাড়াটে সেনারা। বিশেষ করে ফ্রান্স সেনা প্রত্যাহার করে মালিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সেই সুযোগ কাজে লাগায় ওয়াগনার বাহিনী। যা হোক, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রত্যাহার ঘোষণার পর রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, ‘ওয়াগনার গ্রুপ মালিতে কাজ চালিয়ে যাবে।’ তিনি এ-ও বলেছেন, ‘সম্প্রতি ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে রাশিয়ার যে গন্ডগোল হয়েছে, তা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে না।’ ল্যাভরভের এই কথাকে কি সত্য ও যুক্তিসংগত বলে ধরে নেওয়া যায়? আসুন, মিলিয়ে দেখি।
দিন কয়েক আগে লাভরভকে বলতে শোনা গেছে, ইউরোপ ও ফ্রান্স মালি ও প্রতিবেশী সিএআরের ওপর থেকে ‘মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে’, মালিকে ‘পরিত্যাগ করেছে’। এ অবস্থায় দেশগুলো তাদের ‘নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে’ রাশিয়া ও ওয়াগনার সেনাদের দিকে ঝুঁকছে। ল্যাভরভের এ ধরনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে আফ্রিকা নিউজ এক খবরে বলেছে, ‘ওয়াগনার গ্রুপ হচ্ছে পশ্চিমাদের মনে ভয় ধরিয়ে রাখার জন্য রাশিয়ার অন্যতম হাতিয়ার!’ খবরে এ-ও বলা হয়েছে, ‘মস্কোর স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই ওয়াগনার গ্রুপের আসল মিশন।’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলা হয়েছে তা হলো, ‘ওয়াগনার গ্রুপ আদতে এমন এক বাহিনী, যাকে যেখানেই মোতায়েন করা হবে, সেখানেই বিশৃঙ্খলা, রক্তপাত, নৃশংসতা ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকবে!’ তাহলে হিসাবটা কী দাড়াচ্ছে? মালিতে ওয়াগনার বাহিনীর ভূমিকা তথা বামাকোর (মালির রাজধানী) মাটিতে ওয়াগনার সেনাদের উপস্থিতি-অনুপস্থিতির ওপর বেশ খানিকটা নির্ভর করছে মালির জনগণের ভবিষ্যৎ।
আমরা জানি, ২০১২ সালে এক অভ্যুত্থানের পর আফ্রিকার এই দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন কাজ শুরু করে। উত্তর মালির তুয়ারেগ অঞ্চলের জনগণের তীব্র বিদ্রোহের মুখে পড়ে রাজধানী বামাকোতে যখন সামরিক অভ্যুত্থান ছড়িয়ে পড়ে, সে সময় ইসলামি জিহাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করার অজুহাতে মালিতে সেনা পাঠায় ফ্রান্স, যারা কিনা মালির সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক। পরবর্তীকালে জাতিসংঘ মিশনের মধ্যস্থতায় আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের উপস্থিতিতে ২০১৫ সালের জুনে মালিয়ান সরকার, দেশের উত্তরাঞ্চলের সরকার সমর্থক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জোট ও অন্য আকেটি বিদ্রোহী জোট আলজিয়ার্স শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এভাবেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলে আসছিল মালি। এই অর্থে বলা যায়, শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রত্যাহারের ঘোষণায় স্বভাবতই ‘নতুন অনিশ্চয়তা’র মধ্যে পড়ে গেল মালি!
আল জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ‘শান্তিরক্ষা মিশন হয়তো সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে শতভাগ ভূমিকা রাখতে পারেনি; তবে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমিয়ে রাখতে কিংবা কঠোর ও সর্বাত্মক সহিংসতা থামিয়ে রাখার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মিশনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্ববহ।’
একটা সময়ে এসে আমরা দেখেছি, আলজিয়ার্স চুক্তি একটু একটু করে ‘অকার্যকর’ হয়ে পড়ে। বিশেষত, ২০২০ সালে ইব্রাহিম বুবাকার কেইতার বিরুদ্ধে পরিচালিত এক অভ্যুত্থানের পর সামরিক শাসনের কবজায় চলে যায় মালি। এর পরে দিন যতই গড়িয়েছে, পশ্চিমাদের প্রতি কঠিন বিদ্বেষ পোষণকারী নেতাদেরই মালির নেতৃত্বের আসনে দেখা গেছে। যা হোক, মিশনের প্রধান এল ঘাসিম ওয়ানে সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘শান্তি রক্ষা মিশন তখনই বলবৎ রাখা যায়, যখন সংশ্লিষ্ট দেশের তাতে সম্মতি থাকে। এখন যেহেতু মালি চাইছে না যে, শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে যাক, সুতরাং অবশ্যই এখানে আর অপারেশন চালানো সম্ভব নয়।’
একটা বিষয় পরিষ্কার, মস্কোর সঙ্গে যেখানে বামাকোর অংশীদারিত্ব ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে, সেখানে পশ্চিমবিরোধী মনোভাব ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। শুধু মালি নয়, প্রতিবেশী বুরকিনা ফাসোও আছে এই তালিকায়। এসব অঞ্চলে পশ্চিমবিরোধী মনোভাব তীব্রতর হচ্ছে। অন্যদিকে, এসব এলাকায় সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে যাচ্ছে রাশিয়া। মজার কথা হলো, মালির হানাহানি বন্ধে জাতিসংঘ কিংবা পশ্চিমা বিশ্বকে ‘অযোগ্য’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হলেও একটি বিষয়কে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে! মালির মাটিতে ওয়াগনার সেনাদের পা পড়ার পর বহু বেসামরিক মানুষের প্রাণ ঝরেছে। এক হিসাব অনুযায়ী, কেবল গেল বছরেই ওয়াগনার ভাড়াটে ও মালিয়ান সেনাদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন পাঁচ শতাধিক মালিয়ান গ্রামবাসী! এটা যে ‘ইউক্রেনের বাইরে ক্রেমলিনে নিযুক্ত বাহিনীর নৃশংসতার আরেক নজির’Íএ কথা কে না বলেবে?
মালি আসলেই এক চোরাবালিতে আটকাতে চলেছে! শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রত্যাহার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ‘এক অনিশ্চিত’ ভবিষ্যতের পথে হাঁটা শুরু করল আফ্রিকার এই দেশ। এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে, ‘এর ফল হবে অত্যন্ত মারাত্মক!’ যেহেতু এই অঞ্চলে এখনো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর বিকল্প জুতসই কোনো ব্যবস্থার প্রবর্তন করা সম্ভব হয়নি, সুতরাং এটাই বাস্তবতা যে, ‘জাতিসংঘের প্রস্থানের ফলে মালির নিরাপত্তা এবং এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে।’ এমন আশঙ্কার সঙ্গে দ্বিমত করছেন না বিশ্লেষকেরাও! ( দৈনিক ইত্তেফাকের সৌজন্যে) লেখক :পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও লেখক ‘দ্য উইক’ থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন