বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০১ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
১৫তম জাতীয় সিনিয়র ক্লাব ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় শাম্মী সুলতানার তিনটি অনন্য রেকর্ড জনপ্রশাসন সংস্কারে নাগরিকরা মতামত দিতে পারবেন যেভাবে প্রফেসর তরুণ কান্তি বড়–য়ার রেক্টর পদে যোগদান উপলক্ষে শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময় সভা হাসিনার মতো ’৭১ সালে শেখ মুজিবও পালিয়ে ছিলেন: মির্জা ফখরুল মার্কিন নির্বাচনে লড়ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৬ প্রার্থী আগামী ২৬ নভেম্বর শুরু হচ্ছে পাঁচ দিনব্যাপী বহুমুখী পাটপণ্য মেলা বজ্রপাতে মাঠেই মারা গেলেন ফুটবলার মার্কিন নির্বাচন : কার জয়ে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কে কী প্রভাব পড়বে? ৮ গোপন আটককেন্দ্রের সন্ধান আরও ২৯ সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল

জেনিন ক্যাম্প! যেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর সাথে লড়াই করছে ফিলিস্তিনি তরুণরা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৭ জুলাই, ২০২৩

অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালিয়ে সৈন্য প্রত্যাহার করতে করতে শুরু করেছে ইসরায়েল। তাদের সৈন্যরা সেখানে ‘জেনিন ব্রিগেডসের’ সশস্ত্র ফিলিস্তিনি তরুণদের সাথে লড়াই করেছে। ফিলিস্তিনিদের বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ একত্রিত হয়ে এই জেনিন ব্রিগেড গড়ে ওঠেছে এবং এই গ্রুপটির ঘাঁটি জেনিন শহরের শরণার্থী ক্যাম্পে। জেনিন ব্রিগেডসে হামাস ও ইসলামিক জিহাদের মতো গ্রুপও রয়েছে। ইসরায়েলি সৈন্যরা রোববার (২ জুলাই) রাত থেকে শরণার্থী শিবিরের ওপরে আকাশ ও স্থলপথে আক্রমণ পরিচালনা করেছে।
কোথায় এই ক্যাম্প এবং কত বড়? শরণার্থী ক্যাম্পটি জেনিন শহরের ভেতরে। শহরটি অধিকৃত পশ্চিম তীরের একেবারে উত্তর অংশে। জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ ও কর্ম বিষয়ক সংস্থার হিসেবে ঘনবসতিপূর্ণ এই ক্যাম্পে থাকে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ। এর আয়তন আধা বর্গকিলোমিটারেরও কম। জেনিন শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। এই শহরের শরণার্থী শিবিরের লোকজন ইসরায়েলি অভিযানের মধ্যে আটকা পড়েছিল। ইসরায়েল বলেছে ফিলিস্তিনি ‘উগ্রবাদিদের’ টার্গেট করে তারা আক্রমণ পরিচালনা করেছে যারা ইসরায়েলি নাগরিকদের ওপর মাঝে মধ্যেই হামলা চালিয়ে থাকে। জেনিনে বিভিন্ন ফিলিস্তিনি গ্রুপ ইসরায়েলি বাহিনীকে প্রতিরোধের কথা ঘোষণা করেছে। এই শহরে রাজনৈতিক দল ফাতাহর সেক্রেটারি আবু রামেইলেহ বলেন, শরণার্থী শিবিরে যতগুলো গ্রুপ রয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণ থেকে ক্যাম্পকে রক্ষার জন্য তারা হাতে হাত মিলিয়েছে। তিনি বলেন, ফিলিস্তিন যোদ্ধারা আত্মসমর্পণের সাদা পতাকা না উড়িয়ে তাদের লড়াই অব্যাহত রাখবে।
বিভিন্ন গ্রুপ থেকে আসা এই যোদ্ধারা একতাবদ্ধ হয়ে নিজেদের নাম দিয়েছে জেনিন ব্রিগেডস। তাদের একতাবদ্ধ হওয়ার পেছনে কাজ করেছে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব প্রতিরোধের অঙ্গীকার। কেননা এ বিষয়ে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ওপর তাদের আস্থা নেই। জেনিন ব্রিগেডসের একজন যোদ্ধা টেলিগ্রাম গ্রুপে একটি অডিও বার্তা পাঠিয়ে বলেছেন, যোদ্ধাদের মনোবল অত্যন্ত চাঙ্গা এবং মৃত্যু পর্যন্ত তারা তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন।
কী হচ্ছে জেনিনে: গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জেনিন শহরে ও শরণার্থী ক্যাম্পে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। ওই শহরে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে ২০ জুন সাতজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। এই অভিযানে ইসরায়েলি সৈন্যরা সামরিক হেলিকপ্টারও ব্যবহার করে। এর পরদিন জেনিনের ২৫ মাইল দক্ষিণে এলি বসতির কাছে একটি পেট্রোল স্টেশন ও রেস্তোরায় হামাসের দু’জন বন্দুকধারীর গুলিতে চারজন ইসরায়েলি নিহত হয়।
এই ঘটনার পর শত শত ইসরায়েলি বসিত স্থাপনকারী প্রতিবেশী তারমুসায়া শহরের বাড়িঘরে ও বেশ কয়েকটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এই সহিংসতার সময় একজন ফিলিস্তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান।
এর কয়েক দিন পর জেনিন শহরে চালানো ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় তিনজন সশস্ত্র ফিলিস্তিনি নিহত হয়। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয় শহরের কাছে একটি তল্লাশি চৌকিতে বন্দুক হামলা চালানোর পর তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। বর্তমানে যে ইসরায়েলি অভিযান চলছে তাকে পশ্চিম তীরে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র জেনিন ক্যাম্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, এটি সন্ত্রাসবাদের ‘আখড়া’ হয়ে ওঠেছে। ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ স্টেহ ইসরায়েলের সবশেষ এই অভিযান সম্পর্কে বলেছেন,‘ক্যাম্পটিকে ধ্বংস করে দিতে এবং সেখান থেকে লোকজনকে সরিয়ে দিতেই এটা ইসরায়েলের নতুন চেষ্টা।’
কেন এই সহিংসতা: বিবিসির কূটনৈতিক সংবাদদাতা পল অ্যাডামস বলছেন, পশ্চিম তীরের মধ্যে জেনিন একটি জায়গা যেখানে নতুন প্রজন্মের ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে। তিনি বলেন,‘সশস্ত্র এই তরুণরা শান্তি প্রক্রিয়া কখনো দেখেনি। তারা মনে করে এই সঙ্কটের কূটনৈতিক সমাধানের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’ তিনি আরো বলেন,‘নিজেদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি তাদের কোনো রকমের আস্থা নেই। সেকারণে তারা মনে করে দখলদারদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র লড়াই করাই তাদের সামনে একমাত্র উপায়।’
ক্যাম্পের ইতিহাস: ১৯৪৮-৪৯ সালের যুদ্ধের সময় যেসব ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছিল তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য ১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে এই ক্যাম্পটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এই যুদ্ধ হয়েছিল ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে, যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা গণঅভ্যুত্থানের সময় এই ক্যাম্প তাদের লড়াই-এর কেন্দ্রে চলে আসে। ইসরায়েলি বাহিনী ২০০২ সালের এপ্রিলে সেখানে পুরো মাত্রায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করে যা ‘জেনিনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। দশ দিন ধরে এই অভিযান চলে। এর পরেই ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলে বেশ কয়েকটি আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। এসব হামলায় জেনিনের বহু তরুণ অংশ নেয়। ওই সময় অন্তত ৫২ জন সশস্ত্র ফিলিস্তিনি ও বেসামরিক ব্যক্তি এবং ২৩ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হয়।
পরিস্থিতি এখন, সংবাদদাতার চোখে: বিবিসি আরবি বিভাগের সংবাদদাতা আলা দারাঘমি বলেছেন, দু’বছর আগে তিনি যখন জেনিন শহরে যান, ওই সময় তিনি সেখানে কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীকে দলবদ্ধ হয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছেন। কিন্তু এখন তাদের সংখ্যা শত শত।
তিনি বলছেন, পশ্চিম তীরে গত কয়েক বছরে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ লড়াই খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একের পর এক তল্লাশি চৌকি পার হয়ে তিনি জেনিনে গিয়ে পৌঁছান। তিনি বলছেন ফিলিস্তিনিরা এখন মনে করে তাদের সামনে একমাত্র রাস্তা-লড়াই করা। তারা মনে করে যুদ্ধ না করলে ভবিষ্যতে তাদের কিছুই থাকবে না।
জেনিন শরণার্থী শিবিরের একজন বাসিন্দা আহমাদ জারাদাত তাকে বলেন, ক্যাম্পে যারা বসবাস করেন, ২০০২ সালের পর এ ধরনের অভিযান তাদের কেউ কখনো দেখেনি। আলা দারাঘমির একজন সহকর্মী সাংবাদিক এমান এরিকাত বলছেন শরণার্থী শিবিরে তিনি যে ধরনের বিমান হামলা ও বন্দুক-যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছেন, সেটা ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের ‘খারাপ দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা গণঅভ্যুত্থানের সময় ইসরায়েলি বাহিনী সেখানে এ ধরনের আক্রমণ চালিয়েছিল। ক্যাম্পের বাসিন্দা আহমাদ জারাদাত বলছেন, ‘অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে যোদ্ধারা রাতের বেলায় ঘুমাচ্ছে না। গোলাগুলি, বিস্ফোরণও বন্ধ হয়নি।, তিনি অভিযোগ করেন ইসরায়েল তাদের ক্যাম্পের অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করছে। জেনিন শহরের মেয়র নিদাল আল এবাইদি সাংবাদিকদের বলেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবারের অভিযানে শরণার্থী শিবিরটিকেই ধ্বংস করে ফেলতে চাইছে।
ফিলিস্তিনি তরুণরা কী বলছে: ফিলিস্তিনিদের দাবি অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি নির্মাণ বন্ধ করতে হবে।
বিবিসির সংবাদদাতা বলছেন, ইসরায়েলি আগ্রাসন প্রতিরোধে ফিলিস্তিনি তরুণরা এখন তাদের মা-বাবার চেয়েও অনেক বেশি বদ্ধপরিকর।
ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভ পার্টির প্রধান মুস্তাফা বারঘুটি বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনিরা মরিয়া হয়ে উঠছে।
তিনি বলেন,‘এই তরুণরা কেন সেই পথে যাচ্ছে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এর কারণ আমরা ৫৬ বছর ধরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দখলদারিত্বের মধ্যে বাস করছি এবং এই দখলদারিত্বের অবসানের জন্য বিশ্ব কিছুই করেনি… এই তরুণরা আশাহত হয়ে পড়ছে কারণ বিশ্ব সম্প্রদায় ইসরায়েলকে তাদের দখলদারিত্ব চালিয়ে যেতে দিচ্ছে।’
জেনিন শহরের বাইরে নাবলুস-ভিত্তিক আরো একটি গ্রুপ লায়ন্স ডেন জেনিন ব্রিগেডসের লড়াই-এর প্রতি সমর্থন জানিয়ে জেনিনের প্রতি সংহতি জানাতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। লায়ন্স ডেন বলছেন, তাদের একদল সদস্য ইসরায়েলি সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে জেনিনে গিয়ে পৌঁছেছে।
ইসরায়েলের বক্তব্য: ইসরায়েলি লিকুদ পার্টির একজন এমপি ড্যানি ড্যানন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্য করে কিছু করা হচ্ছে না।
বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘জেনিনে আমরা অল্প কয়েক ঘণ্টা অপারেশন চালিয়েছি এবং আমরা বাসিন্দাদের কাছে টেক্সট পাঠিয়েছি তারা যেন বাড়ির বাইরে না যায়। আমরা শুধুমাত্র জঙ্গিদেরই টার্গেট করছি।’
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জেনিনের শরণার্থী শিবির ‘অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ঘাঁটি’ হয়ে ওঠেছে। একই সাথে হয়ে ওঠেছে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের নিজের মধ্যে যোগাযোগের কেন্দ্র।
এর আগে ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে চালানোর হামলার জন্য ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জেনিনের যোদ্ধাদের দায়ী করেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেজর নির দিনা সাংবাদিকদের বলেছেন, জেনিন ক্যাম্প ‘সন্ত্রাসীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কয়েক সপ্তাহ আগেও জেনিন থেকে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপের চেষ্টা চালানো হয়েছে। এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলে রকেট পশ্চিম তীরের ভেতরেই পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা খুব উদ্বিগ্ন, কারণ এটাই যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠছে।’ সূত্র : বিবিসি




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com