কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুষ্কৃতকারীদের দুপক্ষের গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার (৭ জুলাই) ভোর ৬টার দিকে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্ট, ব্লক-বি-১৭-১৮ সংলগ্ন এলাকায় এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী।
নিহতরা হলেন, ক্যাম্প-৮ ওয়েস্ট এইচ-৪৯ ব্লকের আনোয়ার হোসেন (২৪), এ-২১ ব্লকের মো. জাকরিয়ার ছেলে মোহাম্মদ হামীম (১৬), ক্যাম্প-১৩ এর বি-১৭ ব্লকের আবুল বাশারের ছেলে নুরুল আমিন (২৪) ও ক্যাম্প-১০ এর এইচ-৪২ ব্লকের আব্দুল কাদেরের ছেলে মো. নজিমুল্লাহ। নিহত অন্যজনের পরিচয় তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়নি। গোলাগুলিতে আরও বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা দুষ্কৃতকারী গুরুতর আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ক্যাম্পসূত্র।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ এপিবিএন অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বলেন, ভোর ৬টার দিকে ক্যাম্পে রোহিঙ্গা দুষ্কৃতকারীদের গোলাগুলির খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এতে আহত হন অনেকে। তাদের উদ্ধার করে ক্যাম্পস্থ এনজিও হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আরও দুজনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। অভিযানের পর বিস্তারিত জানানো হবে। উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, গোলাগুলির খবর পেয়ে থানা পুলিশও ঘটনাস্থলে যায়। ক্যাম্পের গোলাগুলির স্থলে নিহত হয়ে পড়ে থাকাদের উখিয়া থানা পুলিশ উদ্ধার করে সুরতহাল তৈরির পর নিজেদের হেফাজতে নেয়। এরপর হাসপাতালে মারা যাওয়াদেরও একইভাবে নিয়ে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানোর কার্যক্রম চলছে। এর আগেও ক্যাম্পে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একইভাবে গোলাগুলিতে শতাধিক নিহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে ক্যাম্পের একটি মাদরাসায় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে একসঙ্গে ছয়জন নিহতের পর একসঙ্গে একজন দুজনের বেশি খুন হওয়ার ঘটনা ছিল না।
নিহত পাঁচজনই আরসার সদস্য দাবি করে ৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন ও মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ বলেন, গোলাগুলিতে ঘটনাস্থলে নিহত তিনজনের একজন আনোয়ার ছাদেক ছিলেন বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) এইচ-৪৯ ব্লকের প্রধান জিম্মাদার। নিহত নজিবুল্লাহ ছিলেন বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১০) আরসার ক্যাম্প কমান্ডার। আর নিহত নুরুল আমিন ছিলেন মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৩) বি-১৭ ব্লকের আরসার সক্রিয় সদস্য। নিহত অপর দুজন আরসা সদস্য বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধান চলছে।
আরসার সঙ্গে আরএসও-এর বিরোধ দীর্ঘদিনের উল্লেখ করে মো. ফারুক আহমেদ বলেন, আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার এবং পূর্বশত্রুতার জেরে দুই সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাস্থল থেকে এপিবিএন একটি ওয়ান শুটারগান ও একটি গুলি উদ্ধার করেছে। পাঁচজন হত্যাকা-ের ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্যাম্প এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালানো হচ্ছে।
গোলাগুলিতে একসঙ্গে পাঁচজন আরসা সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় আশ্রয়শিবিরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২) অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গার বসতি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন মাদক চোরাচালানের অন্যতম হোতা ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী বাহিনীর প্রধান নবী হোসেন। আরসাকে ঠেকাতে বছরখানেক আগে নবী হোসেনের সঙ্গে হাত মেলায় আরএসও। ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে নবী হোসেন বাহিনী ও আরএসও সমর্থক রোহিঙ্গা মাঝিদের অপহরণের পর হত্যাকা- ঘটিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে আরসা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ভোর পাঁচটার দিকে আরসার ২০-২২ জন সন্ত্রাসী বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) এইচ ব্লকের রোহিঙ্গা বসতিতে ঢুকে কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝিকে (নেতা) খুঁজতে থাকেন। এ সময় রোহিঙ্গাদের মধ্যে হইচই শুরু হয়। খবর পেয়ে আরএসও-এর ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী ঘটনাস্থলে পৌঁছে আরসা সদস্যদের ঘিরে ফেললে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যা আশ্রয়শিবিরের বি-১৫, বি-১৬ ও বি-১৭ ব্লক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
রোহিঙ্গা সূত্রে জানা যায়, গুলিতে নিহত আনোয়ার ছাদেক বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) এইচ-৪৯ ব্লকের প্রধান জিম্মাদার ছিলেন। ইয়াবা বিক্রির টাকা, চাঁদাবাজির টাকা, অস্ত্র–গোলাবারুদসহ লুণ্ঠিত মালামাল রক্ষিত থাকে আনোয়ারের হাতে। তাঁর নির্দেশে রোহিঙ্গা মাঝিদের অপহরণের পর টাকা আদায়, হত্যা ও হত্যার পরিকল্পনা হয়। দুই বছর আগে ক্যাম্প-৮ থেকে নবী হোসেন বাহিনীর হাতে বিতাড়িত হয়ে নিহত নজিবুল্লাহ আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১০)। কয়েক মাস আগে নজিবুল্লাহকে আরসার ক্যাম্প-১০–এর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁর অত্যাচার-নির্যাতনে ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারা অতিষ্ঠ ছিলেন।
বালুখালী আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা আবদুর রহিম বলেন, আরএসও-এর সঙ্গে গোলাগুলিতে আরসার পাঁচ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গারা চরম আতঙ্কে ভুগছেন। প্রতিশোধ নিতে আরসা যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরের সব কটিতে আরসার শক্ত অবস্থান রয়েছে। রয়েছে ভারী অস্ত্রশস্ত্রও।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, নিহত পাঁচজনের মধ্যে চারজনের পরিচয় শনাক্ত করেছে পুলিশ। অপর ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ১৬ জন আরসার সদস্য, একজন স্বেচ্ছাসেবক ও অন্য ব্যক্তিরা সাধারণ রোহিঙ্গা।