দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পালাক্রমে আমাদের শাসন ক্ষমতায়। তবে টানা প্রায় ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় বিরোধী দল বিএনপি এখন কোণঠাসা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর দলটি বেশ কয়েক বছর ধরে ছিল নির্জীব। গত বছরের অক্টোবর থেকে দলটি আবার ছন্দে ফিরতে শুরু করে। এখন নেতাকর্মীরা দারুণভাবে উজ্জীবিত। টানা কর্মসূচি পালনের পর গত ২৮ জুলাই বিএনপি রাজধানীতে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। প্রতিক্রিয়ায় সরকারি দলও একই দিন ‘শান্তি সমাবেশ’ ডাকে। তবে সমন্ত আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ দুটি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু গোল বাধে সমাবেশের পরদিন ২৯ জুলাই শনিবার ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি প্রতিহত করতে গিয়ে পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মী মিলে যেভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ চালানোর ফলশ্রুতিতে রাজনীতি আবার সহিংস হয়ে উঠছে। ২৮ জুলাই দুই দলের সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলেও আওয়ামী লীগের তিন সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত ‘শান্তি সমাবেশে’ অংশ নিয়ে ফেরার পথে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে সংঘর্ষকালে এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, শুক্রবার রাজধানীর গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের দুই নেতার অনুসারীর সংঘর্ষে নিহত হন পথচারী হাফেজ রেজাউল (২১)। তিনি শেরপুরের নকলা উপজেলার চর অষ্টাধর ইউনিয়নের নারায়ণখোলা পশ্চিমপাড়া গ্রামের কৃষক আবদুস সাত্তারের বড় ছেলে। রেজাউল ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে একটি মাদরাসায় দাওরা হাদিস বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
গত শুক্রবার সারা দিনই রোদ-বৃষ্টির খেলা চলেছে ঢাকার আকাশে। বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ। দুই দলের সমাবেশে, বিশেষ করে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্দীপনা নিয়ে যেভাবে অংশ নিয়েছিলেন, তাতে ওই দিন রাজনীতি জনমানুষের কাছে ফিরে এসেছিল, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু ১২ ঘণ্টা যেতে যেতে না যেতে রাজনীতি থেকে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অনুপস্থিত। সেই পুরনো চেহারায় ফিরে আসছে দেশের সঙ্ঘাতময় রাজনীতি। আপাতত রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান আলাপ-আলোচনার পরিবর্তে মাঠে চূড়ান্ত পর্যায়ে গড়াল। মাঠেই সমস্যার ফয়সালার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই দল। ফলে দিন যত যাবে রাজনীতির মাঠ অনিবার্যভাবে হয়ে উঠবে সঙ্ঘাতময়।
গত শনিবার ছিল মহড়া মাত্র। বিএনপির ওই অবস্থান কর্মসূচি এবং বিক্ষোভ দমনে পুলিশ কতটা পারঙ্গম, তার প্রদর্শনী দেখা গেল। আসলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ভিত শক্ত না করে রাষ্ট্র শক্তিশালী হলে তাতে যে জনগণ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে, সেই সত্যটি ফের সামনে চলে এসেছে।
এদিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় পুলিশের হামলায় আহত হন। আহতাবস্থায় ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে তাকে আপ্যায়নের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তোলে। একইভাবে আমান উল্লাহ আমানের সাথে পুলিশের বাগবিতন্ডা। ধস্তাধস্তির পর অসুস্থ হয়ে পড়া। পরবর্তীতে হাসপাতলে ভর্তি। তাকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি দলের দেখতে যাওয়া সোশ্যাল মিডিয়ার আলোচিত বিষয়। চলে সুলুক সন্ধান। যে যার মতো নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ওই সব ঘটনা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। অবশ্য, ওই দুই নেতা ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তাদের ভাষায়, ঘটনা দুটি সরকারের দিক থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। নি¤œ রুচির পরিচায়ক। দৃষ্টি ফেরাই ২৮ জুলাই, ২০২৩ তারিখের সমাবেশ দুটির দিকে। এতে একটি বিষয় স্পষ্ট, বাংলাদেশে রাজনীতিতে জিয়া পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের উত্তরাধিকার তারেক রহমানের রাজনৈতিকভাবে জোরালোভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার বিষয়টি। এটিই হলো রাজনীতিতে এখন বড় চমক। এখানে স্মরণযোগ্য যে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার বিধবা স্ত্রী ও তারেক রহমানের মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গৃহবধূ থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার ধারাক্রম। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে স্বৈরশাসকের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নিজেকে আপসহীন নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন তিনি। গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর দেশবাসীও খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্বের জন্য ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির বিজয়ে অনেকে স্তম্ভিত হন। সব রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ভুল প্রমাণিত হয়।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া সারা দেশে তুমুল জনপ্রিয় নেত্রী হিসেবে নিজের আসন পাকাপোক্ত করেন। তাই তো জিয়ার সাথে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাও বিএনপির ভরকেন্দ্র। কিন্তু এবার সরকার পতনের একদফা দাবিতে বিএনপি যে আন্দোলন গড়ে তুলেছে এবং এর একটি সফল পরিণতি চাইছে, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মা খালেদা জিয়ার মতো তারেক রহমানও কি জাতীয় না হলেও দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন? সাধারণ মানুষের কাছে তার নেতৃত্ব কি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে? এ প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, ২৮ জুলাই বিএনপির মহাসমাবেশে বিপুল লোকসমাগমের দিন অডিও ভাষণে তারেক রহমানের নেতাসুলভ বক্তব্য উপস্থিত জনতার মনে দাগ কেটেছে। বলে রাখা ভালো, ওই দিন বিএনপির কর্মসূচির প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম ও সহযোগী তিন সংগঠন আয়োজিত ‘শান্তি সমাবেশেও’ তারেক রহমান ছিলেন প্রধান প্রতিপক্ষ। তাকে নিশানা করে বর্ষিত হয় যত বাক্যবাণ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক, ক্ষমতাসীনদের ভাষায় আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসিত একজন ব্যক্তিই এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব। বিএনপির অনেক নেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, সুদূর লন্ডনে অবস্থান করলেও তারেক রহমান দলের তৃণমূলের নেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। সেখানে বসে দেশে দলীয় কর্মসূচির সবকিছুর দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। রাজনীতি সচেতনদের মনে থাকার কথা, অনেক দেশের অনেক নেতাই নির্বাচিত হয়ে দেশের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিলেন। বিশ্ব ইতিহাসে এমন নজির কম নয়। সেখানে কি তারেক রহমানের নাম সংযোজিত হতে যাচ্ছে? এমন মনে হওয়ার কারণ, জুলাইয়ের ২৮ তারিখে নয়াপল্টনের সমাবেশে অংশ নেয়া নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের আবেগী আচরণে লুকিয়ে রয়েছে। এ আবেগের একটি বর্ণনা সহযোগী এক জাতীয় দৈনিকের সরেজমিন কলামে উঠে এসেছে।
সেই লেখায় উল্লেখ করা হয়, “সমাবেশের শেষ দিকে বিএনপি মহাসচিব তার বক্তব্যের মাঝামাঝি বলে ওঠেন, ‘প্রিয় দেশবাসী, প্রিয় উপস্থিত বন্ধুগণ, আপনাদের জন্য আজকে একটি চমক আছে। এখন আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান।’ আমার পাশে বসেছিলেন বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। আরেক পাশে খানিক দূরে আরো কয়েকজন সাংবাদিক সহকর্মী। সবার চোখে-মুখে অবিশ্বাস! চারদিকে উল্লাস! চিৎকার! এরই মাঝে একটি কণ্ঠ শোনা গেল, ‘প্রিয় বাংলাদেশবাসী … আসসালামু আলাইকুম।’ মুহূর্তেই চারদিকের জনতার মধ্যে যেন কী একটা ঘটে গেল! সবাই দুই হাত তুলল। শূন্যে লাফ দিল কেউ কেউ; কেউ কেউ পাশে দাঁড়ানো আরেকজনকে জড়িয়ে ধরল! এ এক অভাবনীয় দৃশ্য! এরই মাঝে দেখলাম এক বয়স্ক লোক পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখ মুছছেন। কী ব্যাপার! তিনি চোখ মুছলেন কেন? কাঁদছেন কেন? এগিয়ে যেতেই দেখা গেল সামনের পাটির দাঁত পড়ে যাওয়া বৃদ্ধ ‘তারেক রহমান’ নাম উচ্চারণ করছেন আর নিজের চোখ মুছছেন। এমন পরিস্থিতিতে কারো সাথে কথা বলা যায় না। সরে দাঁড়ালাম। তারেক রহমান তার বক্তব্য শেষ করলেন। নতুন বাংলাদেশে দেশবাসীর সঙ্গে দেখা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন” (সমকাল, ২৯ জুলাই, ২০২৩)।
প্রিয়, পাঠক উপরের বর্ণনা থেকে যদি কারো মনে এ ভাবের উদয় হয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমান এখন কেবলমাত্র প্রসঙ্গিক হয়ে ওঠেননি; ২৮ জুলাই রীতিমতো মায়ের মতো নেতৃত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। ওই দিন তার রাজনৈতিক অভিষেক হয়েছে- তাহলে ওই ব্যক্তির ভাবনা কি খুব ভুল বলা যাবে? এটাই আপাতত দেশীয় রাজনীতিতে বড় চমক। অবশ্য, তারেক রহমানের এই অভিষেক কম্বোডিয়ার নির্বাচন-উত্তর হুন সেনপুত্র হুন মনের মতো নয়। হুন মনে তার বাবা একনায়ক হুন সেনের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন; যিনি দেশটিতে টানা ৩৮ বছর ধরে ক্ষমতায়। এবার পুত্রের হাতে তা অর্পণ করে অবসরে যাচ্ছেন। ইমেইল:camirhamza@yahoo.com