রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৪৮ পূর্বাহ্ন

॥ মায়ের ডাক ॥

হারুন ইবনে শাহাদাত
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০২৩

ছোটগল্প

অ্যাকশন বিগ.. রেডি সুন..
: ওকে বস।
: লোকেশন .. টাইম প্লিজ
: ফলো জিপিআরএস..
: ওভার..
স্মাটফোনের টেলিগ্রাম অ্যাপে রাকিব আর গ্যাং লিডার আনিসের কনভারসেশন শেষ হলো।
ওদের গ্যাং এর নাম চিপা মাইর। গ্যাং লিডার আনিস। কিন্তুু … না। গ্যাং এ আনিস নামের কেউ নেই। নেই রাকিব নামেরও কেউ। মা-বাবার দেয়া সুন্দর নামগুলো সব বদলে কিশোর গ্যাং এ নতুন নতুন নামে তৎপর ওরা। গ্যাং লিডার আইজ্যাক বস্ । সবাই বস্ বলেই ডাকে আনিসকে। রাকিবকের গ্যাং নেম রবিন হুড। আরো আছে তারিক মানে টারজন, প্রতুল চন্দের নাম প্রতাভ সিংহ নামে সিংহ। ছাত্র হিসেবে কেউ খারাপ নয়। তবে বইয়ের পড়ার চেয়ে বেশি মনোযোগ চ্যাটিং আর ফাইটিং এ। বস্রে ওপরেও আছেন বড় ভাই সবচেয়ে বড় বস্। তিনি এলাকার বড় নেতা। নাম বলা নিষেধ। তার সাথে শুধু গ্যাং লিডার আইজ্যাক বস্ই যোগাযোগ করতে পারে। গ্যাং চালাতে যা লাগে সব ঐ বড় ভাই সাপ্লাই দেন। মানি,পানি মোটরসাইকেল,কার,দেশি নাট-বল্টু, বিদেশি মাল যা চাই।
: বস লোকেশন আন সিন
: ওকে, জিপিআরএস অপ.. সো স্পট ওয়ান কাম সুন

১৫ মিনিটের মধ্যে রবিন হুড স্পট ওয়ানে হাজির হয়। টারজন আর সিংহ এখনো আসেনি। সুদীপ মানে সুপারম্যানেরও দেখা নেই। বস রবিন হুডের দিকে সিগারেট এগিয়ে দেয়।
: না, আমার মাথা ঘুরে।
: নামেই রবিন হুড তুই, আসলে একটা গারল বুড্ডু। অপারেশনের আগে প্রতি টানে সাহস বাড়ে..
: বস, আমার সাহস এমনি অনেক
: মুখে মুখে কথা, বিদেশি মালটা কিন্তু সাথেই আছে, এক্কে বারে ফুটা কইরা দিবো
: ঠিক আছে।
রবিন হুড আর কথা বাড়ায় না। বস্রে হাত থেকে সিগারেট নিয়ে, হাল্কা করে কয়েক বার টান দিয়ে ফেলে দেয়।
: আরে বড় ভাইয়ের কাছে গেলে তো..
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই সিংহ ও সুপারম্যানের আগমন ঘটে। অতএব আর দেরি নয়। শুরু হয়,অপারেশনের প্ল্যান।
: বস, বলেন জরুরি তলবের কারণ কী?
: সবাই মন দিয়ে শোন, একটা পোলা বাড় বাড়ছে, ছাইট্টা দিবে হবো।
: ছিপা মাইর না ফাইনাল? সিংহ জানতে চায়।
রবিন হুডের প্রশ্ন: কোন পোলাটা?
গম্ভীর গলা আদেশ দেয় বস্: অন টেলিগ্রাম, ছবি সবাইকে পাঠানো হয়েছে।
ছবি দেখে টারজেনের কপালে ভাঁজ পড়ে সে স¦গতভাবে বলে:‘এই পোলা, নামাজি, ভালো ছেলে।’ কিন্তু উচ্চারণের সাহস পায় না।
মুখ খুলে রবিন হুড: তা পোলাটা কি করছে, বস্?
: আমার গ্যাং-এ ওরে চাই। কিন্তু পাত্তা দেয় না..
বস্রে কথা শেষ হতেই টারজেন বলে: ওই তো মেসে থাকে গাইয়া পোলা। নামাজি ওরে দিয়ে কী হবে? ওর নাম শাহীন।
: ‘বড় ভাই চায়। মেসের পোলা-পাল গ্যাং এ থাকা ভালো। পিছুটান নেই। বেশি কাজে লাগানো যায়। কিন্তু ব্যাটা আমারে পাত্তা দেয় না।’ রাগের সাথে বলে বস্।
রবিন বলে: কি কয়?
: পড়া-লেখা ছাড়া অন্য কিছু করার তার নাকি সময় নাই।
: ‘তা এখন আমাদের কাজটা কি?’ টারজেন প্রশ্ন করে
: চিপা মাইর দিয়ে রাজী করাতে হবে,
সিংহ বলে; তবে চল
: ‘আস্তে আস্তে। আগে রেকি করতে হবে। কোন সময় ওরে ধোলাই দিলে কাক পক্ষী টের পাবে না।’ ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে বস্।
: ‘তা রেকি করার কাজটা করবে কে?’ জানতে চায় টারজেন
: ‘তুই করবি।’ দাঁতে মুখ চেপে উত্তর দেয় বস্। তারপর মিটিং শেষে যে যার পথে চলে যায়।

টারজেন যতই ওর কাছাকছি হচ্ছে। ততই বদলে যাচ্ছে। তার মন কিছুতেই মানতে চাচ্ছে না। শাহীনের মতো একটা ছেলেকে চিপা মাইর দিতে। সারা দিনের কাজ-কর্ম আর লেখাপড়া দেখে ওর মনটা শাহীনের জন্য নরম হয়। সে একদিন শাহীনের মেসে যায়।
: ‘আস সালামু আলাইকুম।’ বলে শাহীন টারজেনকে বসতে হবে। তারপর জানতে চায়
: কী ব্যাপার হঠাৎ
টারজেন বলে: তেমন কিছু না, এমনি দেখতে এলাম।
: ভালো। বসো মায়ের পাঠানো মুড়ির মোয়া আর নারকেলের পিঠা খাও। খুব মজা।
: না না । ওসব আমি খাই না।
: ‘আরে খাও। তোমাদের পিৎজা, বার্গারের চেয়ে খারাপ লাগে না।’ বাটিতে কয়েকটি পিঠা ও মোয়া ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়। ইচ্ছা না থাকলেও টারজেন মুখে দিয়ে বলে: বা খুব মজা মতো? তুমি পড়া লেখা পর কি কর?
: দুই জন ছাত্র পড়াই।
: কত টাকা পাও?
: এই আট হাজার?
: বাড়ি থেকে টাকা দেয় না?
: সব সময় পারে না। আমার বাবা কৃষক। ফসল ভালো হলে, বিক্রি করে টাকা দেয়। বন্যা খরা হলে পারে না। ফসলের দাম কম হলেও কষ্ট হয়। তাই..
: নিজের খরচ নিজেই চালাও। ভালো। আজ আসি আবার আসবো।

চিপা মাইর কিশোর গ্যাং-এ সদস্য আরো বেড়েছে। তাতে কি। শাহীনকে তারা পাচ্ছে না। পোলাটা কোন কথাই শোনো, টাকা দিতে চাইলে কয় মাস্তানি,চাাঁদাবাজির টাকা হারাম। তাই আনিস, মানে বস্রে মাথা ঠিক নেই। বড় ভাইয়ের এক কথা ওরে গ্যাং এ শাহীনকে নিতেই হবে। কিন্তু পোলাটার এককথা লেখা-পড়া করতে গ্রাম থেকে এসেছে। মাস্তানি করতে না। আনিস আবার সবাইকে ডাকে। টেলিগ্রামে ম্যাসেজ পাওয়া সাথে সাথে সবাই ্স্পট টু-তে হাজির। ওরা ঘন ঘন স্পট বদলায়। বড় ভাইয়ের নির্দেশ, এক স্পটে বেশি সময় থাকতে নেই। পুলিশ ঝামেলা করতে পারে।
আনিস বলে: শোন আজ ওরে ধরে স্পট ওয়ানে আটকিয়ে ধোলাই দিয়ে রাজি করাতে হবে।
: ‘ঠিক আছে, বস্।’ টারজেন ছাড়া সবাই জোরে-শোরে বলে। তারপর সবাই অপারেশনের জন্য তৈরি হয়। ওদের এই অপারেশনের নাম ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’। সংক্ষেপে ‘মাও নাই’।
টেলিগ্রামের ম্যাসেজ অপশনে ঝড় শুরু হয়:
: ‘মাও নাই’, খিলক্ষেত..
: ওকে
:টাইম ১৯:৪৫
: ওকে
: অনলি নাট বল্টু, নো মাল
: ‘ওকে, মাও নাই গেঁয়ো,, নো নিড মাল নাট-বল্টু এনাপ।’ যথাসময়ে দেশি হাল্কা অস্ত্র নিয়ে ওরা সবাই হাজির। কারণ ওরা জানে নাট-বল্টু মানে দেশি অস্ত্র। আর মাল হলো বন্দুক, পিস্তল।
সন্ধ্যা রাতের টিউশনি শেষে বের হওয়ার সাথে সাথে শাহীনের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকে টারজেন। তারপরও একটি নির্জন স্থানে এসে বাকীরা তর্ক জুড়ে দিয়ে মারতে শুরু করে। জায়গাটা নির্জন। তাই কেউ এগিয়ে আসে না। শাহীন জ্ঞান হারালে একটা রিকসা ডেকে। ওকে তুলে স্পট ওয়ানে নিয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এমন সময় শাহীনের পকেটের মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। প্রথমে ফোনটা কেউ ধরতে চায না। পরে ইচ্ছা না থাকলেও আনিস ফোনটা ধরে। ওপার প্রান্ত থেকে একটি মেয়েলি কণ্ঠস্বর:‘বাবা,শাহীন, শাহীন। আমি তোমার মা বলছি। কথা বল বাবা। রাগ করেছিস না। তোর বাবা টাকা পাঠাতে পারেনি বলে, রাগ করিস, না বাবা। ধান ওঠলেই টাকা পাঠাবে। ভালো করে লেখা পড় করবি। নামাজ -কালাম পড়বি। খারাপ ছেলেদের বন্ধু বানাবি না, বাবা। লেখা পড়া শিখে তোকে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে.. ।’ আনিস কি করবে বুঝতে পারছে না, শাহীনের মায়ের মায়াবি কণ্ঠ শোনে তার চোখে পানি আসে, বলে: ‘আমি ভালো আছি মা, পরে কথা বলবো।’ ফোনটা কেটে দেয়।
আনিসের মা ওদের ছেড়ে চলে গেছে, সেই শৈশবে। বাবার সারাদিন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন। ওর মা ওর বাবাকে ছেড়ে বাবার বন্ধু সুজন সাহেবকে বিয়ে করে পাড়ি জমিয়েছেন আমেরিকা। ক্যানিসো ক্লাব আর আড্ডা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, জন্মদিনে রুটিন উইস ছাড়া ফোন করার সময় পান না। তাও মনে হয় সিগারেট নয় তো নেশায় বুদ হয়ে আছেন। মায়েরা এমন মায়াবি ভাষায় কথা বলেন .. আনিস আর ভাবতে পারে না। শাহীনকে আর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতেই হবে। সে তার গ্যাং বস্ পরিচয় ভুল যায়। ফিরে আসে তার কৈশোরদীপ্ত নতুন জীবনে। বন্ধুদের ডেকে বলে: তারেক, প্রতুল,রাকিব,সুদীপ্ত, হারি আপ অ্যাম্বুলেন্স । অ্যাম্বুলেন্স । শাহীনকে বাঁচাতে হবে ওর মা ডাকছে..




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com