(ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দেশের একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা ছাড়াও নানা বিষয়ে তাঁর আগ্রহ আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন। ছবি আঁকেন, গানও গান। আজ অবশ্য তিনি গান বা আঁকা ছবি নিয়ে কোনো লেখা দেননি, তার পরিবর্তে ছোট একটি গল্প পোস্ট করেছেন। এর পেছনের গল্পটা জানার আগে বরং পোস্ট করা গল্পটা আগে পড়ি। গল্পটি দৈনিক প্রথমআলোর অন্য আলোর অন লাইন ভার্সন থেকে সংকলিত)।
‘রাত দুটো বাজে প্রায়। টেলিফোন বেজেই চলছে। থানার ওসি সাহেব শেষে বিরক্ত হয়ে বিছানার পাশে রাখা ফোন ধরলেন।
– হ্যালো
– স্যার, আপনার সঙ্গে আমার এখুনি একবার জরুরি দেখা করতে হবে।
– পাগল হয়েছ, আর সময় পেলে না।
– স্যার, এখুনি না এলে কাল হয়তো আমার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে যাবে। আমার গরিব পরিবারের প্রতি সেটা খুব অবিচার হবে। বাড়িতে গিয়ে পুলিশ ঝামেলা করবে। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ, আমার কাছে যে প্রমাণ আছে, তা একবার দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন।
– কিসের কেস তোমার বিরুদ্ধে?
– আজ একটা রাজনৈতিক সহিংস ঘটনার মামলার কথা আপনি জানেন। অনেকের সঙ্গে নাকি আমাকেও আসামি করা হয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস করেন স্যার, ওই কথিত ঘটনাস্থলের কাছেধারেও আমি ছিলাম না, আমার কাছে তার প্রমাণ আছে।
– এ তো ভালো জ্বালাতন দেখি, রাতদুপুরে আর কাজ পেলে না। আচ্ছা, কাল সকালে থানায় এসে তোমার কাগজপত্র জমা দিয়ে যেয়ো।
– দিনের বেলায় তো আমি আসতে পারব না স্যার।
– আর বাজে বকতে পারব না, আমি ফোন রাখলাম।
– একটু শুনুন স্যার, আমি অনেক দূর থেকে এসেছি, আপনার দরজার সামনেই আছি।
– কি আশ্চর্য, তোমাকে গেটের গার্ডরা ঢুকতে দিয়েছে!
– ওরা আমাকে দেখতে পায়নি। স্যার, অনেক কষ্ট করে এসেছি, হাড় ঠক ঠক করে শীতে কাঁপছি।
– এই গরমে শীতে কাঁপছ মানে কি! পাগলের পাল্লায় পড়া গেল, তোমার কাগজপত্র গার্ডদের কাছে দিয়ে বিদায় হও।
– না স্যার, এত দূর এলাম, আপনার হাতেই দিতে চাই। আর আপনার সঙ্গে একটু দেখা করাও জরুরি।
– কিসের এত মূল্যবান কাগজপত্র তোমার?
– ছয় মাস আগের আমার ডেথ সার্টিফিকেট। আমি ঘরে ঢুকছি স্যার।
ওসি সাহেবের মনে হলো ঘরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে।’
গল্প শেষ। পড়েই ইনবক্সে একটা বার্তা লিখে জানতে চাইলাম পেছনের গল্পটা কী। অল্প কথায় বললেন, ‘চারপাশের রাজনৈতিক ঘটনাবলির কথা মনে করলে একটা “কাফকা অনুভূতি”(শধভশধবংয়ঁব ভববষরহম), অর্থাৎ এসব কিছুকে অসংগতিপূর্ণ, উদ্ভট, অযৌক্তিক, অতিপ্রাকৃত মনে করার অনুভূতি হতেই পারে।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অবশ্য পাঁচ দিন আগে আরেকটি লেখা প্রকাশ করেছিলেন। সেখান থেকে কিছু অংশ উল্লেখ করলে প্রেক্ষাপট বুঝতে সহজ হবে। তিনি লিখেছিলেন,
‘আজকাল পত্রিকার খবরে মন ভালো করার মতো তেমন কিছু পাই না। তাই মাঝে মাঝে ব্যাপারগুলোকে লঘুভাবে দেখার জন্য উদ্ভট সব চিন্তা মাথায় আসে। যেমন দেখলাম এক তথাকথিত গায়েবি মামলায় মৃত মানুষের নাম নাকি আসামির তালিকায় আছে। সংশ্লিষ্ট পরিবারের জন্য তো এটি একটি নিদারুণ অন্যায় আচরণ বটেই, কিন্তু ভাবছি পুলিশ যদি আসলেই মামলাটি গ্রাহ্য করে আসামিকে রিমান্ডে আনার চেষ্টা করে, তাহলে?
পত্রিকার অন্য এক খবরে দেখলাম, এক মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী কর্মী কয়েক বছর ধরে দেশে আসতে পারছেন না। কারণ, তিনি ইতিমধ্যে পুলিশের করা রাজনৈতিক সহিংসতার একটি মামলার আসামি। যদিও ওই সহিংসতার ঘটনার সময় তিনি তাঁর বিদেশের কর্মস্থলে ছিলেন। তাঁর এক আত্মীয় সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, কিন্তু এ কারণেই তাঁকে আসামি করা হয়েছে কি না, সেটা নিয়ে তাঁর আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে চেষ্টা করেও নাকি কোনো সদুত্তর পাচ্ছেন না।
বিখ্যাত জার্মানভাষী সাহিত্যিক ফ্রানৎস কাফকার অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য ট্রায়াল’-এর গল্পের সঙ্গে এর বেশ মিল আছে। গল্পের প্রধান চরিত্র দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের নি¤œ আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি অনেক চেষ্টাতেও সে বিচারককে খুঁজে পাচ্ছেন না এবং অনেক অফিস-আদালতে ঘোরাঘুরি করেও কী অপরাধের জন্য তাঁর বিচার হয়েছে, তা জানতে পারছেন না।’