সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৩ পূর্বাহ্ন

চৌরঙ্গী

শংকর
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০২৩

(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
(পূর্ব প্রকাশের পর)
হোটেল-কলেজ থেকে পাস করে পিতৃমাতৃহীন নিঃসঙ্গ মার্কোপোলো চাকরির সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। পাস করলেই কিছু বড় চাকরি পাওয়া যায় না। অনেক নিচু থেকে আরম্ভ করতে হয়। আর কাজ শিখতেও সময় লাগে। হোটেলের লোকেরা বলেন, কিচেন জানতেই পাঁচ বছর লাগে। দু বছর শুধু মদের নাম-ধাম এবং জন্মপঞ্জী কণ্ঠস্থ করতে। অরাও দু বছর হিসেব-নিকেশ শিখতে। তারপর বাকি জীবনটা মানব-চরিত্রের রহস্য বুঝতে বুঝতেই কেটে যায়।
মার্কোপোলোর চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। চাকরির ধাপে ধাপে উঠতে উঠতে মার্কোপোলো একদিন কলকাতায় হাজির হলেন। যে-হোটেলের আন্ডারম্যানেজার হয়ে তিনি এখানে এসেছিলেন, অনন্ত-যৌবনা কলকাতার বুকের উপর সে-হোটেল এখনও নিয়ন ও নাইলনের ভিড়ে উচ্চকিত হয়ে রয়েছে।
ধর্মভীরু এবং কৃতজ্ঞ মার্কোপোলো তার জীবনদাতা রোমান ক্যাথলিক ফাদারদের ভোলেননি। প্রতি রবিবারে শত বাধা সত্ত্বেও চার্চে গিয়েছেন; তাঁর জীবন রক্ষার জন্য পরম পিতার উদ্দেশে শত-সহস্র প্রণাম জানিয়েছেন। সময় পেলে ওরই মধ্যে ট্রেনে করে ব্যান্ডেল চার্চে পর্যন্ত হাজির হয়েছেন।
ভার্জিন মেরীর মূর্তির সামনে রঙিন মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেছেন। হোটেলে থেকে এবং বার-এর তদারক করে যে জীবনের মধ্যে তিনি ঢুকে পড়তে পারতেন, তার থেকে মার্কোপোলো নিজেকে সর্বদা সযতেœ দুরে সরিয়ে রেখে দিয়েছেন।
ওই সময়েই একজন মিস মনরোর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। নিজের হোটেলের হই-হই হট্টগোল থেকে খানিকক্ষণ শান্তি পাবার জন্য মার্কোপোলো পার্ক স্ট্রিটের একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় রাত্রে খেতে গিয়েছিলেন। ওইখানেই সুশান মনরো গান গাইছিল।
মার্কোপোলোর গল্প বলতে বলতে বায়রন সায়েব এবার একটু থামলেন। টেবিল থেকে অ্যাটাচি কেসটা টেনে এনে, একটা পুরনো খবরের কাগজের টুকরো তার ভিতর থেকে বার করলেন। টুকরোটা সযতেœ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি তো অনেক জায়গায় ঘোরো। এই মেয়েটিকে কোনোদিন কোথাও দেখেছ?
জীবনে যত বিজাতীয় মেয়ে দেখেছি, তাদের সঙ্গে ছবিটা মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই অমন কাউকে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না।
বায়রন বললেন, অনেক কষ্টে ছবিটা স্টেটসম্যান অফিস থেকে জোগাড় করেছি। সেই সময় একদিন রেস্তোরাঁর মালিক কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সেই সংখ্যাটা টাকা দিয়ে কিনতে হল।
এই পুরনো খবরের কাগজ থেকে সুশান মনরোর সমস্ত রূপটা মানসপটে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। ভদ্রমহিলা দেখতে এমন কিছু সুন্দর ছিলেন না, বায়রন সায়েব বললেন।
কিন্তু মার্কোপোলোর মনে হল, মৃদুলতার একটা ছন্দিত ভঙ্গি যেন তার চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে।
ডিনার বন্ধ করে মন দিয়ে সুশান মনরোর গান শুনলেন মার্কোপোলো। গান শেষ হলে নিজের টেবিলে গায়িকাকে নিমন্ত্রণ করলেন।
কেমন গান শুনলেন? মিস মনরো ওঁর টেবিলের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করলেন।
চমৎকার! একদল বিশিষ্ট অন্ধ অতিথির সামনে, আপনি যেন অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের এক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন।
মেয়েটি হাসল। আস্তে আস্তে বললে, কী করব বলুন, সমজদার শ্রোতা কোথায় পাব?
এই শহরের সব লোক কি কালা? মার্কোপোলো হেসে জিজ্ঞাসা করলেন।
কালা, কিন্তু কানা নয়! চোখটা খুব সজাগ, দৃষ্টি খুবই প্রখর। এখানকার রেস্তোরাঁ মালিকরা তা জানেন, তাই শ্রোতব্য শব্দ থেকে গায়িকার দ্রষ্টব্য অংশের উপর বেশি জোর দেন।
দুজনের জন্যে দু বোতল বিয়ারের অর্ডার দিয়ে, মার্কোপোলো হেসে ফেলেছিলেন। মেয়েটিকে বলেছিলেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনি চমৎকার গাইতে পারেন; ইউরোপে এমন গান গাইলে আপনার কদর হত!
আপনাদের হোটেলে কোনো সুযোগ পাবার সম্ভাবনা আছে? মিস মনরো এবার জিজ্ঞাসা করলেন।
মার্কোপোলো চমকে উঠলেন, আমাকে চেনেন আপনি?
করুণ হেসে মেয়েটি বললে, ছোট জায়গায় গান গাই বলে, বড় জায়গার খবর রাখব না?
মার্কোপোলো এবার মুষড়ে পড়লেন। গভীর দুঃখের সঙ্গে বললেন, কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আমাদের হোটেল যারা চালান এবং সেই হোটেলে যাঁরা আনন্দ করতে আসেন, মেম্ ইন ক্যালকাটা কোনো জিনিসের সঙ্গেই তারা সম্পর্ক রাখেন না। আমাদের হোটেলে নাচবার জন্যে, গাইবার জন্যে যাঁরা আসেন, তাঁরা মে ইন ইউরোপ, কিংবা মে ইন ইউ-এস-এ। এমন কি, মেম্ ইন টার্কি বা ইজিপ্ট হলেও তাদের আপত্তি নেই; কিন্তু কখনই কলকাতা নয়।
মেয়েটি গান গাইবার জন্য আবার উঠে পড়েছিল। বিয়ারের বোতল দুটো সরিয়ে রাখতে রাখতে বলেছিল, আপনার কোয়ায়েট ডিনারের যদি কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করে থাকি, তবে তার জন্যে ক্ষমা করবেন।
মার্কোপোললা সেইদিনই তার মধ্যবিত্ত হৃদয়টি পার্ক স্ট্রিটের অখ্যাত সুশান মনরোর কাছে বন্ধক দিয়ে ফেলেছিলেন।
পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় তাঁদের দুজনের আবার দেখা হয়েছে।
মার্কোপোলো সুশান মনরোর মনের ভিতর ঢোকবার চেষ্টা করেছেন। আপনি কোনোদিন কোনো ইস্কুলে গান শেখেননি? বলেন কী? র নেচার। নিজের খেয়ালে নেচার এমন সংগীতের কণ্ঠ সৃষ্টি করেছে? মার্কোপোলো অবাক হয়ে গিয়েছেন।
শিখব কোথা থেকে? গানের ইস্কুলে যেতে গেলে তো পয়সার দরকার হয়, সুশান বলেছিল।
মার্কোপোলো ক্রমশ সব শুনেছিলেন। প্রথমে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয়, পরে সুশানের ঘরে বসে মার্কোপোলো শুনেছেন, সুশানের ভাগ্য অনেকখানি মার্কোপোলোর মতো। বাবা-মা কেউ ছিল না। এ-পি-সি-আই মানুষ করেছিল। অনাথা মেয়েকে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলবার জন্যে ওঁরা কোনোরকম কার্পণ্য করেননি। সাবালিকা হয়ে সুশান নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছে। প্রথমে নিউ মার্কেটের কাছে এক সুইশ কনফেকশনারির দোকানে কেক বিক্রি করত। কিন্তু গানের নেশা। প্রচারের লোভ। বিনা পয়সায় রাত্রে রেস্তোরাঁয় গান গাইতেও সে প্রস্তুত।
অনেক কষ্টে সুশান এইখানে ঢুকেছে। প্রথমে বেশ কষ্ট হত। সারাদিন দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেক বিক্রি করে, সোজা এখানে চলে আসতে হয়। এখানেই জামাকাপড় বদলিয়ে সে তৈরি হয়ে নেয়; বাড়িতে ফিরে যাবার সময় থাকে না। অথচ এমন প্রমোদনিকেতন যে লেডিজ টয়লেট-এর কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন চাপরাশিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে বারোয়ারি ল্যাভেটরি ব্যবহার করতে হয়। দুর্গন্ধে মাঝে মাঝে বমি হয়ে যাবার অবস্থা হয়।
এরা তোমায় কিছুই দেয় না? মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেছেন।
রাত্রের খাওয়াটা পাওয়া যায়। আর মাসে দশ টাকা। সুশান বলেছে।
মাত্র দশ টাকা! ডিসগ্রেসফুল। ছারপোকার জাত এরা! মার্কোপোলো উত্তেজিত হয়ে বলেছেন।
তা-ও বা কদিন? সুশান বিষণ্ণভাবে বলেছে। মানে? মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেছেন।
এখানে যে গান গাইত, তার নাম লিজা। পা ভেঙে সে বিছানায় পড়ে রয়েছে, তাই আমাকে গান গাইতে দিয়েছে। ডাক্তার লিজার পায়ের প্লাস্টারটা খুলে দিলেই আমার দিন শেষ হয়ে যাবে।
সুশানের জন্য মার্কোপোলো দুঃখ অনুভব করেছেন। ওরও যে বাবা-মা ছিল না, ভাবতেই সুশানের প্রতি প্রচ- আকর্ষণ অনুভব করেছেন। রূপ তার তেমন ছিল না। যৌবন হয়তো ছিল; কিন্তু কেবল যৌবনের সেই পাতলা দড়ি দিয়ে মার্কোর মতো সমুদ্রগামী জাহাজকে বেঁধে রাখা সুশানের পক্ষে নিশ্চয়ই সম্ভব হত না।
কিন্তু মার্কোপোলো নিজেই ধরা দিলেন। বাঁধা পড়লেন। স্বেচ্ছায় একদিন সুশানকে বধূরূপে হোটেলে এনে তুললেন।
এই সুশানের জন্যই মার্কোপোলোকে শেষ পর্যন্ত কলকাতা ছাড়তে হল। এখানে ওকে সবাই জেনে গিয়েছে। এখানে থেকে ওর পক্ষে বড় হওয়া সম্ভব নয়। পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় যে একবার নিজের গান বিক্রি করেছে, তার পক্ষে চৌরঙ্গীর জাতে ওঠা আর সম্ভব নয়।
চেষ্টা করে রেঙ্গুনে চাকরি জোগাড় করলেন মার্কোপোলো। ম্যানেজারের চাকরি। এবার ওঁদের আর কোনো দুশ্চিন্তার কারণ থাকবে না। সেখানের কেউ আর সুশানের পুরনো ইতিহাস খুঁজে পাবে না।
কলকাতার হোটেলওয়ালারা মার্কোপোলোকে বলেছিল, এত ব্যস্ত কেন, এখানেই একদিন তুমি ম্যানেজার হবে।
মার্কোপোলো হেসে ফেলেছিলেন। কলকাতা আমার শ্বশুরবাড়ি বটে, কিন্তু বাপের বাড়ি নয়। আমার কাছে রেঙ্গুনও যা কলকাতাও তাই।
কিছুদিন ওখানে মন্দ কাটেনি। সুশান তার স্বপ্ন আর মার্কো তার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। হোটেলটাকে ছবির মতো করে সাজিয়ে তুলবেন। বিদেশি আগন্তুকরা এসে অবাক হয়ে যাবেন। বার্মাতে যে এমন হোটেল থাকা সম্ভব, ভেবে পাবেন না।
কিন্তু রেঙ্গুনের আকাশে একদিন ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান দেখা গেল। জাপানিরা আসছে।
বার্মা ইকুয়েশন। এমন যে হতে পারে, কেউ জানত না। এমন অবস্থার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল নাÍমার্কোপোলোও না।
শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত রাস্তায় হারিয়ে ওঁরা দুজন কলকাতায় ফিরে এলেন। এর আগেও, শৈশবে মার্কোপোলো একবার রিফিউজি হয়েছিলেন। কিন্তু তখন অন্যজনের করুণায় জীবন রক্ষা হয়েছিল। এখন নিজের ছাড়াও আর একটা জীবন-সুশানের জীবন-তার উপর নির্ভর করছে।
যাঁরা একদিন তাকে রাখবার জন্য পেড়াপাড়ি করেছিলেন, তারাই আজ মুখ ফিরিয়ে নিলেন, তার উপর ইতালীয় গন্ধ আছে বলে অনেকে নাক সিটকাল। ইতালিয় বলে মার্কোকে কলকাতার লোকেরা হয়তো জেলখানায় পাঠাত, যদি না তাঁর পকেটে গ্রিক পাসপোর্ট থাকত। ফাদারেরা ওই একটি দুরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেনÍনাম পালটালেও, তাঁরা মার্কোর জাত পালটাননি।
কলকাতার বাজারে মার্কোপোলোর দাম নেই; কিন্তু সুশানের চাহিদা বেড়েছে। হাজার হাজার ইংরেজ এবং আমেরিকান সৈন্যে দেশটা ভরে গিয়েছে। তারা রেস্তোরাঁয় খেতে চায়; এবং খেতে খেতে গান শুনতে চায়।
মার্কোপোলো আপত্তি করেছিলেন। ওইভাবে গান গাইলে, তুমি কোনোদিন আর জাতে উঠতে পারবে না। তোমাকে যে অনেক বড় হতে হবে। একদিন বিশ্বসুদ্ধ লোক তোমার গান শুনতে চাইবে; তোমার রেকর্ড ঘরে ঘরে বাজবে।
সুশান বললে, কিন্তু ততদিন? ততদিন কি না খেয়ে থাকব? যারা একদিন দশ টাকা দিতে চায়নি তারাই পঁচিশ টাকা নিয়ে সাধাসাধি করছে। লিজা পালিয়েছে ওখান থেকে। গান না থাকলে, মিলিটারিরা খেপে যাবে।
বাধ্য হয়েই রাজি হয়েছিলেন মার্কোপোলো। যে-স্বামীর খাওয়াবার মুরোদ নেই, তার তো ফোঁস দেখিয়ে লাভ নেই।
মার্কোপোলো নিজের চাকরি খুঁজছেন। আর সুশান গান গাইছে।
একদিন সুশান বললে, একটা ঘড়ি কিনেছি জানো?
টাকা পেলে কোথায়?
সুশান বলে, টাকার অভাব নেই। আমার গান শুনে খুশি হয়ে একদল আমেরিকান অফিসার সেদিন সঁদা তুলে ঘড়ির দাম জোগাড় করে দিয়েছে।
মার্কোপোলো বলেছেন, হুঁ।
এত রাত করে বাড়ি ফের তুমি, আমার ভয় লাগে। মার্কোপোলো বলেছেন।
আগে লাইসেন্স ছিল দশটা পর্যন্ত। এখন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। রাত একটা পর্যন্ত গান গাইতে হয়।
তোমার কষ্ট হয় না? সুশান, এমন গান গাইতে তোমার ভালো লাগে? মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেন।
কিন্তু ওরা যে টাকা দেয়। অনেক টাকা দেয়, জানো? ক্লান্ত সুশান উত্তর দিয়েছে।
সুশান বলেছে, তোমার জন্য একটা চাকরি জোগাড় করছি। করবে? লিলুয়া মিলিটারি ক্যানটিনের ম্যানেজার। আমার স্বামী শুনে ওরা খুব আগ্রহ দেখিয়েছে। মেজর স্যানন আগামিকাল তোমার সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ করতে আসবেন।
মার্কোপোলোর বাধাবন্ধহীন আদিম গ্রিক রক্ত যেন গরম হয়ে উঠেছিল। তোমার-গান-গাওয়া-পরিচয়ের চাকরি? করুণা?
করুণায় এত ঘৃণা কেন? করুণায় তো ছোটবেলা থেকে এত বড় হয়েছ? সুশান সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল।
উত্তর দেননি মার্কোপোলো, মেজর স্যাননের আসবার সময় বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে গিয়েছেন। এক বোতল বীয়ার নিয়ে মার্কোর জন অপেক্ষা করে মেজর স্যানন শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফিরে গিয়েছেন।
কিছুদিন পরে সুশান বলেছে, দুপুরেও একটা সুযোগ পাচ্ছি। লাঞ্চের সময় গাইবার জন্য ম্যানেজমেন্ট ধরাধরি করছে। আরও শ তিনেক টাকা বেশি দেবে।
মার্কোপোলো উত্তর দেননি। পরে একদিন জিজ্ঞাসা করেছেন, এইজন্যই কী তুমি গানের সাধনা করেছিলে, সুশান?
যারা গান যায়, তাদের স্বপ্ন কী? সুশান পালটা প্রশ্ন করেছে। এবং মার্কোর জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই উত্তর দিয়েছে, তারা চায় জনপ্রিয়তা। তা আমি পেয়েছি। আমি পপুলার।
একটা চাকরির সন্ধানে মার্কোপোলো পাটনায় গেলেন। চাকরি পেলেন, কিন্তু সেখানে মন ভরল না। পাটনা থেকে সোজা করাচি। ওখানকার একটা বড় হোটেলে অবশেষে চাকরি পাওয়া গিয়েছে।
চাকরি পেয়ে করাচি থেকে সুশানকে মার্কোপোলো চিঠি লিখেছেন। সুশান লিখেছে, দিন-রাত্তির যে কোথা দিয়ে কেটে যাচ্ছে জানি না। সবসময় শুধু গান গাইছি। পৃথিবীর লোকেরা এত গান ভালোবাসে!
মার্কোপোলো লিখেছেন, এখানকার পরিবেশটা সুন্দর। তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। তাছাড়া শহর কলকাতা থেকে অনেক সাজানো-গোছানো। জাপানি বোমা পড়বার ভয়ও নেই।
সুশান লিখেছে, কলকাতার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। যারা একদিন দশ টাকা দিত না, তারাই হাজার টাকা দিচ্ছে। আর একটা রেস্টুরেন্ট আরও বেশি লোভ দেখাচ্ছে।
মার্কোপোলো লিখেছেন, তোমার জন্য মন কেমন করছে!
সুশান উত্তর দিয়েছে, ছুটি নিয়ে চলে এস। বড়জোর কয়েকদিনের মাইনে দেবে না।
করাচি থেকে চিঠি এসেছে, নতুন চাকরি; ছুটি নেব বললেই নেওয়া যায় না। হোটেলে অতিথি বোঝাই। অথচ দায়িত্বসম্পন্ন লোকের অভাব। তার থেকে তুমি চলে এস। গাইয়েদেরও তো বিশ্রাম দরকার!
কলকাতা থেকে উত্তর গিয়েছে, তোমার চিঠি পেলাম। আমেরিকান বেস-এ গান গাইবার জন্য বিশেষভাবে নিমন্ত্রিত হয়ে ছসপ্তাহের জন্য ভ্রমণে বেরোচ্ছি। স্যরি।
ছুটির চেষ্টা করেছেন মার্কোপোলো। কিন্তু পাননি। যখন ছুটি মিলল, তখন একটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গিয়েছে।
ছুটিতে কলকাতায় এসে মার্কোপোল অবাক হয়ে গিয়েছেন। তার স্ত্রীর বাড়িঘরদোর কিছুই চেনা যাচ্ছে না। যে-বাজারে গাড়ির একটা টায়ার পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না, সেই বাজারে গাড়ি কিনেছে সুশান!
আমাকে জানাওনি তো। মার্কোপোলো বলেছেন।
ওহহা স্যরি, তোমাকে জানানো হয়নি। খুব সস্তায় পেয়ে গিয়েছি। মেজর স্যানন জোগাড় করে দিয়েছেন।
নিজের চোখে মার্কোপোলো যা দেখলেন, তা তার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। টাকাৃসস্তা কেরিয়ারৃসুশানের কাছে ওইগুলোই বড় হল? নিজের শিল্পের কথা, নিজের সাধনার কথা একবার ভেবে দেখলে না।
কিন্তু উপদেশ বর্ষণ করে লাভ কী? বাঘিনি রক্তের আস্বাদ পেয়েছে। সুশানের বাড়ির সামনে মিলিটারি অফিসারদের গাড়িগুলো প্রায় সর্বদাই দাঁড়িয়ে রয়েছে।
একান্তে সুশানকে ডেকে মার্কোপোলো বলেছেন, তুমি কি আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখেছ?
শ্চিয় দেখেছি, রোজই দেখছি। একটু মোটা হয়েছি, এই যা। সুশান উত্তর দিয়েছে।
তোমার চোখ দুটো?
একটু বসে গিয়েছে। এমন পরিশ্রম করলে ম্যাডোনারও চোখ বসে যেত।
তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, আমাকে জানতে হবে সুশান। মার্কোপোলো গম্ভীরভাবে বলেছেন।
ভেরি ব্রাইট প্ল্যান, সুশান উত্তর দিয়েছে। রেস্তোরাঁর চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। ওতে লস। তার থেকে থিয়েটার রোডের এই বাড়িটাতে বসে বসে গান গাইব, সঙ্গে কিছু খাবার ব্যবস্থা থাকবে। মেজর স্যানন একটা বার লাইসেন্স জোগাড় করে দেবেন কথা দিয়েছেন। যাকে তাকে আমি বাড়িতে ঢুকতে দেব না। শুধু সিলেক্টেড গেস্টদের আপ্যায়ন করব। আর তুমি যদি সব দেখাশোনার দায়িত্ব নাও, তাহলে আমি নিশ্চিন্তে গান নিয়ে পড়ে থাকতে পারি।
হোয়াট? সুইস কলেজ অব কেটারারস থেকে পাস করে আমি ক?্গার্লের ম্যানেজার হব! গড় হেল্প মি!
সেই রাত্রেই মার্কোপোলো বুঝেছিলেন, আর হবে না।
ঘৃণায় ধর্মভীরু মার্কোপোলোর সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠেছিল। গভীর রাত্রে থিয়েটার রোডের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে পরমপিতাকে মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করেছেন, কেন এমন হল? এমন শাস্তি তাকে কেন পেতে হল?
ভোরবেলায়, ব্রেকফাস্ট টেবিলে মার্কোপোলো সুশানকে জানিয়ে দিলেন, আর এক সঙ্গে নয়, এবার ছাড়াছাড়ি।
ডাইভোর্স! সুশান প্রথমে রাজি হয়নি। আমার হাজব্যান্ড আছে বলে, আনডিজায়ারেবল এলিমেন্টরা ডিসটার্ব করতে সাহস পায় না। আমেরিকান মিলিটারি পুলিসও আমার ফ্ল্যাটে অফিসারদের যাতায়াতে বাধা দেয় না। আমার সম্মানজনক পেশাটা নষ্ট না করলে, তোমার বুঝি রাত্রে ঘুম হচ্ছে না?
বিচ্ছেদ তো হয়েই রয়েছে। এবার কেবল আইনের স্বীকৃতি। মার্কোপোলো বলেছেন।
তার মানে তুমি কোর্টে আমার নামে অ্যাডালটারির অভিযোগ আনবে? তুমি বলবে, আমি পরপুরুষে আসক্ত?
এ-দেশের চার্চে বিয়ে হলেও, এ-দেশের আইন জানবার সময় বা সুযোগ কোনোটাই মার্কোপোলোর ভাগ্যে জোটেনি। এদিকে ছুটি ফুরিয়ে আসছে। যা-হয় একটা কিছু করে, এই পাপের শহর থেকে চিরদিনের মতো পালিয়ে যাবেন বিদেশি মার্কোপোলো।
আইনের পরামর্শ নিলেন তিনি। ডাইভোর্স চাইলেই পাওয়া যায় না। এর জন্য কাঠ খড় ছাড়াও সময় এবং অর্থ পোড়াতে হবে। যিনি বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রার্থনা করবেন তাঁকে উপস্থিত থাকতে হবে, প্রয়োজনীয় সাক্ষীসাবুদ কোর্টে হাজির করতে হবে।
কতদিন সময় লাগবে? মার্কোপোলো খোঁজ নিয়েছিলেন।
তা কেউ বলতে পারে না। দেড় বছর দু বছরও লেগে যেতে পারে, অ্যাটর্নি বলেছিলেন।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছিল, কাজের সুবিধার জন্যে সুশানই মামলাটা দায়ের করবে। স্বামীর বিরুদ্ধে সে চরিত্রহীনতার অভিযোগ আনবে। তাতে সুশানের সম্মানও রক্ষা পাবে; আর মার্কোও যা চাইছেন তা পাবেন। সুদূর কর্মক্ষেত্র থেকে তিনি মামলায় কোনো অংশগ্রহণ করবেন না, ফলে সহজেই একতরফা ডিক্রি হয়ে যাবে।
যাবার আগে সুশানের সঙ্গে মার্কো সব আলোচনা করেছিলেন। সুশানের মোটেই ইচ্ছে ছিল না। বিবাহিত ছাপটা থাকলে এ-কাজের সুবিধে হয়। সুশানের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে মার্কো বলেছেন, যদি কোনোদিন তোমাকে ভালোবেসে থাকি তবে তার প্রতিদানে তুমি আমাকে এইটুকু অনুগ্রহ কোরো।
সুশান বলেছে, কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে চরিত্রহীনতার কী অভিযোগ আনব? তোমার নামের সঙ্গে কার নাম জড়াব?
মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন মার্কো। এমন কোনো মহিলা আছেন, যিনি ডাইভোর্স মামলায় কো-রেসপনডেন্ট হতে রাজি হবেন?
শেষ পর্যন্ত সুশান বলেছে, লিজাকে বলে দেখতে পারি। ওর তো সমাজে সম্মান হারানোর ভয় নেই। তাছাড়া, এক সময় ওর অনেক উপকারও করেছি।
কয়েকদিন পরে সুশান বলেছে, লিজার সঙ্গে কথা বলেছি। সে বলেছে, যার সঙ্গে গোপন অভিসারের অভিযোগ আনবে তাকে একটু দেখে রাখতে চাই!
ভোরবেলায় সুশানকে সঙ্গে করে মার্কো লিজার বাড়িতে হাজির হয়েছেন। সারারাত জেগে থেকে, লিজা তখন সবেমাত্র ঘুমোতে আরম্ভ করেছিল। ওদের ডাকে সে ঘুম থেকে উঠল।
দুজনকে একসঙ্গে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠেছে, ও-বাবা, পতিব্রতা স্ত্রী এবং চরিত্রহীন স্বামী জোড়ে হাজির!
মার্কো তখন লিজাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছেন! লিজা বলেছে, বোঝাতে হবে না। একটা পরীক্ষায় আগেই পাস করে এসেছি। আমার নিজের ডাইভোর্স কেষ্টা তো এই কোর্টেই হয়েছিল।
সুশান বলেছে, আইনের অত মারপ্যাচ বুঝি না। কী করতে হবে বলে দাও।
চলবে…….




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com