জিকির আরবি শব্দ। অর্থ স্মরণ, স্মৃতি, উল্লেখ, খ্যাতি, বর্ণনা, উপদেশ, সুনাম, উদ্ধৃতি ইত্যাদি। পরিভাষায় মুখ ও মন দিয়ে আল্লাহ তায়ালার মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা, তাঁর প্রশংসা, তাঁর পূর্ণতাসূচক গুণাবলি স্মরণ এবং তাঁর মহত্ত্ব ও সৌন্দর্যের উপলব্ধি ও উল্লেখ করাকে জিকির বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা বেশি বেশি করে আল্লাহর জিকির করো এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর তাসবিহ পড় (সূরা আহজাব ৪১-৪২)। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, তোমরা আল্লাহর বেশি বেশি জিকির করো, যেন লোকে মাতাল বলে (মুসনাদে আহমদ-১৮/১৯৫,২১২, ইবনে হিব্বান-৩/৯৯)। লোকে মাতাল বলে এর দ্বারা বেশি বেশি জিকির করা উদ্দেশ্য। লাফালাফি করা, চিল্লাচিল্লি করা, বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠা, গাছে ওঠা, চিক মেরে বেহুশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি জায়েজ নয়।
জিকির দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ, তাঁর ভয়ে অশ্রু ঝরানো। জিকির শুধু লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বা আল্লাহু আল্লাহু বলার মধ্যে সীমিত নয়। বরং সব ইবাদত জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। আওয়াজ করে জিকির করার চেয়ে নীরবে জিকির করা উত্তম। হজরত আবু মুসা আশয়ারী রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- আমরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। আমরা যখন কোনো প্রান্তরে পৌঁছলাম তখন তাকবির ও তাহলিল জোরে জোরে পড়ছিলাম। তখন রাসূল সা: বলেন, হে মানুষেরা! নিজেদেরকে ধীর ও শান্ত করো। কেননা, তোমরা যাকে ডাকছ তিনি বধির ও দূরে নন। তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। তিনি সর্বশ্রোতা ও অতিনিকটে (সহিহ বুখারি ও মুসলিম হাদিস নং ২৯০০, ৬০২১)। আল্লাহ বলেন, তোমরা নমনীয়তা ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক। তিনি সীমালঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না (সূরা আরাফ-৫৫)। জিকিরের ফায়দা : জিকিরে রয়েছে বহু ফায়দা। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ ফায়দাসমূহ হলো :
আরশের নিচে ছায়া লাভ : বিচার দিবসে যে দিন সূর্য থাকবে মাথার উপরে, জমিন হবে তামা, কোনো গাছপালা থাকবে না এবং আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না সে দিন জিকিরকারী আল্লাহর ছায়ার নিচে ছায়া লাভ করবে। মহানবী সা: বলেছেন, যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া অন্য কোনো ছায়া থাকবে না সে দিন সাত শ্রেণীর লোক আল্লাহর আরশের ছায়ার নিচে ছায়া পাবে। তারা হলো- ক. ন্যায়পরায়ণ বাদশা, খ. ওই যুবক যে আল্লাহর ইবাদত করতে করতে যৌবনে উপনীত হয়েছে। গ. ওই দুই ব্যক্তি যারা একে অন্যকে ভালোবাসে এবং এ ভালোবাসা নিয়ে পরস্পর মিলিত হয় এবং পৃথক হয়। ঘ. ওই ব্যক্তি যার হৃদয় মসজিদে সাথে মিলিত। মসজিদ থেকে বের হলেই আবার মসজিদে আসার চিন্তায় ব্যস্ত থাকে ঙ. ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর জিকির করে তথা আল্লাহকে স্মরণ করে অতঃপর তাঁর ভয়ে অশ্রু ঝরায়। চ. ওই ব্যক্তি যাকে সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী যুবতী কুপ্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু সে বলেছে আমি আল্লাহকে ভয় করি। তোমার কুপ্রস্তাবে আমি রাজি নই। ছ. ওই ব্যক্তি যে গোপনে দান করে, এমনকি বাম হাত জানে না ডান হাতে কী দান করেছে (বুখারি : ১৭৪, মুসলিম : ১৭১২)।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক লাভ : যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে তথা তাকে শয়নে-স্বপনে স্মরণ করে এবং তাকে ডাকে তার সাথে আল্লাহ তায়ালার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেন এবং ভালোবাসেন। যেমন আল্লাহর বাণী- তোমরা (ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে) আমাকে স্মরণ করো। আমি (ক্ষমা ও দয়ার মাধ্যমে) তোমাদেরকে স্মরণ করব (সূরা আল বাকারা : ১৫২)। মহানবী সা: বলেছেন, আল্লাহ বলেন, বান্দাহ যখন আমাকে স্মরণ করে তখন আমি তার সাথে থাকি (বুখারি ও মুসলিম, মিশকত-পৃ: ১৯৬)।
জিকিরকারী জীবন্ত ও প্রাণবন্ত : জিকিরকারীর কলব জীবন্ত ও প্রাণবন্ত থাকে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে না তার কলব জীবন্ত ও প্রাণবন্ত নয়। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে না তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃতের ন্যায় (বুখারি ও মুসলিম, মিশকাত, পৃ: ১৯৬)।
জবান সিক্ত থাকে : জিকির দ্বারা জবান সিক্ত ও সতেজ থাকে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, আল্লাহ জিকির দ্বারা তোমার জবান সতেজ থাকে (তিরমিজি, মিশকাত-১৯৮)।
কলবে প্রশান্তি লাভ হয় : আল্লাহর জিকিরে আত্মিক প্রশান্তি অর্জিত হয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, মনে রেখ! আল্লাহর স্মরণেই আত্মাসমূহ প্রশান্তি লাভ করে (সূরা রাদ : ২৮)। কলবের কালিমা দূর হয় : জিকির দ্বারা অন্তরের কালিমা দূর হয়। শয়তান মানুষকে গুনাহের কাজে লিপ্ত করে এবং এর ফলে মানুষের অন্তরে কালিমা সৃষ্টি হয়। এ কালিমা দূর করার একমাত্র উপায় হলো- আল্লাহর জিকির (বায়হাকি)। মহানবী সা: বলেন, তোমরা আল্লাহর জিকির ব্যতীত অধিক কথা বলবে না; কেননা তাতে অন্তর কালো ও কঠিন হয়ে যায়, আর নিশ্চয় কঠিন হৃদয় ব্যক্তি আল্লাহর রহমত হতে অধিকতর দূরে (তিরমিজি, মিশকাত-১৯৮)।
শয়তান দূর হয় : জিকিরের ফলে শয়তান বিতাড়িত হয়। যার কলবে সদা আল্লাহর জিকির থাকে, শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে না। মহানবী সা: বলেন, শয়তান আদম সন্তানের অন্তরে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। যখন সে আল্লাহর জিকির থেকে গাফিল হয়, তখন শয়তান মানুষকে প্ররোচনা দেয় (সহিহ বুখারি, মিশকাত -১৯৯)।
উত্তম আমল : মহানবী সা: একদা তার সাহাবিদের বলেন, আমি কি তোমাদের এমন একটি কাজের কথা বলব যা তোমাদের সব কাজের চেয়ে উত্তম? তোমাদের বাদশাহ আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পবিত্র, মর্যাদা বৃদ্ধিকারী স্বর্ণ রৌপ্য দান করার চেয়ে অধিক কল্যাণকর, শত্রুদের হত্যা এবং যুদ্ধে শহীদ হওয়ার চেয়ে উত্তম? তারা বললেন, বলুন, হে আল্লাহ রাসূল! তিনি বললেন, তা হচ্ছে আল্লাহর জিকির (ফিকহুস সুন্নাহ- ২য় খ-)।
আজাব থেকে মুক্তির উপায় : হজরত মুয়াজ রাধ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আল্লাহ জিকিরের চেয়ে অধিক উত্তম কোনো আমল মানুষ করে না, যা তাকে আল্লাহর আজাব থেকে মুক্তি দিতে পারে।
ঈমান নবায়নের মাধ্যম : মহানবী সা: বলেন, তোমরা তোমাদের ঈমানকে নবায়ন করো। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! ঈমানকে কিভাবে নবায়ন করব? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, বেশি বেশি করে ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো (মুসনাদ আহমদ)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি আমার জিকির থেকে বিমুখ হবে, তার জন্য জীবনে বাঁচার সামগ্রী সঙ্কুচিত হয়ে যাবে, সর্বোপরি তাকে আমি বিচার দিবসে অন্ধ বানিয়ে হাজির করবো (সূরা ত্বাহা-২২৪)। লেখক : প্রধান ফকিহ্, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফেনী