বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৮ অপরাহ্ন

রাজনীতির ভাষা

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৩

মানুষের পরিচয় হচ্ছে তার ভাষায়। ভাষা তার অন্তর্নিহিত শিক্ষাকে, মানবতাবোধকে, মানবিক চেতনাকে তার অন্তরে লালিত্যবোধকে, শালীনতাকে, শ্রদ্ধাবোধকে প্রকাশ করে। ভাষা দেয় চিন্তা চেতনা রুচিবোধ এবং ব্যক্তিত্বকে প্রকাশের সুযোগ। ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় একজনের বেড়ে ওঠার পরিবেশ সাহচর্য ও শিক্ষালব্ধ জ্ঞানের প্রকাশ। পরিশীলিত ভাষা ব্যবহারকারীকে মানুষ সংস্কৃতিবান রুচিবোধসম্পন্ন সৃষ্টিধর্মী মানুষ হিসেবে চেনে। মজার ব্যাপার হলো মানুষ আশৈশব যে ভাষায় কথা বলে মনের ভাবকে প্রকাশ করে, অপরের সাথে ভাবের আদান প্রদান করে; সে ভাষাকেই শিখতে হয় জানা ও বোঝার জন্য। মনন শক্তির বিকাশের জন্য, মনোভাব প্রকাশের জন্য শিখতে হয় ভাষা। ভাষার সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহার মানুষকে শানিত, বুদ্ধিদীপ্ত, সংস্কৃতিবান ও আলোকিত ব্যক্তিসত্তা হিসেবে পরিচিত করে।
ভাষার চর্চা করতে হয় সাহিত্যের সুবাদে। সেখানে ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল। শব্দ ব্যঞ্জনা সেখানে মানব চরিত্রের কোমল ধারাকে সিক্ত করে, পল্লবিত করে, প্রস্ফুটিত করে। ঘরে বাইরে বাজারে মাঠে-ঘাটে আমরা যে ভাষা ব্যবহার করি তা দিয়ে সাহিত্য রচিত হয় না। সাহিত্যের ভাষার ধারা ভিন্ন। তেমনি রাজনীতির ভাষা। রাজনীতিতে ব্যবহৃত ভাষা মূলত সংবেদনশীল এবং সংযুক্তির। দেশের আপামর জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার স্বতঃস্ফূর্ত স্ফুরণ। জাতিকে উজ্জীবিত করার স্বপ্ন এক স্বপ্ন জাগানিয়ার নান্দনিক প্রকাশ। মূলত রাজনীতির ভাষা স্বভাবতই নান্দনিক। সাংস্কৃতিক আবহে অবারিত দেশকে ভালোবাসার ভাষা। দেশকে এগিয়ে নেয়ার ভাষা, জাতিকে স্বপ্ন দেখানোর ভাষা। যুবশক্তিকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে জাতিগঠনে উদ্বুদ্ধ করার ভাষা। এখানে ঘৃণা বা বিদ্বেষের কোন স্থান নেই। নেই কাউকে ছোট করার কোনো চেষ্টা। রাজনীতির ভাষা হবে সংযত মার্জিত রুচিশীল। রাজনীতিবিদেরা জাতির সম্মানীয়জন। গোটা জাতি তাদের অনুকরণ করে। অনুসরণ করে, তাদের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়। তাদের আহ্বানে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যের বন্ধন গড়ে সর্বোচ্চ ত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়। রাজনীতিবিদদের ভাষা আচরণ বিস্তৃত হয় জনপদের সর্বত্র। আমরা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের দেখেছি। দেখেছি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, খাজা নাজিম উদ্দিন, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে। দেখেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আবুল মনসুর আহমদ, মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের মতো নন্দিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দেখেছি। শাহ আজিজুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আব্দুস সবুর খান নিকট অতীত। তাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, অবস্থান ছিল বিপরীত মেরুতে; কিন্তু তাদেরকে কখনো অপরের প্রতি নিন্দনীয় অরুচিকর ভাষা প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি।
বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের রাজনীতিতে, রাজনীতি চর্চায় গণতন্ত্রের ভাষা, নীতি ও আদর্শের চর্চা বলতে গেলে আগা গোড়াই অনুপস্থিত। এজন্য যে ধরনের মন মানসিকতা ও পরিবেশ থাকা দরকার তার যথেষ্ট ঘাটতি রাজনীতির অঙ্গনে দেখা যাচ্ছে। অবলীলায় জনসভায়, সংবাদ সম্মেলনে, টেলিভিশনের টকশোতে যেসব বাক্যবাণ ব্যবহার করা হয়; সেগুলো সপরিবারে দেখার বা শোনার অবস্থা প্রায়ই থাকে না। আমরা খাবি খেতে থাকি কোনটা অশালীন ভাষা কোনটা আলোচনার ভাষা কোনটা ঝগড়ার ভাষা তা বোঝার জন্য। উঠতি প্রজন্মও কিন্তু একই রকম ভাষা (মৌখিক এবং ক্ষেত্র বিশেষে দৈহিক) প্রয়োগে অভ্যস্ত হচ্ছে। যার প্রতিফলন প্রায়শই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, রাস্তাঘাটে আমরা দেখতে পাই। অবস্থা দেখে মনে হয় গণতন্ত্রের ভাষা এখন প্রতিস্থাপিত হচ্ছে ঝগড়ার ভাষা দিয়ে, বিভাজনের ভাষা দিয়ে, ঘৃণার ভাষা দিয়ে। যারা এসব ভাষা অবলীলায় ব্যবহার করেন সম্ভবত তারা উপলব্ধি করেন না বিভাজনের ভাষা দিয়ে দেশ গড়া যায় না, দেশপ্রেম জাগ্রত হয় না, সর্বোপরি স্মার্ট জাতি সৃষ্টির স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
আমাদের দেশের মানুষ মনেপ্রাণে গণতন্ত্রকে ভালোবাসে। তারা চায় সুন্দর সুষ্ঠু একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ। এজন্য আমাদের সবাইকেই গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাদেরই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে গণতন্ত্রের ভাষা চর্চায়। গণতন্ত্রের দর্শনে দীক্ষিত হওয়ার দুর্বলতাগুলোকে বের করে ঝেড়ে ফেলতে হবে। সামগ্রিক জনগণকে দেশকে নিয়ে কথা বলতে হবে। শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, স্নিগ্ধতায়, আদর্শে, নৈতিকতায় মোড়ানো হবে তাদের কথা। তখনই তারা জনতার প্রতিনিধি জনতার কণ্ঠস্বর জনগণের নেতা হতে পারবেন। আমরা চাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভালোবাসতে শিখুক, শ্রদ্ধা করতে শিখুক, সম্মান জানাতে শিখুক দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি রাজনীতিবিদকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। রাজনীতিবিদরা নির্মোহ হবেন। তারা জনগণের কথা বলবেন। তাদের নিজস্ব দলীয় আঙ্গিকে। কিন্তু সেখানে মুখ্য বিষয় হচ্ছে জাতি ও দেশ। প্রায়শই দেখা যায় তাদের পাশে যারা থাকেন, যারা তোষামোদের তেল দিয়ে সারাক্ষণ তাদের সিক্ত রাখেন বা রাখার চেষ্টা করেন, তাদের ব্যবহৃত ভাষাশৈলী আরো কদর্য। তারা তোষামোদ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেসব ভাষা ব্যবহার করেন শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। এতে রাজনীতিবিদদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। মোদ্দাকথা হলো নেতা বা তার পরিষদ সবাইকেই ভাষার ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার যেন তারা অনুকরণীয় হয়ে থাকতে পারেন; আদর্শ (ওফড়ষ) হিসেবে চিত্রিত হন। মনে রাখা দরকার অপরকে সম্মান করলে নিজেকেই সম্মান করা হয়।
একটা কথা না বললেই নয়। গণতন্ত্রে আলাদিনের চেরাগের মতো রাতারাতি সবকিছু বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। এই অসম্ভব স্বপ্ন দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে। জাতিকে সত্য এবং বাস্তবভিত্তিক স্বপ্ন দেখানো দরকার। নইলে ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে বিদায় নিতে হবে। অবাস্তব স্বপ্ন দেখানোর ব্যর্থতার দায় সব সময়ই রাজনীতিবিদদের বহন করতে হয়। আশপাশের সুযোগসন্ধানী তোষামোদকারীদের কিছুই হয় না। কলঙ্কের ছাপ নিয়ে অসম্মানজনকভাবে বিদায় নিতে হয় রাজনীতিবিদদের। গণতন্ত্রের শিক্ষাই হলো গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুসরণ করা বিভাজনের ঘৃণার ভাষাকে গণতন্ত্রের পরিভাষায় রূপান্তরের মাধ্যমে। লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ Email- shah.b.islam@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com