মঙ্গলবার, ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৬ পূর্বাহ্ন

হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতে বালু ভরাট ভাড়া জমিতে সাইনবোর্ড দিয়ে আবাসন ব্যবসার অভিযোগ

তৈয়বুর রহমান (কালীগঞ্জ) গাজীপুর :
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৩

গাজীপুর জেলার সদর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর উপজেলা বিভিন্ন এলাকা জুড়ে বয়ে গেছে প্রায় ৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বেলাই বিল। বর্ষায় বন্যা ও জলাবদ্ধতা ঠেকাতে শত শত বছর ধরে চার জেলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে জেলার দেশি মাছের ভান্ডার খ্যাত এই বিল। এ বেলাই বিল এক তৃতীংশ মাছের চাহিদা মিঠে পুরো জেলার মানুষের। বেলাই বিলকে ঘিরে চার উপজেলার শত শত মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। বিশেষ করে বর্ষাকালে বিল পাড়ের মানুষের কর্মসংস্থান হয় মাছ ধরে ও শাপলা তুলে। কিন্তু শত শত মানুষের কর্মংস্থানের বেলাই বিল আজ ভালো নেই। হুমকিতে এ বিলের প্রাকৃতিক পরিবেশও। একদিকে ভূমি খেকু কোম্পানী ও ব্যক্তিদের ললুপ দৃষ্টি, অন্যদিকে বিল পাড়ের শিল্প কারখানাগুলোর বর্জ্র ও দূষিত পানিতে আইসিইউতে বেলাই বিল। বিল বেলাইয়ের পানি সেচ দিয়ে চাষাবাদ করেন জেলার চার উপজেলার কৃষক। গাজীপুরের বেশ কয়েকটি নদী ও খালের সঙ্গে যুক্ত থাকা এই বিল। প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুরনো এ বিল। কিন্তু কোম্পানী ও ব্যক্তিদের দখলদারদের হিংস্র থাবায় বিলটি এখন বিলীন হওয়ার পথে। উচ্চ আদালত এবং জেলা-উপজেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চটকধারী বাহারি বিজ্ঞাপন দিয়ে অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে আবাসনের সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে রাতের আঁধারে চলছে ভরাটের কাজ। এতে একদিকে যেমন বিল বেলাইয়ের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে, অন্যদিকে চটকধারী বাহারি বিজ্ঞাপনে গ্রাহকরা হচ্ছে প্রতারিত। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টঙ্গী-কালীগঞ্জ-ঘোড়াশাল মহাসড়কের পিপুলিয়া থেকে নলছাটা সংলগ্ন বেলাই বিলের বিশাল এলাকাজুড়ে তেপান্তর, নর্থ-সাউথ গ্রুপ ও কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গংয়ের সাইনবোর্ড লাগানো। সড়কের পাশে রয়েছে তেপান্তর গ্রুপের সাইড অফিস এবং ওই সাইড অফিস সংলগ্ন মহাসড়কের পাশে বিল বেলাইয়ের কিছু অংশ ভরাট করে দুটিস্থানে তেপান্তরের পাকা স্থাপনা করে তাতে বড় সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে। পাশেই নর্থ-সাউথ গ্রুপ বিলের মধ্যে রাস্তা করে পানির উপরে তৈরি হচ্ছে পাকা স্থাপনা। একই জায়গায় ‘কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গং’ লেখা নতুন সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে অতি সম্প্রতি। পূবাইল ব্রীজের নিচ থেকে বালু নদীর উপর ড্রেজার বসিয়ে সড়কের পাশ দিয়ে বালু উত্তোলনের পাইপ টানা হয়েছে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। ইতোমধ্যে বিলের মাঝখানে বেশখানিকটা জায়গা ভরাট করা হয়েছে। আর ওই ভরাট অংশে বেড়ে উঠেছে কাশবন। স্থানীয়রা জানান, কাশবন গজিয়ে ওঠা জায়গা কয়েক বছর আগেই ভরাট করা হয়েছে। এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রশাসনের লোকজন এসে ড্রেজার বন্ধ করে দেয় এবং কিছু সাইনবোর্ড উঠিয়ে ফেলা হয়। প্রশাসনের লোক চলে গেলে আবার উঠিয়ে ফেলা সেই সাইনবোর্ড পূনরায় বসানো হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবারও ওই চক্রটি রাতের আঁধারে করছে বালু ভরাট। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কোম্পানিগুলো এলাকার প্রভাবশালী ও গুন্ডা প্রকৃতির লোকজনকে জমির দালাল নিয়োগ করেছে। তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে কৃষককে জমি বিক্রিতে বাধ্য করছে। বাড়িতে বসেই কমিশনে হচ্ছে জমি রেজিষ্ট্রি। নর্থ-সাউথ গ্রুপের সাইনবোর্ডের পাশে কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গং লেখা সাইনবোর্ড কার? জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা রওশন বলেন, কোম্পানির নামে জলাভূমি ভরাটে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই ব্যক্তিমালিকানা সাইনবোর্ড লাগিয়ে ভরাট করছে। ইউসুফ আলী নর্থ-সাউথ গ্রুপেরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দিকে, আবাসন প্রকল্পের চটকধারী বিজ্ঞাপন অনুযায়ী শুধু নর্থ-সাউথ গ্রুপেরই দখলে আছে বিল বেলাইয়ের ৩ হাজার বিঘারও বেশি জমি। অন্যদিকে, চটকধারী বিজ্ঞাপন অনুযায়ী বিল বেলাইয়ে তেপান্তর গ্রুপেরও দখলে রয়েছে প্রায় একই পরিমাণ জমি। স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, বেলাই বিলে সাইনবোর্ড বসানো অধিকাংশ জায়গা এখনো ব্যক্তিমালিকানাধীন। প্রতি সাইনবোর্ড বসানের জন্য মাসে জমির মালিককে দেওয়া হয় ১ হাজার টাকা। শুধু ম্যাপ বানিয়ে চার বছরের বেশি সময় ধরে প্লট বিক্রি করছে বেলাই বিল দখল করা কোম্পানিগুলো। তেপান্তর হাউজিং লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার মামুন আহমেদ বলেন, আমরা বর্তমানে কোন বালু ভরাটের কাজ করছি না। জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমতি পেলে তারপর আমরা বেলাই বিলে পুনরায় হাউজিং প্রকল্পের কাজ শুরু করবো। নর্থ সাউথ গ্রুপের এজিএম হুমায়ুন কবিরের ব্যবহৃত মুঠোফোনে ফোন করলে তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে বলেন, আমি মিটিং এ আছি। এ বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে আমাদের বনানী অফিসে আসেন, বলেই তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, নর্থ সাউথ হাউজিং ও তেপান্তর হাউজিং লিমিটেড আইন ভঙ্গ করে বিলের জমিতে বালি ভরাট করছে। কখনই উন্মুক্ত জলাধারের জমি কোনো আবাসন প্রতিষ্ঠানের নামে জারি হওয়ার সুযোগ নেই। এটা হয়ে থাকলে তা হবে আইনের বড় ধরনের লঙ্গন। এ বিষয়ে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বেলাই বিলে আবাসনের অনুমতির ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের গাজীপুর জেলা অফিসের উপ-পরিচালক মো. নয়ন মিয়া বলেন, কখনই কোনো প্রতিষ্ঠান উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট করতে পারে না। আইন ভঙ্গ করে তেপান্তর হাউজিং লিমিটেড ও নর্থ সাউথ গ্রুপ বেলাই বিলে বালু ভরাট করছে বলে আমরাও অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। গাজীপুর সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাফে মোহাম্মদ ছড়া বলেন, ২০১০ সালের জলাশয় আইন অনুযায়ী বিভাগীয়, জেলা ও পৌর শহরের জলাশয় ভরাট করা যাবে না। খালের পাশে বিলের জায়গাগুলো ব্যক্তিগত হলেও ভরাট করা যাবে না। এ ছাড়া হাই কোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক বেলাই বিল ও আশপাশের জলাশয়গুলোয় বালু ভরাট, অবৈধ দখল ও সাইনবোর্ড টানানো যাবে না। এরই মধ্যে আমরা খবর পেয়ে নোটিশ করে দিয়েছি। নোটিশের পরও যদি তারা এ বালু ভরাটের কাজ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজিজুর রহমান বলেন, যেখানে হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা রয়েছে সেখানে কারো সাথে সমযোতার কোন সুযোগ নেই। তা সে যত বড় শক্তিশালীই হউক। যেহেতু জেলা সদর ও কালীগঞ্জ উপজেলায় এ বিলের অবস্থান তাই ডিসি স্যারের নির্দেশনায় দুই উপজেলা প্রশাসন যৌথভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com