রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০১:১৮ পূর্বাহ্ন

চৌরঙ্গী

শংকর
  • আপডেট সময় শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
ইন্টারনেটের সৌজন্যে খবরপত্রের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।- বি.স
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আমাদের সবচেয়ে সেরা সুইট, যার প্রতিদিনের রেট দুশো পঞ্চাশ টাকা। তাও বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট।
বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট কথাটার অর্থ তখনও আমার জানা ছিল না। শুনলাম, তার মানে থাকার ব্যবস্থা ছাড়া শুধু ব্রেকফাস্ট দেওয়া হবে। বাকি খাওয়ার জন্যে আলাদা বিল। যেসব টুরিস্টরা সারাদিন ঘোরাঘুরি করেন, তারা বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট রেট পছন্দ করেন। হোটেলও কম খুশি হয় না। হাঙ্গামাও কম।
বলেছিলাম, সায়েবের বয়স তো বেশি নয়। নিশ্চয়ই খুব বড়লোক।
মুণ্ডু! বোসদা হেসে ফেললেন। চাকরি একটা করেন বটে, কিন্তু সেই মাইনেতে শাজাহানের এক নম্বর সুইটে থাকা যায় না।
হয়তো আপিসের কাজে এসেছেন। আমি বললাম।
আপিস তো ওঁর এই কলকাতাতেই। থাকেন বালিগঞ্জের এক সায়েবের বাড়িতে পেইং গেস্ট হিসেবে। কিন্তু মাঝে মাঝে একলা চলে আসেন। অথচ ডবল-বিছানা ঘর ভাড়া নেন। মাসে অন্তত চার পাঁচবার আসেন। ভদ্রলোক কমনওয়েলথের লোক, তাই। না হলে প্রতিবার সিকিউরিটি পুলিসকে রিপোর্ট করতে হত; এবং তারাও অবাক হয়ে যেত বালিগঞ্জ থেকে একটা লোক বার বার শাজাহান হোটেলে এসে ওঠে কেন?
আমি এই জীবনের সঙ্গে তেমন পরিচিত হয়ে উঠিনি। বোসদা বললেন, এখানে যদি সন্ধের পর কেউ বেশ কয়েক ঘণ্টা বসে থাকে, তবে সেও বুঝতে পারবে। রাত্রে কালো চশমা পরে তিনি আসবেন। তার স্বামীর সাত আটখানা গাড়ি আছে, তবু তিনি ট্যাক্সি চড়েই আসবেন। একটা কথা আমি জোর করে বলতে পারি, মিস্টার অমুক আজ কলকাতায় নেই। হয় বোম্বাই গিয়েছেন, না হয় দিল্লি গিয়েছেন; কিংবা খোদ বিলেতেই বিজনেসের কাজে তাকে যেতে হয়েছে।
কে এই ভদ্রলোক? কে এই ভদ্রমহিলা? আমি নিজের কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলাম না। বোসদা বললেন, এই হতভাগা দেশে দেওয়ালেরও কান আছে।
বোসদার হাত চেপে ধরে বললাম, আমার কান আছে বটে, কিন্তু আমি বোবা! যা কান দিয়ে ঢোকে, তা পেটেই বন্দি হয়ে থাকে। মুখ দিয়ে আর বের হয় না।
বোসদা বললেন, মিসেস পাকড়াশী। মাধব পাকড়াশীর হিসেবের খাতায় তিনি খরচ হয়ে গিয়েছেন। মিস্টার পাকড়াশীর জীবনে সব জিনিসই অনেক ছিলÍঅনেক গাড়ি, অনেক কোম্পানি, অনেক বাড়ি, অনেক টাকা। কিন্তু যে জিনিস মাত্র একটা ছিল, সেটাই নষ্ট হয়ে গেল। মিসেস পাকড়াশী আজ থেকেও নেই। দিনের বেলায় সমাজসেবা করেন, বক্তৃতা করেন, দেশের চিন্তা করেন। আর রাত্রে শাজাহানে চলে আসেন। সারাদিন তিনি প্রচণ্ড বাঙালি। কিন্তু এখানে তিনি প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক। কখনও দেশের কাউকে ওঁর সঙ্গে দেখিনি। এক নম্বর সুইটে আগে যিনি আসতেন, তিনি তেইশ বছরের একজন ফরাসি ছোকরা। কিন্তু কমনওয়েলথের বাইরে হলেই আমাদের রিপোর্ট করতে হয়, সেইজন্যেই বোধহয় এই ইংরেজ ছোকরাকে পছন্দ করেছেন। বেচারা মিস্টার পাকড়াশী!
কারুর সম্বন্ধেই আপনার বেশি সহানুভূতি থাকবার প্রয়োজন নেই। আমি বললাম।
মিসেস পাকড়াশীর নিজেরও তাই ধারণা। বোম্বাই-এর তাজ হোটেলে, দিল্লির মেডেন্সে মিস্টার পাকড়াশীর সিঙ্গল না ডবল বেডের রুম ভাড়া নেন, কে জানে! তবে আজও তিনি কর্তাকে বেকায়দায় ধরতে পারেননি। আমার মনে হয়, ভদ্রলোক ভালো। দুপুরে মাঝে মাঝে লাঞ্চে আসতে দেখেছি। বিয়ার পর্যন্ত নেন। মিসেস পাকড়াশী তো আপনার বায়রন সায়েবকে লাগিয়েছিলেন; ভদ্রলোক তো দুবার বোম্বাই ধাওয়া করেছিলেন। কিন্তু যতদূর জানি, কিছুই পাওয়া যায়নি।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, এসব আপনি কী করে জানলেন?
জানতে হয় না, এমনিই জানা হয়ে যায়। আপনারও হবে। দুদিন পরে আপনিও জেনে যাবেন মিসেস পাকড়াশীকে। তার বয়ফ্রেন্ড সম্বন্ধেও বহু কিছু শুনবেন। তখন অবাক হয়ে যাবেন। হয়তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারবেন না।
কেন? আমি জানতে চাইলাম।
এখন নয়। সে সময়মতো একদিন বলা যাবে, যদি তখনও আগ্রহ থাকে। এখন একটু অপেক্ষা করুন, হাতের কাজগুলো সেরে নিই। এখনই একশো বাহান্ন, একশো পঞ্চান্ন আর একশো আটান্ন খালি হয়ে যাবে। বিলটা ঠিকই আছে। তবে লাস্ট মিনিটে কোনো মেমো সই করেছেন কি না দেখে নিই। কোনো মেমো ফাঁক গেলে সেটা আমারই মাইনে থেকে কাটা যাবে।
বিলগুলো চেক করে, সত্যসুন্দরবাবু পোর্টারকে ডাক দিলেন। বেচারা টুলের উপর বসেছিল। ডাক শুনেই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল।
এখানে কথা বলার একটা অদ্ভুত কায়দা আছে। স্বর এত চাপা যে, যাকে বলা হচ্ছে সে ছাড়া কেউ শুনতে পাবে না। অথচ তার মানেই যে ফি ফিস্ করে কথা, তা নয়। সত্যসুন্দরবাবু সেই ভাবে পোর্টারকে বললেন, সায়েবরা ঘরে রয়েছেন। ওঁদের প্যাকিংও প্রায় রেডি। সুতরাং আর দেরি কোরো না।
আমি বললাম, এমন কণ্ঠস্বর কেমন করে রপ্ত করলেন?
আপনারা যেমন বলেন বি-বি-সি উচ্চারণ, তেমনি এর নাম হোটেল-ভয়েস। বাংলায় বলতে পারেন সরাইকণ্ঠ! অনেক কষ্টে রপ্ত করেছি। আপনাকেও করতে হবে। বোসদা বললেন।
বললাম, আপনি-পর্বটা এবার চুকিয়ে ফেললে হয় না? আমার অন্তত সান্ত্বনা থাকবে, শাজাহান হোটেলে এমন একজন আছেন, যাঁর কাছে আমি আপনি নই, যাঁর কাছে আমি তুমি।
বোসদা বললেন, তার বদলে, তুমি আমাকে কী বলে ডাকবে?
সে তো আমি আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিÍবোসদা।
বোসদা বললেন, মোটেই আপত্তি নেই, তবে মাঝে মাঝে স্যাটাদা বোলো। সায়েবগঞ্জ কলোনির অমন পিয়ারের নামটা যেন ব্যবহারের অভাবে অকেজো না হয়ে যায়।
কেন? এখানকার সবাই তো আপনাকে ওই নামে ডাকছে। আমি একটু আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম।
ওদের ডাকা, আর আপনজনদের ডাকা কি এক হল, ভাই?
সত্যসুন্দরবাবু এবার আমার প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। বললেন, জিমির মুখেই শুনলাম, তুমি পাকাপাকিভাবে এখানেই আশ্রয় গ্রহণ করেছ। ভালোই হল।
আমার মনের মধ্যে তখন দুশ্চিন্তা এবং অস্বস্তি দুইই ছিল। বললাম, আপনি বলছেন, ভালো হল? আমার তো কেমন ভয় ভয় করছে।
সত্যদার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, হাসালে তুমি। ভয় অবশ্য হয়। শাজাহান হোটেলকে দূর থেকে দেখলে, কার না ভয় হয়? আমি সায়েবগঞ্জ কলোনির সিজিনড় সেগুন কাঠ, আমারই বুকে ফাট ধরার দাখিল হয়েছিল।
রিসেপশনে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ কথা বলবার কোনো উপায় নেই।
আবার টেলিফোন বেজে উঠল। বোসদা ফোনটা তুলে নিলেন। শাজাহান রিসেপশন।ৃবেগইওর পা?্ডন। মিস্টার মিৎসুইবিসিৃহ্যাঁ হ্যাঁ, উনি টোকিও থেকে ঠিক সময়েই পৌঁছেছেন। রুম নাম্বার টু হানড্রেড টেন।
ওদিক থেকে বোধহয় কেউ জিজ্ঞাসা করলে, মিস্টার মিৎসুইবিসি এখন আছেন কি না।
জাস্ট এ মিনিট বলে বোসদা চাবির বোর্ডটার দিকে নজর দিলেন। দুশো দশ নম্বর চাবিটা বোর্ডেই ঝুলছে। টেলিফোনটা তুলে আবার বললেন, নো, আই অ্যাম স্যরি। উনি বেরিয়ে গিয়েছেন।
টেলিফোন নামিয়ে বোসদা বললেন, তা হলে আর দেরি করছ কেন, কাসুন্দের সম্পর্কটা তাড়াতাড়ি চুকিয়ে এস।
এবার আমার দুশ্চিন্তার কারণটা প্রকাশ করতে হল। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। তবু কোনোরকমে বললাম, এত বড় হোটেলে থাকতে হলে যে-সব জিনিসপত্তর আনা দরকার, সেরকম কিছুই তো নেই। আমার তোশকটার যা অবস্থা। একটা হোল্ড-অলও এত তাড়াতাড়ি কারুর কাছে ধার পাব না যে ঢেকে আনব। এই দরজা ছাড়া অন্য কোনো দরজা দিয়ে ঢোকা যায় না?
বোসদা সে-যাত্রায় আমায় রক্ষে করলেন। আমার বিদ্যেবুদ্ধি সম্বন্ধে নিতান্ত হতাশ হয়েই যেন বললেন, তুমি নেহাতই বোকা। এই সামান্য জিনিস নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়? যদি ভাল লোশকই থাকবে তবে আমরা এখানে আশ্রয় নেব কেন? যত বড় হোটেলে উঠবে, তত কম জিনিস সঙ্গে নিয়ে এলেই চলে যায়। ফ্রান্সের এক হোটেল তো বিজ্ঞাপনই দেয়, আপনার খিদেটি ছাড়া আর কিছুই সঙ্গে নিয়ে আসবার প্রয়োজন নেই। আর এ-খিদে বলতে শুধু পেটের খিদে নয়, আরও অনেক কিছু বোঝায়।
বোসদা ডান কানে পেন্সিলটা খুঁজে রেখেছিলেন। সেটা নামিয়ে নিয়ে একটা স্লিপ লিখতে আরম্ভ করলেন। লেখা বন্ধ করে বললেন, লজ্জা নিবারণের বস্ত্র ছাড়া আর কিছুই এখানে আনবার দরকার নেই। আর সব ব্যবস্থা আপনা-আপনি হয়ে যাবে।
তারপর একটু ভেবে বললেন, স্যরি, আর একটা জিনিস আনতে হবে। খুব প্রয়োজনীয় আইটেম। সেটা তোমার ভালো অবস্থায় আছে তো?
কোনটা? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
টুথ ব্রাশ। নিজের ব্রাশ ছাড়া, এখানে আর কিছুই আনবার প্রয়োজন নেই। যাও, আর দেরি কোরো না। কাসুন্দের মা হাজার-হাত-কালীকে পেন্নাম ঠুকে, হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটির সঙ্গে কানেকশন কাট অফ করে, সোজা এই চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে চলে এসো। আমরা ততক্ষণ তোমাকে সিভিক রিসেপশন দেবার জন্যে প্রস্তুত হই।
মালপত্র সঙ্গে করে শাজাহান হোটেলের সামনের রাস্তায় যখন ফিরে এলাম, তখন এক বিচিত্র অনুভূতিতে মনটা ভরে উঠছিল। শাজাহান হোটেলের নিওন বাতিটা তখন জ্বলে উঠেছে। সেই নিওন আলোর স্বপ্নভায় হোটেল বাড়িটাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম।
হোটেল বাড়ি নয়তোÍযেন ফ্রেমে-আঁকা ছবি। তার যুবতী অঙ্গে আধুনিক স্কাইস্ক্র্যাপারের ঔদ্ধত্য নেই; কিন্তু প্রাচীন আভিজাত্যের কৌলীন্য আছে। রাত্রের অন্ধকারে, সুন্দরী বধুর কাকনের মতো নিওন আলোর রেখাটা মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছে। সেই আলোর তিন ভাগ। দুদিকে সবুজ, মধ্যিখানে লাল। জ্বলা-নেভার যা কিছু চটুলতা, তা কেবল সবুজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর লাল আলো দুটো যেন কোনো ক্ষুব্ধ দৈত্যের পাতাবিহীন রক্তচক্ষু।
যেন ইন্দ্রপুরী। বিরাট গাড়ি-বারান্দা শুধু হোটেলের দরজাকে নয়, অনেক ঝলমলে দোকানকেও আশ্রয় দিয়েছে। হোটেলেরই যেন অংশ ওগুলো। বই-এর দোকান আছে, সাময়িকপত্রের আড়ত আছে, ডাক্তারখানা আছে, ভারতীয় তাত-শিল্পের সেরা নিদর্শন বোঝাই সরকারি দোকান আছে; নটরাজের মূর্তি, হাতির দাঁত, কাঠের কাজ করা কিউরিও শপ আছে; শাজাহান ব্র্যান্ড কেক এবং রুটি বিক্রির কাউন্টার আছে। তা ছাড়া মোটরের শো রুম আছে, টাকা পাঠাবার পোস্টাপিস আছে, টাকা ভাঙাবার ব্যাঙ্ক আছে; কোট-প্যান্ট তৈরির টেলারিং শপ আছে, সেই কোট কাচবার আর্ট-ডয়ারস এবং ক্লিনার্স আছে। মানুষের খিদমত খাটিয়েদের এই বিচিত্র ভিড়ের মধ্যে মরা জানোয়ারদের জামা-কাপড় পরাবার জন্য জনৈক ট্যাক্সিডার্মিস্ট কীভাবে টিকে রয়েছে কে জানে। বাঘ, সিংহ এখন শিকার করে কে? আর করলেও, অত যত্নে এবং পয়সা খরচ করে কে সেই মরা বাঘের পেটে খড় এবং ঘাড়ে কাঠ পুরে তাকে প্রায় জ্যান্ত করে তোলবার চেষ্টা করে?
কিন্তু এই ট্যাক্সিডার্মিস্ট এখানে থাকবার পিছনে ইতিহাস আছে। এই হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা শিকার করতে ভালোবাসতেন; তার এক বন্ধুও শিকারের নেশায় পাগল ছিলেন। দোকানে ঢুকলে ওঁদের দুজনের একটা অয়েল-পেন্টিং দেখতে পাবেনÍএকটা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মৃতদেহের উপর পা দিয়ে বিজয়গর্বে শাজাহান হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা এবং তার বন্ধু দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সে পা কিন্তু সায়েব ভদ্রলোক চিরকাল রাখতে পারেননি। রয়েল বেঙ্গল কুলের কোনো সাহসী যুবক পরবর্তীকালে সুযোগ বুঝে স্কিনার সায়েবের পদাঘাতের প্রতিশোধ নিয়েছিল। শাজাহান হোটেলের মালিক সিম্পসন সায়েব এবং তার বন্ধু স্কিনার চারখানা পা নিয়ে শিকারে বেরিয়েছিলেন ফিরে এলেন তিনখানা নিয়ে। স্কিনার সায়েবের ঘোরাঘুরির চাকরি ছিল। সে-চাকরি গেল। বন্ধুর জন্য সিম্পসনের চিন্তার অন্ত নেই। স্কিনার সাহেব একসময় শখ করে ট্যাক্সিডার্মির কাজ শিখেছিলেন। বন্ধু বললেন, তুমি দোকান খোললা, আমার হোটেলের তলায়-ঘরভাড়া লাগবে না। আর হোটেলের শিকারি অতিথিদের তোমার ওখানে পাঠাবার চেষ্টা করব।
তারপর এই একশ পঁচিশ বছর ধরে কত লক্ষ ভারতীয় বাঘ, সিংহ, হরিণ এবং হাতি যে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে, তা তো আমরা সবাই জানি। সেই সব অকালে-মরা অরণ্য-সন্তানদের কত মৃতদেহ আজও অক্ষত অবস্থায় সমুদ্রের ওপারে ইংলন্ডের ড্রয?িং রুমে শোভা পাচ্ছে, তাও হয়তো আন্দাজ করা যায়। সুতরাং বুঝতে কষ্ট হয় না, কেমন করে খোঁড়া স্কিনার সায়েব স্কটল্যান্ডে একটা প্রাসাদ কিনেছিলেন; কেমন করে সেই যুগে কয়েক লক্ষ টাকাকে পাউন্ডে পরিবর্তিত করে, তিনি লন্ডনের জাহাজে চেপে বসেছিলেন।
স্কিনার সায়েবের সাফল্যের এই গল্প আমার জানবার কথা নয়। শুধু আমি কেন, স্কিনার অ্যান্ড কোম্পানির বর্তমান মালিক মুক্তারাম সাহাও জানতে পারতেন কি না সন্দেহ, যদি-না ওই দোকানে ক্যাশকাউন্টারের পিছনে পুরনো ইংলিশম্যান কাগজের একটা অংশ সযত্নে ফ্রেমে-বাঁধা অবস্থায় ঝোলানো থাকত। স্কিনার সায়েবের বিদায় দিনে ইংলিশম্যানের সম্পাদক ওই বিশেষ প্রবন্ধ ছাপিয়েছিলেন।
বাঁধানো প্রবন্ধে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ইংলিশম্যানের নিজস্ব শিল্পীর আঁকা শাজাহান হোটেলের স্কেচ। সেই স্কেচ আমি যত্নের সঙ্গে বহুক্ষণ ধরে দেখেছি। শাজাহান হোটেলের লাউঞ্জেও সেকালের কোনো নামহীন শিল্পীর খানকয়েক ছবি আছে। এই ছবিগুলোই নতুন আগন্তুককে প্রথম অভ্যর্থনা করে। তাকে জানিয়ে দেয়, এ পান্থনিবাস হঠাৎ-গজিয়ে-ওঠা আমরিকী হোটেল নয়, এর পিছনে ইতিহাস আছে, ট্র্যাডিশন আছেÍসুয়েজ খালের পূর্বপ্রান্তের প্রাচীন পান্থশালা আপনাকে রাত্রিযাপনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।
নিজের ছোট্ট ব্যাগটা নিয়ে যখন লাউঞ্জে ঢুকলাম, তখন সেখানে বাইরের কেউ ছিল না। সত্যসুন্দরদা রিসেপশন কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে নাটকীয় কায়দায় আমাকে অভ্যর্থনা করলেন।
আমার কেমন লজ্জা লজ্জা করছিল। সত্যসুন্দরদা হাসতে হাসতে বললেন, জানোই তো, লজ্জা-ঘৃণা-ভয়, তিন থাকতে হোটেলের চাকরি নয়।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো। আমার ডিউটি শেষ হবে, উইলিয়াম ঘোষ এসে পড়বে। ওকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে, দুজনে একসঙ্গে বহভেদ করে ভিতরে ঢুকব।
উইলিয়ম কি ওপরেই থাকে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
না, ও বাইরে থেকে আসে। বৌবাজারের মদন দত্ত লেনে থাকে। ওর সঙ্গে তোমার বুঝি আলাপই হয়নি? ভেরি ইন্টারেস্টিং বয়। সত্যসুন্দরবাবু বললেন।
আমার নজর এতক্ষণে লাউঞ্জের পুরনো ছবিগুলোর উপর এসে পড়ে ছিল। সত্যসুন্দরদাও কাজ শেষ করে বসেছিলেন। আমার সঙ্গে ছবি দেখতে আরম্ভ করলেন। দেখতে দেখতে বললেন, সত্যি আশ্চর্য! কবেকার কথা। কিন্তু কালের পরিবর্তন স্রোতকে উপেক্ষা করে সিম্পসন সায়েবের শাজাহান হোটেল সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
——চলবে




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com