শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪২ পূর্বাহ্ন

চৌরঙ্গী

শংকর
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
ইন্টারনেটের সৌজন্যে খবরপত্রের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।- বি.স
(পূর্ব প্রকাশের পর)
অথচ আজও বাড়িটাকে দেখে কে বলবে, তার এত বয়েস হয়েছে? আমি বললাম।
বোসদা বললেন, আমাদের উইলিয়ম খুব ভালো ছড়া জানে। খুঁজে খুঁজে, অনেক বাংলা প্রবাদও ছোকরা স্টক করে রেখেছে। উইলিয়ম বলে, বাড়ির বয়স বাড়ে না। বয়স বাড়াবাড়ি সম্পূর্ণ নির্ভর করে মালিকের উপর। উইলিয়মের ডাইরিতে লেখা আছে :
ইমারতির মেরামতি
জমিদারির মালগুজুরি
চাকরির হাজরি।
মানে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
সত্যসুন্দরদা বললেন, উইলিয়ম ঘোষ এখানে থাকলে তোমাকে হয়তো অনেক মানে বোঝাত। আমার সোজাসুজি মনে হয়Íঠিক সময়ে বাড়ি। মেরামত করা, জমিদারির সরকারি খাজনা আর চাকরির হাজরি দেওয়া প্রয়োজন।
তা এ-বাড়ির মালিকরা মেরামতিতে কোনোদিন কার্পণ্য করেছেন বলে মনে হয় না। আমি বললাম।
ঠিক সময়ে চুন-সুরকির স্নো-পাউডার মাখে বলেই তো বুড়ি চেহারাটা অত আঁটসাঁট রাখতে পেরেছে, সত্যসুন্দরদা হাসতে হাসতে বললেন, তবে এ শুধু বাইরের রূপ, ভিতরটা ভালোভাবে না দেখে কোনো মন্তব্য করলে পরে আপসোসের কারণ হতে পারে! সত্যসুন্দরদা সকৌতুকে চোখ টিপলেন।
একটা পুকুরের ছবি দেখলাম। দূরে লাটসায়েবের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। এই পুকুরটা কলকাতার বুক থেকে কীভাবে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল বুঝতে পারছিলাম না।
সত্যসুন্দরদা বললেন, এইটাই তোমার সেই বিখ্যাত এসপ্ল্যানেডের পুকুর। ওই এসপ্ল্যানেডে এখন ট্রাম ঘোরাঘুরি করে। ওই পুকুর নিয়ে কত গল্পই যে আছে, সে-সব যদি জানতে চাও, তা হলে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। ভারি মজার মানুষ-পুরনো গল্পের যেন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি। এত ঘটনাও যে ঘটেছিল, আর এত ঘটনাও যে মনে রাখা একটা লোকের পক্ষে সম্ভব, তাকে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। বুড়ো সায়েব, বহুকাল ধরে কলকাতায় রয়েছেন।
সত্যসুন্দরবাবু বললেন, ওঁর কাছেই শুনেছি, সে-যুগের লোকের বিশ্বাস ছিল, এই এসপ্ল্যানেড ট্যাঙ্কের কোনো তল নেই। যতদূর নেমে যাবে শুধুই জল। পুকুরটাতে অনেক মাছ ছিল। তারপর যখন ওই পুকুরের জল পাম্প করে তুলে ফেলবার সিদ্ধান্ত হল, তখন হোটেল-ডি-ইউরোপের মালিক ফিনবার্গ সায়েব সাড়ে ছশ টাকায় সমস্ত মাছ কিনে নিতে রাজি হলেন। জল ছেচা আরম্ভ হল। চৌরঙ্গী তখন লোকে লোকারণ্য। অতল দিঘির সত্যই তল খুঁজে পাওয়া যায় কি না তা দেখবার জন্য প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে লোকত্তা এসে ভিড় করে দাঁড়াত। এদিকে হোটেল-ডি-ইউরোপের মালিক রাত্রে ঘুমোতে পারছেন না; অতগুলো টাকা শেষ পর্যন্ত জলে না যায়Íকত মাছ উঠবে কে জানে।
জল ঘেঁচে নর্দমায় ফেলা হতে লাগল; আর কুলির মাথায় বুড়ি করে পাঁক চালান দেওয়া আরম্ভ হল ময়দানে। ওই পাঁকেই তৈরি হল ডালহৌসি ক্লাবের মাঠ।
শুনেছি, সাড়ে ছশ টাকা লাগিয়ে হোটেল-ডি-ইউরোপের মালিক বহু টাকা লাভ করেছিলেন। কতরকমের মাছই যে পাওয়া গিয়েছিল। আর দৈত্যের মতো এক একটা রুই মাছ-মণখানেকের মতো ওজন। দুএকটা আবার পাঁকের মধ্যে লুকিয়েছিল। ফিনবার্গ সায়েবের লোকেরা হৈ হৈ করে কাদা থেকে সেগুলো তুলে নিয়ে এসেছিল।
মাছের গল্প হয়তো অনেকক্ষণ ধরে চলত। কিন্তু হঠাৎ কে যেন আমাদের পিছনে এসে দাঁড়াল। আমাদের চমকে দিয়েই প্রশ্ন করলে, চৌরঙ্গীর মাছগুলো যখন জলের দরে নিলামে বিকিয়ে যাচ্ছিল, তখন শাজাহান হোটেলের মালিক কী করেছিলেন?
বোসদা মুখ ফিরিয়ে বললেন, আরে উইলিয়ম। দেরি করলে যে?
একটু দেরি হয়ে গেল স্যাটা। কলকাতার ব্যাপার তো, ট্রামের মেজাজ সব সময় সমান থাকে না। আজ একটু বিগড়িয়ে গিয়েছিল। উইলিয়ম হেসে উত্তর দিলে।
উইলিয়ম ঘোষের দিকে এতক্ষণ আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম। কালোর মধ্যে এমন সুন্দর চেহারা সহজে নজরে পড়ে না। পরনে যদি ধুতি থাকত, এবং রংটা যদি একটু ফর্সা হত তা হলে বলতাম কার্তিক। এমন কুচকুচে কাজল চোখ, একমাত্র ছোটবেলায় আমার পুটুদির ছিল। কিন্তু পুটুদি তার কালো হরিণ চোখে সযতেœ প্রচুর কাজল লাগাতেন। দূর থেকে উইলিয়মকে দেখলে ওই একই সন্দেহ হয়। কিন্তু কাছে এলে তবে বোঝা যাবে, ও-কাজল তার জন্ম থেকেই পাওয়া।
সাদা শার্টের উপর কালো রংয়ের প্রজাপতি টাই পরেছে উইলিয়ম ঘোষ। চলো গোঁফটা যেন গলার প্রজাপতির সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে কাটা হয়েছে। হাল্কা নীল রংয়ের প্যান্ট পরেছে উইলিয়ম। সঙ্গে একই রংয়ের কোট। বোতাম-খোলা কোটের মধ্য থেকে সাদা শার্টের বুকপকেটটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে সিল্কের রঙিন সুতো দিয়ে লেখাÍং। এই এস যে শাজাহানের এস, তা না বললেও বোঝা যায়।
খাতাপত্তর বুঝিয়ে দিয়ে বোসদা বললেন, উইলিয়ম, তোমার কপাল ভালো। শুভদিনে তোমার নাইট ডিউটি পড়েছে।
উইলিয়মকে আর কিছুই বলতে হল না, সে যেন সব বুঝে নিয়েছে। এক নম্বর সুইট কি বুক হয়েছে? মিসেসৃকি এসে গিয়েছেন?
মিসেস পাকড়াশী এখনও আসেননি। আজ হঠাৎ নিজে ফোন করে ঘরটা ঠিক করলেন। বোধহয় আগে থেকে জানতেন না। নিশ্চয়ই জরুরি কাজে ভদ্রলোককে হঠাৎ চলে যেতে হয়েছে।
টমসন এসেছে? উইলিয়ম ঘোষ প্রশ্ন করলে।
হ্যাঁ, টমসন এসে গিয়েছে। দুখানা দশ টাকার নোট তোমার বাঁধা!
ব্যাডলাক ব্রাদার! চামড়াটা সাদা হলে, দুখানা কেন, আরও অনেক দশ টাকার নোট রোজগার করতে পারতাম।
নেমকহারামি করো না, উইলিয়ম। মিসেস পাকড়াশী ছাড়া আর কাউকে কখনও রিসেপশনিস্টকে টাকা দিতে দেখিনি আমি। ভদ্রমহিলার মনটা খুবই ভালো।
উত্তরে উইলিয়ম কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বোসদা বললেন, এবার মন চলো নিজ নিকেতনে। চামড়ার ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিতে যাচ্ছিলাম। বোসদা ডাকলেন, পোর্টার।
পোর্টার দূরে টুলের উপর বসে ছিল। উঠে এসে আমাদের দুজনকে সে সেলাম করলে। কিন্তু বোসদা তার উপর চটে উঠলেন। টুপিটা বেঁকে রয়েছে কেন? ম্যানেজার সায়েব দেখলে, এখনি হাতে একটি চিঠি ভিড়িয়ে দিয়ে বিদায় করে দেবেন।
ঠিক সার্কাস দলের ক্লাউন। ক্লাউনদের ড্রেস দেখেই যেন শাজাহান হোটেলের পোর্টারদের ইউনিফর্ম তৈরি করা হয়েছিল। বেগুনি রংয়ের গলা বন্ধ কোট-অথচ হাতের অর্ধেকটা কাটা। হাতার মধ্যিখানে আবার সবুজ রংয়ের লম্বা লাইন। সেই লাইনটা প্যান্টের উপর থেকে নিচে পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। মাথায় ভেলভেটের গোল টুপিÍসেখানেও ওই সবুজ রংয়ের দাগ। টুপি, কোট এবং প্যান্ট পরার পর একটা তুলি এবং বড়ো রুল-কাঠ নিয়ে কেউ যেন একটা সবুজ রংয়ের সরল রেখা টেনে দিয়েছে। টুপির রেখাটা মাঝে মাঝে বেঁকে যেতে বাধ্য-কারণ মাল তোলবার জন্য টুপিটা খুলে প্রায়ই কাঁধের স্ট্যাপে আটকে রাখতে হয়।
পোর্টার তাড়াতাড়ি টুপিটা সোজা করে নিয়ে বললে, কসুর মাফ কিজিয়ে, হুজুর। বোসদা বললেন, লাউঞ্জে অতগুলো আয়না রাখা হয়েছে কেন? দেখে নিতে পারিস না?
পোর্টার আমার হাতের ব্যাগটা তুলে নিল। আমরা দুজনে বোসদার পিছন পিছন চলতে শুরু করলাম। লিফটে যাবে, না হেঁটে? বোসদা জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর কী ভেবে বললেন, না, লিফটেই চলো? লিফ্ট চলতে আরম্ভ করল।
দোতলায় একবার থেমে লিট আবার উঠতে আরম্ভ করল।
দোতলায় সব ঘর গেস্টদের জন্যে। শুধু মার্কোপোলো কোনোরকমে টিকে রয়েছেন। তিনতলাতে একবার লিটে থামল। এয়ারকন্ডিশনের এক-ঝলক ঠান্ডা বাতাস মুখের উপর নেচে গেল। তিনতলায় শুধু গেস্ট।
তিনতলা থেকে লিষ্ট যেমনি আরও উপরে উঠতে আরম্ভ করল, সঙ্গে সঙ্গে যেন আবহাওয়ার পরিবর্তন শুরু হল। যে লিটম্যান এতক্ষণ মিলিটারি কায়দায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেও যেন হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এক হাতে পা চুলকোতে লাগল; ঠান্ডা হাওয়াটাও সুযোগ বুঝে যেন কাজে ফাঁকি দিয়ে গরম হতে আরম্ভ করল। বোসদা বললেন, এয়ারকন্ডিশন এলাকা শেষ হয়ে গেল। এবার আমাদের এলাকা।
দরজা খুলে লিফ্ট যেখানে আমাদের নামিয়ে দিলে সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোলাপসেবল গেট বন্ধ করে যেমনি লিফ্ট আবার পাতালে নেমে গেল, সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো কেউ জোর করে আমাদের অন্ধকার কারাগারে বন্দি অবস্থায় ফেলে রেখে, গেট বন্ধ করে পালিয়ে গেল।
বেশিক্ষণ ওই অবস্থায় থাকলে হয়তো ভয় পেতাম। কিন্তু পোর্টার বাঁ হাত দিয়ে সামনের দিকে টেনে একটা দরজা খুলে ফেললে। একঝলক ইলেকট্রিক আলো দরজা ভেঙে সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়লো। সেই আলোতে দেখলাম, দরজায় লাল অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা-চটখখ; দরজাটা পেরিয়ে যেতে সেটা আপনাআপনিই দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। দরজার এদিকে একইভাবে লেখা-চটঝঐ।
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। বোসদা হেসে বললেন, বুঝতে পারলে না! দুনিয়ার পুরনো নিয়ম। এদিক থেকে ঠেলো, ওদিক থেকে টানো। দুনিয়ায় যাদের কপাল, চওড়া, তাদের সৌভাগ্যের দরজা এইভাবেই খুলে যায়। আর অভাগাদের বেলায় ঠিক উলটোÍযেদিক টানবার কথা, সেই দিকে ঠেলে, আর ঠ্যালার দিক থেকে টানা হয়। তাদের ভাগ্যের দরজা তাই কিছুতেই নড়তে চায় না। আমাদের মধ্যে পাছে সেই ভুল কেউ করে, সেইজন্য লিখে সাবধান করে দিয়েছি!
সমস্ত ছাদ জুড়ে ছোট ছোট অসংখ্য কুঠরি রয়েছে, যার মাথায় টালি, টিন, না-হয় এসবেস্টস।
ওইগুলোই আমাদের মাথা গোঁজবার ঠাই। আমাদের বিনিপয়সার পান্থশালা; আর শাজাহান হোটেলের অন্তরাল। বোসদা বললেন।
জানলার পর্দা টুইয়ে ঘরের ভিতর থেকে সামান্য আলো বাইরে এসে পড়েছে। আকাশ অন্ধকার।
অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারিনি। প্রায়-উলঙ্গ কোনো মহিলা যেন একটা ইজি-চেয়ারে বসেছিলেন। আমাদের দেখে দ্রুতবেগে সেই নারীমূর্তি কোথায় ঢুকে পড়লেন।
আমি যে সঙ্গে রয়েছি তা যেন ভুলে গিয়ে বোসদা আপন মনে শিস দিতে দিতে নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
বোসদার ঘরও অন্ধকার। সাদা পোশাকপরা একজন বেয়ারা ছুটে এল। তাকে দেখে বোসদা মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বললেন-হে রাত্রিরূপিণী, আলো জ্বালো একবার ভালো করে চিনি!
সত্যসুন্দরবাবুর ঘরে আলো জ্বলে উঠল। ঘরটার তেমন কোনো আব্রু, নেই। দেওয়ালগুলোও ইটের নয়। আসলে কাঠের কেবিন। পশ্চিমে আর উত্তরদিকে দুটো ছোট ছোট জানলা আছে। দক্ষিণে এক পাল্লা দরজা, ঠিক রাস্তার উপরেই। দরজা খোলা রাখলে ভিতরের সবকিছু দেখা যায়।
ঘরের ভিতরে ঢুকেই সত্যসুন্দরদা প্রথমে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে থেকে তিনি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। দুএক মিনিট মড়ার মতো চিত হয়ে পড়ে থাকবার পর, সত্যসুন্দরদার দেহটা একটু নড়ে উঠল। শোয়া অবস্থায় তিনি বেয়ারাকে ডাকলেন। বেয়ারা মহলে সত্যসুন্দরদার প্রতাপের নমুনা পেলাম। সে ঘরের মধ্যেই, কোনো কথা না বলে সত্যসুন্দরদার পা থেকে জুতোটা টেনে বার করে নেবার জন্যে ফিতে খুলতে লাগল।
বেয়ারা সাবধানে জুতো জোড়া খাটের তলায় সরিয়ে দিয়ে, অভ্যস্ত কায়দায় পায়ের মোজা দুটোও খুলে নিল। পাশে একটা সস্তা কাঠের রং-ওঠা আলমারি ছিল। সেইটা খুলে বেয়ারা একজোড়া রবারের স্লিপার খাটের কাছে রেখে দিল।
সত্যসুন্দরদা বললেন, তোমাদের দুজনের আলাপ হওয়া প্রয়োজন। বেয়ারার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ইনি আমার গার্জেন, গুড়বেড়িয়া। আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, বস গুড়বেড়িয়া, এই বঙ্গসন্তান নতুন চাকরিতে ঢুকেছেন। শাজাহান হোটেলের ঘোটলাট সায়েব বলে এঁকে জানবে। রোজি মেমসায়েবের ঘরে আপাতত ইনি থাকবেন।
গুড়বেড়িয়া বেচারা বিনয়ে গলে গিয়ে, মাথার পাগড়ি সমেত ঘাড় নামিয়ে আমাকে নমস্কার করলে।
সত্যদা বললেন, গুড়বেড়িয়া, ৩৬২-এ ঘরের চাবিটা নিয়ে এসো। সায়েব ওঁর নিজের ঘরে চলে গিয়ে এখন বিশ্রাম নেবেন।
গুড়বেড়িয়া সঙ্গে সঙ্গে অ্যাবাউট-টার্ন করে প্রায় ছুটতে ছুটতে চাবির সন্ধানে চলে গেল। সত্যদাকে বললাম, বাঃ, বেয়ারাটি বেশ তো।
সত্যদা হেসে ফেললেন, এখন বেশ না হয়ে ওর উপায় নেই। শ্রীমান গুড়বেড়িয়া বর্তমানে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন।
মানে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
আগে তিনতলায় ডিউটি পড়তো ওর। সেদিন আধ ডজন কাপ ভেঙে ফেলায়, কর্তারা এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। হোটেলের অতিথিদের কাছ থেকে বদলি হয়ে শাজাহানের স্টাফের সেবায় আত্মনিয়োগ করাটা অনেকটা বার্মা শেলের চাকরি ছেড়ে মাখনলাল হাজরার গোলদারি মসলার দোকানে খাতা লেখার কাজ নেওয়ার মতো। বেচারাকে হাতে না মেরে ভাতে মেরেছেন ম্যানেজার সায়েব। বকশিশের ফোয়ারা থেকে ছাদের এই মরুভূমিতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এদিকে হেড বেয়ারা পরবাসীয়া নিজের মেয়ের সঙ্গে ওর একটা সম্বন্ধ করছিল। শ্রীমানের এই আকস্মিক ভাগ্যবিপর্যয়ে সেও পেছিয়ে যাবার মনস্থ করেছে। বেচারা এখন তাই আমার সেবা করে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টা করছে। ওর ধারণা, পরবাসীয়া এবং মার্কোগোলো দুজনের উপরই আমার বেজায় প্রভাব। আমার কোনো অনুরোধই ওঁরা নাকি ঠেলতে পারবেন না।
সত্যদা আরও কিছু হয়তো বলতেন। কিন্তু চাবি হাতে গুড়বেড়িয়া এসে পড়াতে তিনি চুপ করে গেলেন। গুড়বেড়িয়া আমাকে বললে, চলুন হুজুর।
সত্যদা বললেন, আমার কি আর তোমার সঙ্গে যাবার প্রয়োজন আছে?
মোটেই না। গুড়বেড়িয়া আমাকে সব দেখিয়ে দেবে।-বলে ওঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
৩৬২-এ ঘরটা যে কয়েকদিন খোলা হয়নি, তা দরজার উপরে জমে ওঠা ধুলো থেকেই বোঝা যাচ্ছে। চাবি খুলে ভিতরের আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েই গুড়বেড়িয়া বোধহয় অন্য কোনো কাজে সরে পড়ল।
ঘরের মধ্যে ঢুকেই আমি কিন্তু বেশ অস্বস্তির মধ্যে পড়লাম। এই ঘরেই যে রোজি থাকত, তা ঢোকামাত্রই ড্রেসিং টেবিলের উপর যতœ করে রাখা প্রসাধন সরঞ্জাম দেখেই বুঝতে পারলাম। যাবার সময় রোজি বোধহয় কিছুই নিয়ে যায়নি। ওর জিনিসপত্তর সবই পড়ে রয়েছে, মনে হল। যেন একটু আগে ছুটি নিয়ে মেয়েটা সিনেমা দেখতে গিয়েছে, এখন আবার ফিরে আসবে। এবং এসেই দেখবে তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে একটা অচেনা পুরুষ গোপনে তার শোবার ঘরে ঢুকে বসে রয়েছে।
এ-ঘরটা ছাদের পূর্বপ্রান্তে। ভিতর এবং বাইরের দেওয়াল ও দরজা ঘন সবুজ রংয়ের। মাথার উপর চটের সিলিঙটা কিন্তু সাদা। ছোট্ট ঘর। একটা খাট, একটা ড্রেসিং টেবিল এবং একটা ওয়াড্রোব প্রায় সবখানি জায়গা দখল করে বসে আছে। চেয়ার আছে কিন্তু মাত্র একটা। কৌতূহলী আগন্তুকদের সংখ্যা সীমাবদ্ধ রাখার জন্যই যেন চেয়ারের এই ইচ্ছাকৃত কৃত্রিম অনটন।
রোজির বিছানার উপর একটা রঙিন চাদর ঢাকা ছিল। তার উপরে বসেই জুতোটা খুলে ফেললাম। জামা ও প্যান্ট পাল্টিয়ে, বাঙালি কায়দায় একটা কাপড় পরতে পরতেই যেন সোঁ সোঁ করে আওয়াজ আরম্ভ হল। আকাশ যে কখন কালো মেঘে ভরে গিয়েছিল খেয়াল করিনি।
প্রকৃতির প্রতি আমাদের ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞাতে বিরক্ত হয়েই যেন, কালবৈশাখ তার ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করলেন।
হাওয়ার দৌরাত্ম্যে ৩৬২-এ ঘরের দরজাটা দেওয়ালের উপর আছড়ে পড়তে আরম্ভ করল। বাইরে থেকে চাবিটা খুলে নিয়ে, ভিতর থেকে দরজায় চাবি লাগিয়ে দিলাম। জানলাগুলোও তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিতে হলÍকিন্তু তার আগেই বৃষ্টির ছাঁট এসে বিছানার কিছু অংশ ভিজিয়ে দিয়ে গেল। মাঝেমাঝে বিদ্যুতের চকমকি জানলার সামান্য ফাটলের মধ্যে দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে আমাকে যেন শাসিয়ে গেল। ওরা যেন বুঝতে পেরেছে, এ-ঘরে আমি অনধিকার-প্রবেশকারী।
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। টিনের ছাদের উপর পাড়ার একদল বিশ্ববকাটে ছোঁড়া যেন অবিশ্রান্তভাবে তবলার চাটি মেরে চলেছে। আমি যে ছাদের মাথায় একটা ছোট্ট ঘরে বসে আছি, মনেই রইল না। যেন লোকবসতি থেকে বহুদূরে কোনো নির্জন দ্বীপে, আমি নির্বাসিত জীবন যাপন করছি। অবশিষ্ট পৃথিবীর সঙ্গে আমার সকল সংযোগ যেন চিরকালের মতো ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।
জামাকাপড়গুলো রাখবার জন্য আলমারিটা খুলেই চমকে উঠলাম। রোজির অনেকগুলো গাউন সেখানে হ্যাঙারে ঝুলছে। পাল্লা খোলামাত্র বাইরের হাওয়া এসে গাউনের ফুলবনে যেন বিপর্যয় বাধিয়ে বসল। সিল্ক, রেয়ন আর নাইলনের অঙ্গবাসগুলো নারীসুলভ চপলতায় খিল খিল করে হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। ওরা যেভাবে ঝুলছে, তার মধ্যেও যেন ভয়ানক কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছেÍপ্রথমে ঘন কালো, তারপর ঘন সবুজ, এবার সাদা, তারপর টকটকে লাল। মাইনের সব টাকাই ভদ্রমহিলা বোধহয় জামা কিনতে খরচ করতেন। আলমারির বাঁদিকের পাল্লাতে ব্রাইট স্টিলের ফ্রেমে বন্দি একটা ছবি যেন ক্রসবিদ্ধ হয়ে রয়েছে।
ফ্রেমের মধ্যে বসে-থাকা মহিলাটিই যে রোজি, তা কেউ বলে না-দিলেও আমার বুঝতে দেরি হল না। এমন সর্বনাশা ভঙ্গিতে কোনো মেয়ে যে নিজের ছবি তুলতে দিতে রাজি হতে পারে, এবং তুললেও নিজের কাছে সযতেœ রাখতে পারে তা এ-ছবিটা না দেখলে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতাম না। রোজির সম্পূর্ণ দেহটা ওখানে নেই। অর্ধেকও নেই। কিন্তু যতটুকু আছে, তার সবটুকুই এক পৈশাচিক প্রভাবে হাসছে। রোজির পুরু ঠোঁট দুটো সামান্য উল্টে রয়েছে। চোখ দুটো যেন নিজেরই দেহের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছে।
ওর চুলগুলো কোকড়াÍআফ্রিকার কোনো গহন অরণ্যের বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া কাহিনির ইঙ্গিত রয়েছে যেন ওই সাপের ফণাওয়ালা চুলগুলোর মধ্যে। এই মেয়ে টাইপ করে! ওর দাঁতগুলো ছবিতে ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে সামান্য উঁকি দিচ্ছে। আলো আঁধারে ছায়াতে ভোলা ছবি। কিন্তু কে যেন ওর দাঁতগুলোর উপর আলো ফেলে সেগুলোকে স্পষ্ট করে তুলেছে। সেই আলোরই খানিকটা আইন অমান্য করে ওর বুকের উপরে এসে পড়বার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রোজি বুঝতে পেরে তা হতে দেয়নি। শিথিল অঙ্গবাস দ্রুতবেগে ঠিক করে নেবার চেষ্টা করছিল।
ওকে ইউরেশীয় ভেবেছিলাম। কিন্তু ছবিতে যেন আর এক মহাদেশের ইঙ্গিত পেলাম। ওর চোখে, মুখে, দেহে সর্বত্র যে মহাদেশটি ছড়িয়ে রয়েছে, তার একসময় নাম ছিল অন্ধকার মহাদেশ–এখন অন্ধকার তুলে দিয়ে শুধু বলে আফ্রিকা।
আর কোথাও রাখবার জায়গা নেই বলেই আমার জামা-কাপড়গুলো আলমারির মধ্যেই ঢোকাতে হলো।
এই ঘরে রোজি নেই বটে, কিন্তু সারাক্ষণই অশরীরিণী রোজি উপস্থিত রয়েছে। এই প্রাচীন হোটেলবাড়ির বিদেহী আত্মারাও বোধহয় রাত্রের অন্ধকারে, ক্যাবারে কনসার্টের কোলাহল থেকে দূরে, এই খালি ঘরখানাতে আশ্রয় নিয়েছিল। গঙ্গার ওপার থেকে কাসুরে এক ছোঁড়া তাদের শান্তির আশ্রয়ে অহেতুক যেন বিঘ্ন ঘটাতে এসেছে। বাইরে বিরক্ত বৈশাখের বৃষ্টি তাই তিক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করছে, কে গা? কে তুমি?
সে-রাত্রের কথা মনে পড়লে, এতদিন পরেও আমার হাসি লাগে। নিজের ছেলেমানুষিতে নিজেই অবাক হয়ে যাই! কিন্তু তখন মনে হয়েছিল, প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে বিরক্ত বৃষ্টি ঝড়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দাপাদাপি শুরু করেছে। শাজাহান হোটেলের শতাব্দী-প্রাচীন আত্মা আরও জোরে জিজ্ঞাসা করছে, কে তুমি? কেন তুমি এখানে?
ঘরের সঙ্গেই বাথরুম। এই কদিন ওটার দিকেও কেউ যেন নজর দেয়নি। বাথটাবের ভিতর খানিকটা সাবানগোলা জল জমা হয়ে রয়েছে। টাবের ফুটোটা বাঁ-হাত দিয়ে খুলে দিলাম। জলটা বেরিয়ে যেতে, কলের মুখটা পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিলাম। তোড়ে জল বেরিয়ে, টাবটা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু বাথরুমের মধ্যেও যেন রোজি রয়েছে। তার সাবানদানি, টয়লেটের সরঞ্জাম, টুথপেস্ট, ব্রাশ অনাদৃত রয়েছে।
………চলবে




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com