মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ন

‘যদি’ শব্দের ব্যবহারে সাবধানতা

জাফর আহমাদ:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

‘যদি এমনটি করতাম তাহলে এমনটি হতো অথবা যদি এমনটি না করে এমনটি করতাম তাহলে আজকে এমনটি হতো না।’ এমন বাক্য ব্যবহার করা মারাত্মক গুনাহ; বরং বলুন, যা হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়েছে- আলহামদুলিল্লাহ। যা হয়েছে, ভালো বা মন্দ, তাতে ধৈর্য অবলম্বন করুন। তা ছাড়া দোয়া করার সময় এমনটি বলা যাবে না যে, ‘হে আল্লাহ! তুমি যদি চাও, আমাকে ক্ষমা করো। হে আল্লাহ! তুমি যদি চাও, আমাকে রহম করো।’ বরং দৃঢ় আশা নিয়েই দোয়া করতে হবে। কারণ কবুল করার জন্য আল্লাহকে বাধ্যকারী বা বাধাদানকারী কেউ নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘মানুষের জন্য আল্লাহ যে রহমতের দরজা খুলে দেন তা রুদ্ধ করার কেউ নেই এবং যা তিনি রুদ্ধ করে দেন তা আল্লাহর পরে আর খুলে দেয়ার কেউ নেই। তিনি পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী’ (সূরা ফাতির-২)। আবু হুরায়রা রা: থেকে বণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ কখনো এ কথা বলবে না যে, হে আল্লাহ! আপনার যদি ইচ্ছা হয়, আমাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনার যদি ইচ্ছা হয়, আমাকে দয়া করুন; বরং দৃঢ় আশা নিয়ে দোয়া করবে। কারণ আল্লাহকে বাধ্য করার কেউ নেই।’ আর সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, ‘সে যেন আগ্রহ নিয়ে দোয়া করে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা তাকে যা দান করেন তা আল্লাহ তায়ালার তেমন কোনো বিশাল জিনিস নয়’ (বুখারি-৬৩৩৯, কিতাবুদ দোয়া, বাবুলিইয়াযিম… ও ৭৪৬৪, কিতাবুত তাওহিদ, আনাস রা: থেকে বর্ণিত- বাবু ফিল মাসিয়াতে ওয়াল ইরাদাতি, মুসলিম-৬৭০৫, কিতাতুল কাদরি, বাবুল আযমে বিদ দোয়া…, ইফা-৫৭৮৭)।
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘শক্তিধর ঈমানদার দুর্বল ঈমানদারের তুলনায় আল্লাহর কাছে উত্তম ও অতীব পছন্দনীয়। তবে প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ নিহিত আছে, যাতে তোমার উপকার রয়েছে তা অর্জনে তুমি আগ্রহী হও এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করো। তুমি অক্ষম হয়ে যেও না। এমন বলো না যে, যদি আমি এমন এমন করতাম তবে এমন হতো না; বরং এ কথা বলো যে, আল্লাহ তায়ালা যা নির্দিষ্ট করেছেন এবং যা চেয়েছেন তাই করেছেন। কেননা, ‘লাউ’ অর্থাৎ‘যদি’ শব্দটি শয়তানের কর্মের দুয়ার খুলে দেয়’ (মুসলিম-৬৬৬৭, কিতাবুত তাকদির, বাব ফিল আমরে বিল…, ইফা-৬৫৩২)।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর তোমাদের চাইলেই কিছু হয় না, যতক্ষণ না আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তা চান’ (সূরা তাকবির-২৯)। অর্থাৎ বান্দার কোনো কাজই নিজের এককভাবে বান্দার নিজের ইচ্ছায় সংঘটিত হয় না। বরং প্রতিটি কাজ কেবল তখনই পূর্ণতা লাভ করে যখন আল্লাহর ইচ্ছা বান্দার ইচ্ছার অনুকূল হয়। এ সূক্ষ্ম বিষয়টি সঠিকভাবে না বোঝার কারণে মানুষের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-ভাবনা অনেক ক্ষেত্রেই হোঁচট খায়। অল্প কথায় বিষয়টি এভাবে বোঝা যেতে পারে, প্রতিটি মানুষ যদি পৃথিবীতে এতটা ক্ষমতা ও শক্তিধর হতো যে, সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে তাহলে গোটা পৃথিবীর নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ত। বর্তমানে এ পৃথিবীতে যে নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে তা এ কারণেই আছে যে, আল্লাহর ইচ্ছা সব ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মানুষ যা-ই করতে ইচ্ছা করুক না কেন তা সে কেবল তখনই করতে পারে যখন আল্লাহর ইচ্ছা হয় যে, সে তা করুক। সুতরাং কেনো মানুষ এমন বলা উচিত নয় যে, এমনটি করলে এমনটি হতো বা এমনটি না করলে আজকে আমাকে এমনটি ভোগ করতে হতো না। কোনো কিছু আহরণ করতে ব্যর্থ হলে, এমনটি বলা যাবে না যে, আহা! যদি এমনটি করতাম তাহলে ব্যর্থ হতাম না। এই ‘যদি’ শব্দটির দ্বারা শয়তান সেই ‘যদি’ ওয়ালাকে বিভ্রান্ত করার সমূহ পথ খুলে দেয়। তার চেয়ে উত্তম কথা হলো- এটি আল্লাহর ফয়সালা। তিনি যেমন চেয়েছেন তেমনটি হয়েছে। কারণ যা চলে গেছে অথবা যা পাওয়া যায়নি বা যা থেকে বি ত হয়েছে তা তো চলেই গেছে। যদি এমনটি করতাম বা না করতাম তাহলে এমনটি হতো বা হতো না, আপনি কি গায়েব জানেন? কি হতো তা আল্লাহই ভালো জানেন।
এ ধরনের কথা দ্বারা মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়। শয়তান বিভিন্নভাবে মানুষের মধ্যে হতাশা-বিষণ্ণতা সৃষ্টি করে। শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ কাজে-কর্মে ও ইবাদত-বন্দেগিতে নিরুৎসাহ ও ভীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। শয়তান তাকে বিভিন্নভাবে অসৎ পথে পরিচালিত করে। যিনি ঈমানদার, যিনি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করেন তিনিই সর্বদা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ইসলাম ও ঈমান মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে উৎসাহিত করে, পক্ষান্তরে নিরাশা, হতাশাকে করে নিরুৎসাহিত। প্রকৃতপক্ষে যিনি আল্লাহকে প্রভু, রাসূল সা:-কে অনুসরণীয় অনুকরণীয় নেতা ও ইসলামকে দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছে তার কি কোনো হতাশা থাকতে পারে? না, কখনো না, হতাশা-নিরাশা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা জুমার-৫৩)। মূলত হতাশা ও নিরাশা হলো শয়তানের বৈশিষ্ট্য। শয়তানের এক নাম ইবলিশ, যার অর্থ হলো ‘নিরাশ’ বা ‘হতাশ’। মানুষ সৃষ্টির পরপরই আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, আদমকে সেজদা করো। কিন্তু সে অহঙ্কারবশত সেই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকৃতি জানাল। তার মধ্যে বর্ণবাদের অহঙ্কার জেগে উঠল। সে যুক্তি পেশ করে বলল, আমি আগুনের তৈরি পক্ষান্তরে আদম মাটির তৈরি, আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সুতরাং আমি তাকে সেজদা করতে পারি না। তার এই অন্ধ যুক্তি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি বিধায় সে হতাশা বা নিরাশার গভীর খাদে নিক্ষিপ্ত হলো। এ জন্য তার এক নাম ইবলিশ অর্থাৎ হতাশ বা নিরাশ হওয়ার কারণে তার নাম ইবলিশ। সে আল্লাহর লানতে নিপতিত হয়ে সেখান থেকে বহিষ্কৃৃত হলো। সে হতাশাগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রধান জীব। সে তার আসল পরিচয় গোপন করে বন্ধু বা হিতাকাক্সক্ষী সেজে হজরত আদম আ:-কে কুপরামর্শ দেয়ার কারণে সে তার নাম শয়তান অর্থ- ‘প্রচ্ছন্ন শক্তি’ হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করল। প্রচ্ছন্নরূপ ধারণ করেই সে মানুষকে ধোঁকা দেয়। সে আসল রূপ বা সত্য কথা বলে মুমিনদেরকে ধোঁকা দিতে পারে না। যেই বিষয়ে সে মানুষকে ধোঁকায় ফেলে, সেটি মানুষের সামনে সুন্দর, চাকচিক্য ও মোহনীয় আকারে উপস্থাপন করে থাকে। যার কারণে মানুষ সাময়িক সেই মরীচিকার পেছনে পাগলের মতো ছুটে চলে।

পক্ষান্তরে আদম আ: ও তাঁর স্ত্রী যখন নিজেদের ত্রুটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেন, তখন তাঁরা নিরাশ না হয়ে করুণার আঁধার গাফুরুর রাহিম মহান রবের ক্ষমার জন্য আশাবাদী হয়ে উঠেন। আল্লাহর প্রতি মজবুত ঈমান ও পূর্ণ তাওয়াক্কুল থাকার কারণে তাঁদের মধ্যে এ আশা জেগে উঠে যে, তাঁদের প্রভু তাঁদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। ফলে তাঁরা বলতে লাগলেন, ‘প্রভু হে! আমরা তো নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেলেছি, এখন যদি তুমি আমাদের ক্ষমা ও দয়া না করো, তাহলে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংসশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (সূরা আরাফ-২৩)। তাঁদের প্রভু তাঁদেরকে নিরাশ করেননি; বরং তাঁদের তাওবা কবুল করে তাঁদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সে দিন আদম আ: যদি তাঁর প্রভুর ব্যাপারে আশাবাদী না হয়ে শয়তানের মতো হতাশ হতেন, তাহলে তাঁর ব্যাপারেও আল্লাহর সিদ্ধান্ত হয়তো বা ভিন্ন হতো। হজরত আদম আ:-এর দোয়া আমরা দেখেছি। তিনি বলেছেন, ‘তা হলে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংসশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’ এখানে ক্ষতিগ্রস্ত বলতে কাদেরকে বোঝানো হয়েছে? এখানে ক্ষতিগ্রস্ত বলতে হতাশাগ্রস্ত ইবলিশকেই বোঝানো হয়েছে।
সুতরাং ‘হতাশা বা নিরাশা’ শয়তানের বৈশিষ্ট্য। আর ‘আশা’ হলো নবী-রাসূল ও আল্লাহর নিয়ামতপ্রাপ্তদের বৈশিষ্ট্য। দুনিয়ার যত আম্বিয়ায়ে কেরাম এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই দুনিয়াজোড়া বিপদ মাথায় নিয়েও তাঁদের পথে অটল ছিলেন। হতাশা কখনো তাঁদের পথরোধ করে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ তাঁরা জানতেন, আল্লাহর মহানত্বের সামনে এ ধরনের আপদ-মুসিবত একবারেই তুচ্ছ। ‘যদি’ হতাশার দরজাকে উন্মুক্ত করে দেয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com