বৃষ্টিতে ঢাকার জলাবদ্ধতার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, প্রাকৃতিক ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ধ্বংস, অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা, শহরের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত অবকাঠামো, পুকুর, খাল, ঝিল দখল প্রধানত এই চার কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দাবি, চলতি বছরে বর্ষা মৌসুমের আগে জলাবদ্ধতা নিরসনে তারা বেশ কিছু কাজ করেছেন। ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দীর্ঘ ৩৪ বছর পর শাখা-প্রশাখাসহ ১১টি অচল খাল, বর্জ্যে জমাটবদ্ধ পাঁচটি বক্স কালভার্ট ও প্রায় ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে নর্দমার মালিকানা নিয়েছে সংস্থাটি। দায়িত্বভার গ্রহণের পর এসব খাল, বক্স-কালভার্ট ও নর্দমা থেকে বর্জ্য অপসারণ, সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্ত কার্যক্রম শুরু করে তারা।
তাদের ভাষ্য, এসব খাল, বক্স-কালভার্ট ও নর্দমা থেকে ২০২১ সালে আট লাখ ২২ হাজার টন, ২০২২ সালে চার লাখ ৪৪ হাজার টন এবং ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ টন বর্জ্য ও পলি অপসারণ করা হয়েছে বলে দাবি সংস্থাটির কর্মকর্তাদের। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে নিজস্ব অর্থায়নে ২২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গত তিন বছরে ১৩৬টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন করেছে ডিএসসিসি। ফলে জলাবদ্ধতার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। কিন্তু নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অনেক কারণের মধ্যে প্রধান চার কারণে ডুবেছে ঢাকা। এর মধ্যে প্রাকৃতিক ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ধ্বংস, অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা, শহরের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত অবকাঠামো, পুকুর, খাল, ঝিল দখল অন্যতম।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘সিটি করপোরেশন মূলত নতুন লাইন তৈরিতে ব্যস্ত। কিন্তু যেসব ড্রেন আছে সেগুলোর কোথায় কোথায় ব্লক হয়েছে তা পরিষ্কার করার ব্যাপারে তারা মনোযোগী নয়। ফলে বেশি কাজ দেখানোর জন্য নতুন করে ব্যাপক অর্থ খরচ করা হলেও পুরো নেটওয়ার্কিং না হওয়ায় এর সুফল মিলছে না।’
ঢাকা শহর প্রকৃতিগতভাবে জলাবদ্ধ হওয়ার কথা না মন্তব্য করে, নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলছেন, ভরা বর্ষায় ভারী বৃষ্টি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু জলাবদ্ধতা হয়েছে মূলত অসংখ্য পুকুর, খাল, ঝিল দখলের কারণে। এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে ড্রেনেজ ব্যবস্থাও। এতে সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা যদি শহরের ভেতরে পুকুরগুলো রাখতে পারতাম তা হলে এ ঘটনা ঘটার কোনো সুযোগই ছিল না। এখন নদীর পানির উচ্চতা নিচে থাকা সত্ত্বেও শহরের পানি ৬-৮ ঘণ্টার জন্য আটকে যাচ্ছে। কারণ এখন অসংখ্য ঝিল, বিল, খাল বিলীন হয়েছে। পশ্চিম দিকে বাঁধ দিয়ে শহরকে নদীর সাথে সংযোগহীন করে ফেলেছি। হাতিঝিলের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আজকে হাতিরঝিল ছিল বলে গুলশান ডুবেনি। তাই এখন প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে হলেও প্রতিটি অ লভিত্তিক পরিকল্পিত নেটওয়ার্ক তৈরি করে নদীর সাথে কানেক্ট করে দেয়া উচিত।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খানের ভাষ্য, এই শহরে যে পরিমাণ ভবন ও অবকাঠামো ধারণ করতে পারে তার কয়েকগুণ বেশি ভবন, অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার প্রাকৃতিক ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কৃত্রিম যে ড্রেনেজগুলো বানানো হয়েছে তা এই সংখ্যক পপুলেশনের ভার বহন করার মতো অবস্থায় নেই। তাই আইডিয়াল বৃষ্টিপাতেই নগরের ড্রেনেজ চ্যানেলের ওপর ৫০ ভাগ চাপ পড়ে।
তিনি বলেন, আমাদের বৃষ্টিপাতের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ পানির চাপ সরাসরি যে ড্রেনেজ দিয়ে যায় তা এই পরিমাণ পানি ধারণ করার জন্য সক্ষম না। এসবের জন্য সিটি করপোরেশন আর সরকারের মধ্যে গলদ রয়েছে। ফলে আজ এমনটি হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: শাহ আলম খান বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনের উপায় দুটো। ভূগর্ভে পানি শোষণ করে নেয়া এবং খাল, বিল ও ড্রেন দিয়ে নদীতে চলে যাওয়া। জলাশয় আর খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়াতে প্রাকৃতিক সিস্টেম যেহেতু ধ্বংস হয়ে গেছে তাই কৃত্রিম সুযোগ তৈরি করতে হবে পানি যাওয়ার। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশনের কাজে এমন কোনো পরিকল্পনা না থাকায় নগরবাসীকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।’
ড্রেনেজ নিষ্কাশনের জন্য সিটি করপোরেশনের কাজ কার্যকর হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, খালগুলো পুনরুদ্ধার করা, খনন করা ও সচল রাখার জন্য সর্বাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সিটি করপোরেশন ওয়াসার থেকে দায়িত্ব নেয়ার পর যতটা কার্যকর হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। এসবে জনগণকে সম্পৃক্ত ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। তাহলে হয়তো এর সমাধান সম্ভব।