ইদানীং প্রায়ই নাস্তিকদের মুখে একটি কথা শোনা যায়, এমন : বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিপ্লবের এই যুগে আপনি একজন আধুনিক মানুষ, এই আধুনিক বিশ্বে আপনি বসবাস করেও আপনি কিভাবে স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন! অথবা তারা এভাবেও বলে যে, একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে আপনি কিভাবে স্রষ্টায় বিশ্বাসী! বাস্তবতা এই, আমাদের আলস্য ঘুমের মধ্য দিয়েই বিধর্মীরা একটি ধর্মহীন পৃথিবী তৈরির পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এতে তারা আমাদের বিপরীতে সফল। বর্তমানে অবস্থাটা এমন যে, ধর্মবিশ্বাস যেন সবচেয়ে বড় ‘নির্বুদ্ধিতা’! অর্থাৎ আপনার জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা, প্রজ্ঞা সবই বৃথা যদি আপনি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন।
অথচ বিজ্ঞান এ কথা প্রমাণ করে যে, স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস এটি একটি সহজাত বিষয়। পৃথিবীতে এমন কোনো গোত্র জাতি কিংবা সভ্যতা পাওয়া যায় না, যারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিল না। এই গবেষণা থেকেই প্রতীয়মান হয়, স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষ যে পরিবেশেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন, অথবা যে পরিবেশেই তার বেড়ে ওঠা হোক, সে তার জন্মলগ্ন থেকেই স্রষ্টায় বিশ্বাসী হয়ে জন্মে এবং বেড়ে ওঠে। এই পুরো প্রক্রিয়ার জন্য তার কোনো ব্যক্তি অথবা পা-িত্য অর্জনের সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এটি একটি সাধারণ ও স্বাভাবিক মানবীয় গুণ। যেটিকে ইসলামের শাস্ত্রীয় ভাষায় ‘নূরে ফিতরাত’ বলা হয়। যার বাংলা অর্থ হলো সহজাত প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ জন্মকাল থেকেই তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস নিয়েই জন্ম গ্রহণ করে। সময়ের সাথে সাথে তারা তাদের পরিবার এবং সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হয় অথবা বাধার সম্মুখীন হয়ে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস থেকে সরে আসে।
রিচার্ড ডকিংস হলো এই যুগের নাস্তিকদের আইডল। অথচ তিনি নিজের বিশ্বাস সম্পর্কে লিখেন, উব ভধপঃড় ধঃযবরংঃ, অর্থাৎ তিনি শতভাগ নিশ্চিত না যে স্রষ্টা আছেন কি নেই। অথচ তার অনুসারী কিছু নির্বোধ ‘ডকিংস ডকিংস’ করে চেঁচামেচি করলেও তার মতাদর্শে শতভাগ প্রতিষ্ঠিত নয়। বেশির ভাগ নাস্তিকই বিজ্ঞান দিয়ে নাস্তিকতাকে প্রমাণ করতে চায়। অথচ স্রষ্টায় বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাস কোনোটিই বিজ্ঞানের বিষয় নয়। বিজ্ঞানের বিষয় হচ্ছে- কিভাবে হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। আর ধর্ম দর্শন হচ্ছে যা কিছু আছে এবং যে ঘটনাগুলো ঘটছে তার পেছনে কোনো সত্তা আছে কিনা তা খুঁজে বের করা। যদি পৃথিবী সৃষ্টির পেছনে কোনো স্রষ্টা না থাকে তাহলে বলতে হবে আপাত দৃষ্টিতে উদ্দেশ্য পাওয়া গেলেও বাস্তবে এই জগত ও জীবনের কোনো অর্থ বা উদ্দেশ্য নেই। তো যেখানে এই জগত ও জীবনের কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থ ও উদ্দেশ্য নেই সেখানে মানবতা, ন্যায়পরায়ণতা, সামাজিক মূল্যবোধ- কোনো কিছুরই কোনো অর্থ নেই। নাস্তিকতার যুক্তি আমাদের সে কথাই বলে।
তাহলে প্রশ্ন আসে, সত্যিই কি নাস্তিকতা বা সেক্যুলার হিউম্যানিজম নৈতিকতা ও জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো কিছু আছে? উত্তর হলো- প্রত্যেক কাজের জন্য কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আরোপ করা এবং নৈতিকতার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা ব্যতীত মানুষের পৃথিবীতে জীবনযাপন করা অসম্ভব। তাই বাহ্যিকভাবে উদ্দেশ্য ও নৈতিকতার কথা তারা অবশ্যই বলে। কিন্তু চিরন্তর কোনো উদ্দেশ্য এবং তাৎপর্য না থাকায় যে যেখানে যেভাবে পারে সে সেখানে সেভাবেই সুবিধা অনুযায়ী নিজের লক্ষ্য পূরণ করার চেষ্টা করবে, এটিই হচ্ছে নাস্তিক্যবাদী নৈতিকতার মূল কথা।
ফলে নাস্তিক্যবাদী নৈতিকতার অনুসারীদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে মানবতাবাদী যেই নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায় সেটি তাদের নাস্তিক্যবাদী তত্ত্বের সাথে মেলে না। একদিকে তারা চিরন্তন মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে অস্বীকার করতে পারে না অন্যদিকে সেগুলোর দাবি হিসেবে আল্লাহ তায়ালাকে মেনে নেয়ার ব্যাপারটি ও তারা গ্রহণ করে না। সুতরাং বলতে হবে নাস্তিক্যবাদী তত্ত্ব ও তাদের জীবন দৃষ্টি পরস্পর সাংঘর্ষিক। ফলে বোঝা যায়, তাদের জীবন দৃষ্টি পুরোটাই ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ। পক্ষান্তরে মানব সৃষ্টির শুরু থেকে এই পৃথিবীর মানুষ স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিল। এটিই বাস্তব সত্য কথা এবং যৌক্তিক। যেহেতু পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ আজও স্রষ্টায় বিশ্বাসী। আর নাস্তিকতার শুরু মূলত কয়েক যুগ ধরে। বাস্তব অভিজ্ঞতা অন্তত এটিই বলে, স্রষ্টায় বিশ্বাস মানুষের মধ্যে হঠাৎ করে আসেনি বরং স্রষ্টা নেই এই বিশ্বাসটিই এসেছে এই শতাব্দীতে। ২০০৪ সালে সমস্ত পৃথিবীতে নাস্তিকদের নেতৃত্ব দেয়া একটি সুপরিচিত নাম এন্টনি ফ্লিউ। জীবনভর গবেষণা ও দার্শনিক অনুসন্ধানের পর সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই মহাবিশ্বের অবশ্যই একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনি বলেন, আমার সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করার জন্যে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন আইনস্টাইনসহ আরো অনেক বিজ্ঞানী। তিনি বলেন, আইনস্টাইনসহ আরো বহু বিজ্ঞানী তাদের সুক্ষদর্শিতার মাধ্যমে এই মত ব্যক্ত করেছিলেন- এই মহাবিশ্বের অন্তর্নিহিত ও সুসংহত জটিলতার পেছনে একজন মহাশক্তিমান এবং মহাজ্ঞানী স্রষ্টার ভূমিকা আবশ্যক। তা ছাড়া আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে এই উপসংহারে পৌঁছেছিলাম যে, জীবন ও জীবনের বৈচিত্রময় জটিলতাগুলো মহাবিশ্বের জটিলতাগুলোর চেয়েও বেশি জটিল। যা শুধু একটি মহা বুদ্ধিমান সত্তার দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়।
মজার বিষয় হচ্ছে, নাস্তিকরা সবসময় এই অভিযোগ করে যে, সাধারণত অশিক্ষিত অজ্ঞ লোকরা তাদের অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে কোনো কিছু চিন্তাভাবনা না করেই ধর্মবিশ্বাসী হয়ে থাকে। নাস্তিকদের যুক্তি ও সব দর্শন জানতেন। এমনকি ৩০টির মতো বই রচনা করেছিলেন। এমনকি বর্তমান নাস্তিকরা যে সব যুক্তি দর্শন দাঁড় করাতে চেষ্টা করে তার অনেকগুলোই তিনি বহু আগেই তার বইয়ে উল্লেøখ করেছেন। কিন্তু যেহেতু তিনি অজ্ঞতার চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তাই শেষ পর্যন্ত স্রষ্টায় বিশ্বাসের উপসংহারে নির্দেশ করেছিলেন। স্বীকার করে নিয়েছিলেন, এ মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা থাকা আবশ্যক।
আল্লøাহ তায়ালা কুরআনে কারিমের ইরশাদ করছেন- ‘তারা কি কোনো স্রষ্টা ছাড়াই এমনি এমনি সৃষ্টি হয়ে গেছে, নাকি তারা বলে যে, তারা নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা, নাকি তারা নিজেরাই এই মহাকাশ ও ভূম-ল সৃষ্টি করেছে।’ (সূরা তুর : ৩৫-৩৬)
এই আয়াতে কোনো কিছু সৃষ্টি হওয়ার যৌক্তিক কারণ ও সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে মূলত এর বাইরে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। সম্ভাবনাগুলো হলো- মানুষ অথবা মহাবিশ্ব শূন্য থেকে একা একাই সৃষ্টি হয়ে গেছে। এই সম্ভাবনা নাস্তিকদের যুক্তিতেই বাতিল। কেননা, তাদের দর্শন হলো- হড়ঃযরহম পধহ হড়ঃ পৎবধঃব ধহুঃযরহম. এটি মূলত নাস্তিকদেরই দাবি। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হলো- মহাবিশ্ব এবং মানুষ নিজেকে নিজেই সৃষ্টি করেছে। এটিও সব তত্ত্ব অনুযায়ী যুক্তিহীন। কারণ কেউ নিজেকে সৃষ্টি করতে হলে আগে নিজেকে অস্তিত্বে আনতে হবে। সুতরাং বুঝা যায়, মানুষ কিংবা মহাবিশ্বের অস্তিত্ব তখনই আসা সম্ভব যখন মানুষ কিংবা গোটা মহাবিশ্বকে এমন কেউ সৃষ্টি করেছে যে নিজের সৃষ্ট নয়। এটিই জ্ঞানীদের কাছে অধিক যুক্তিযুক্ত কথা। যার সাক্ষ্য আদিকাল থেকে আজকের এই নব শতাব্দী পর্যন্ত প্রকৃত জ্ঞানীরা, প্রকৃত দার্শনিকরা এবং প্রকৃত চিন্তাশীল মানুষেরা সাক্ষ্য দিয়ে আসছে। (নয়াদিগন্ত অনলাইন) লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ