বিগত সাত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমেছে এক তৃতীয়াংশ ও ইউরোপের বাজারে কমেছে ১৪.৫০ শতাংশ। গতকাল মঙ্গলবার পোশাক শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ উদ্বেগের কথা জানান বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান। তবে রপ্তানি ধরে রাখতে বিজিএমইএ নতুন বাজারগুলোতে রপ্তানি বাড়াতে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
ফারুক হাসান বলেন, বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পও চাপে রয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছর ন্যূনতম নতুন মজুরি কার্যকর হলে পোশাক শিল্প আরও চাপের মুখে পড়বে। এছাড়া পোশাক রপ্তানির আড়ালে ১০ কোম্পানির ৩০০ কোটি টাকা পাচার’ বিষয়ে প্রচারিত সংবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অভিযোগ তদন্ত না করেই ঢালাওভাবে প্রচার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বিজিএমইএ। এই সংবাদে পোশাক শিল্পের ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে এর নিন্দা জানিয়েছে সংগঠনটি।
অন্যএকটি সূত্রে প্রকাশ, ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে বাংলাদেশের অংশ ছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ, কিন্তু গত বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। গত ১৭ বছরে বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যতম বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে বাংলাদেশের অংশ ছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ, কিন্তু গত বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০০ সালে বাংলাদেশ ৪ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছিল। তবে, গত ২২ বছরে রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং গত বছর পোশাক রপ্তানি থেকে ৪৫ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে।
গত দুই দশকে পোশাক খাতের এই সম্প্রসারণের পেছনে কয়েকটি কারণ আছে এবং চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে। একইসঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব বেড়েছে। পোশাক খাতের এই সম্প্রসারণের অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে সম্প্রসারিত প্রাইমারি টেক্সটাইল খাত, যেখানে ইতোমধ্যে ২৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। ফলে, নিটওয়্যার সেগমেন্ট বর্তমানে দেশীয় বাজার থেকে ৯০ শতাংশেরও বেশি পোশাক ও সুতা পাওয়া যাচ্ছে।একইভাবে, ওভেন রপ্তানিকারকরা স্থানীয়ভাবে ৪০ শতাংশেরও বেশি কাপড় সংগ্রহ করতে পারছেন। ঠিক একইভাবে অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খাত দেশীয় বাজার থেকে তাদের চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করতে পারছে।
চীনের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছে। যেমন- ২০০০ সালে বৈশ্বিক পোশাক শিল্পে চীনের অংশ ছিল ১৮ দশমিক ২ শতাংশ, ২০০৫ সালে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু, ২০১৮ সালে শুরু হওয়া বাণিজ্যিক লড়াইয়ের কারণে ২০২২ সালে চীনের অংশ কমে হয়েছে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ। সুতরাং, যখন বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব প্রসারিত হচ্ছে, তখন চীন তার দখল হারাচ্ছে। আরেকটি আশার কথা হলো- তুলা ও মূলধনী যন্ত্রপাতির মতো কাঁচামালের ঘাটতি এবং জ্বালানি নিয়ে চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আরও বেশি বাজার দখল করছে। বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী এবং বিশ্বব্যাপী বৃহত্তম ডেনিম সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় রপ্তানিকারকরা জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো এশীয় বাজারগুলো ধরার চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে এসব দেশের বাজারে রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে এবং রপ্তানি বৃদ্ধির আরও জায়গা আছে। বাণিজ্য বিরোধের কারণে শুধু মার্কিন ক্রেতারা নয়, ইউরোপীয় ও জাপানের খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ডগুলোও চীন থেকে সরবরাহ কমাতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ১০০ ডলার মূল্যের জ্যাকেটের মতো উচ্চমানের পোশাক উৎপাদন শুরু করেছে, কয়েক বছর আগেও যা প্রায় অসম্ভব ছিল। বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে বাংলাদেশকে অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। তবে স্থানীয় রপ্তানিকারকরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে প্রতিযোগীদের ছাড়িয়ে গেছে এবং অন্যান্য বাজারেও একই সাফল্যের পুনরাবৃত্তির করতে চায়।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৫৩ শতাংশ বেড়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। তবে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-এপ্রিল সময়কালে উচ্চ ভোক্তা মূল্যের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সরবরাহ প্রায় ১৭ শতাংশ কমেছে, চীনের কমেছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের বিক্রি বাড়বে। এদিকে, এশিয়ার বাজারে প্রবৃদ্ধি ও গার্মেন্টস পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় ও বাজার শেয়ার ১৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিজিএমইএ।