শিশু-কিশোরদের মন খুবই সরল, কোমল ও পবিত্র। রাসূলে কারিম সা: শিশুদের প্রতি কোমল ব্যবহার নিজে করেছেন এবং অন্যদেরও করার নির্দেশ দিয়েছেন। একবার তাঁর কানে হজরত হোসাইনের কান্নার আওয়াজ এলে তিনি ব্যথিত হয়ে হজরত ফাতিমা রা:-কে ডেকে বললেন, ‘তুমি কি জানো না, তার কান্না আমাকে কষ্ট দেয়।’ এমনকি কোনো শিশুর কান্না শুনতে পেলে তিনি নামাজ সংক্ষিপ্ত করে নিতেন। প্রিয়নবী সা: ছয় পুত্র-কন্যার অধিকারী হয়েছিলেন। কিন্তু একমাত্র হজরত ফাতিমা রা: ব্যতীত বাকি সবাই তাঁর জীবদ্দশাতেই ইন্তেকাল করেন। তিনি হজরত ফাতিমা রা:-কে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘ফাতিমা আমার কলিজার টুকরা।’ সাহাবি হজরত আনাস রা: বলেন, আমি রাসূল সা:-এর চেয়ে আর কাউকে সন্তানের প্রতি এত অধিক ভালোবাসা প্রকাশ করতে দেখিনি। (আল-আদাবুল মুফরাদ) পুত্র ইবরাহিমের মৃত্যুর পর রাসূলে কারিম সা:-এর পবিত্র চোখ অশ্রু প্লাবিত হয়ে উঠেছিল। কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, ‘চোখ অশ্রুবর্ষণ করছে, অন্তর শোকাহত কিন্তু মুখে তাই বলব আল্লাহ তায়ালা যা করেন’ (আল-আদাবুল মুফরাদ)।
মহানবী সা: দৌহিত্র হজরত হাসান ও হোসাইন রা:-কে সীমাহীন আদর-স্নেহ করতেন। একবার রাসূল সা: হজরত হাসান-হোসাইনকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একজন রসিকতা করে বললেন, আহা! কি বাহনই না পেয়েছে। রাসূল সা: জবাবে বললেন, ‘আরোহীরা কে তা তো দেখবে।’ একবার মসজিদে খুতবা দেয়ার সময় হজরত হাসান-হোসাইন লাল জামা পরিধান করে কম্পিত পায়ে নানার দিকে এগিয়ে এলেন। রাসূলে কারিম সা: এদের দেখে আর থাকতে পারলেন না। তিনি খুতবা স্থগিত রেখে তাদেরকে কোলে তুলে সামনে এনে বসিয়ে তারপর খুতবা শুরু করলেন (সুনানে ইবনে মাজাহ)। তিনি অন্য শিশুদেরও খুবই ভালোবাসতেন, তাদের কোলে তুলে নিতেন, চুমু খেতেন, সুন্দর নাম রাখতেন। মুখে খেজুর চিবিয়ে দিতেন। সফর থেকে ফেরার পর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের উটের সামনে-পেছনে বসাতেন ও তাদের সাথে কৌতুক করতেন।
রাসূল সা:-এর জীবনে শিশু-কিশোরদের প্রতি ভালোবাসার অনেক ঘটনা বিদ্যমান। তন্মধ্যে হজরত জায়িদ বিন হারেসা রা:-এর প্রতি ভালোবাসার ঘটনা অন্যতম। ওকাজ মেলা থেকে জায়িদকে কিনে এনেছিলেন হজরত খাদিজা রা:। তিনি রাসূল সা:-এর স্নেহ-মমতায় বড় হতে লাগলেন। তাকে ঘরে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য জায়িদের পিতা ও চাচা রাসূল সা:-এর কাছে আসেন এবং জায়িদকে ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে যেকোনো পরিমাণ ধনরাশি দিতে প্রস্তুত ছিলেন। রাসূল সা: জায়িদকে বললেন, ‘তুমি ইচ্ছা করলে তোমার বাবা-চাচার সাথে যেতে পারো, আর ইচ্ছা করলে আমার সাথেও থাকতে পারো।’ হজরত জায়িদ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করল যে, আব্বা ও চাচার কাছে থাকার চেয়ে রাসূলের সাথে থাকাই তার পছন্দ, তখন রাসূলে কারিম সা: জায়িদকে হারাম শরিফে নিয়ে গিয়ে ঘোষণা করলেন, আজ থেকে পরবর্তীকাল পর্যন্ত জায়িদের পরিচয় হবে ‘জায়িদ ইবনে মুহাম্মদ’ নামে। জায়িদ যেমন পিতা-মাতাকে ছেড়ে রাসূলে কারিম সা:-কে বেছে নেন, তেমনি রাসূল সা:-ও তাকে গভীরভাবে ভালোবাসলেন। কোনো এক অভিযান শেষে হজরত জায়িদ রা: মদিনায় ফিরে এসে হজরত আয়েশা রা:-এর ঘরের কড়া নাড়লেন। রাসূলে কারিম সা: প্রায় খালি গায়ে উঠে দাঁড়ালেন। তখন তার দেহে নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত এক প্রস্থ কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এ অবস্থায় কাপড় টানতে টানতে তিনি দরজার দিকে দৌড়ে গেলেন। তার সাথে গলাগলি করলেন ও চুমু খেলেন। এই জায়িদের পুত্র উসামার প্রতি মহানবী সা:-এর ছিল গভীর ভালোবাসা। শিশু উসামা একবার দরজার চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। তার কপাল কেটে রক্ত বের হতে লাগল। রাসূলে কারিম সা: প্রথমে হজরত আয়েশা রা:-কে রক্ত মুছে দিতে বললেন কিন্তু তাতে তিনি স্বস্তি পেলেন না। পরে তিনি নিজেই উঠে গিয়ে রক্ত মুছে ক্ষতস্থানে চুমু দিতে লাগলেন এবং মিষ্টি মধুর কথা বলে তাকে শান্ত করতে লাগলেন।
মহানবী সা: শিশুদেরকে কত গভীরভাবে ভালোবাসতেন তা বোঝা যায় একটি হাদিস থেকে। রাসূলে কারিম সা:-এর কাছে এক শিশুকে আনা হলে তিনি তাকে চুম্বন করলেন এবং বললেন, ‘এরা মানুষকে ভীরু ও কাপুরুষ করে দেয়, আর এরা হলো আল্লাহ ফুল’ (জামে তিরমিজি)। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা: বলেন, একবার এক গ্রামবাসী বেদুইন রাসূলে কারিম সা:-এর কাছে উপস্থিত হয়। তখন রাসূল সা: একটি শিশুকে চুমু দিচ্ছিলেন। লোকটি বলল, আপনারা শিশুদের চুমু খান? আমরা তো এমনটি করি না। তখন রাসূল সা: বললেন, ‘মহান আল্লাহ তায়ালা যদি তোমার হৃদয় থেকে ভালোবাসা ও দয়াপ্রবণতা কেড়ে নেন, তবে আমি কী করতে পারি’ (বুখারি ও মুসলিম)?
জনৈক ব্যক্তি তার দুই সন্তানের একজনকে চুমু দিলো এবং অপরজনকে চুমু দিলো না। এটি দেখে রাসূলে কারিম সা: তাকে বললেন, ‘তুমি উভয়ের মধ্যে সমতা বিধান করলে না কেন?’ রাসূলে কারিম সা: সন্তানদেরকে সুশিক্ষা দেয়ারও নির্দেশ দেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নিজেদের সন্তানদের স্নেহ করো এবং তাদেরকে শিষ্টাচার শিক্ষাদান করো’ (মুসলিম)। তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেয়া দান-খয়রাতের চেয়েও উত্তম।’ শিশুদের উত্তম ও উপযোগী শিক্ষাদানের জন্য রাসূলে কারিম সা: ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞান দান করো। কেন না, তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট’ (মুসলিম)।
শিশুদের কোমল ও পবিত্র মনে যদি একবার কোনো খারাপ ধারণা প্রবেশ করতে পারে তবে তা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে থেকে যায়। তাই রাসূলে কারিম সা: শিশু-কিশোরদের সাথে খেলাচ্ছলে মিথ্যা বা প্রতারণা করতে নিষেধ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের রা: বলেছেন, একদিন আমার মা আমাকে ডাক দিয়েছেন। এ সময় রাসূলে কারিম সা: আমাদের ঘরে বসা ছিলেন। মা আমাকে বললেন, এ দিকে আসো, আমি তোমাকে একটি জিনিস দেবো। তখন রাসূল সা: জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি তাকে কী দিতে চাও।’ আমার মা বললেন, আমি তাকে খেজুর দিতে চাই। রাসূলে কারিম সা: বললেন, ‘তুমি তাকে কিছু দেয়ার জন্য ডেকে যদি না দিতে তাহলে তোমার আমলনামায় তা মিথ্যা হয়ে যেত।’
রাসূলে কারিম সা:-এর সুমহান শিক্ষাকে সামনে রেখে যদি আধুনিক ও ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষায় গড়ে তোলা যায় তবে পিতা-মাতা, সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের সেবা লাভে উপকৃত হবে। এমন পরিবারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের করুণা ও কল্যাণ সর্বদাই বর্ষিত হতে থাকবে। (সংকলিত) লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক