উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিকতায় ছোয়ায় কালের বিবর্তনে বরিশাল জেলার বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে দেড়শ’ শতাধিক বছরের ধানচালের ভাসমান হাট তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। সুদুর ব্রিটিশ-ভারত যুগে ধান চালের বেচাকেনা ও প্রক্রিয়াজাত করনের জন্য বানরীপাড়ার এ ভাসমান হাট দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্রের রূপ নিলেও সাম্প্রতিককালে তা আর ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছে না। আধুনিকতার ছোয়ার সাথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা সীমাদ্ধতায় ধান-চালের ব্যবসা বিকেন্দ্রীকরন হয়েছে গত এক দশকে। ফলে বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীর ভাসমান হাটটি কালের পরিক্রমায় এখন হারিয়ে যাবার পথে। শতাব্দীকালেরও আগে থেকে ‘বরিশালের বালাম চাল’এর যে সুখ্যাতি ছিল, তার বড় মোকাম ছিল এ ভাসমান হাট। এমনকি সেই বালাম চাল প্রক্রিয়াজাত করা হতো বানারীপাড়ায়ই। উচ্চ ফলনশীল ধানের নতুন জাতের আবাদ বাড়ায় ইতিমধ্যে বালাম চাল’এর প্রচলন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। আর এরই সাথে এ ভাসমান হাটের সুনাম সুখ্যাতিতেও ভাটা পড়েছে। হাটের পরিধি সংকুচিত হয়েছে। দূর দূরান্তের ব্যবসায়ী, কৃষক ও কুঠিয়ালরা ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন এ ভাসমান হাট থেকে। বালাম ছাড়াও অন্যান্য চালের চাহিদা ও সুনামের জন্য ঢাকা, ফরিদপুর, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, পটুয়াখালী, সনদ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকার শত শত ফরিয়া এখানে এসে সপ্তাহে দুদিন চাল কেনাবেচা করত। এমনকি সিলেট, ভৈরব, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সনদ্বীপ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝিনাইদহ ও যশোরের ব্যবসায়ীরা তাদের এলাকায় উৎপন্ন ধান বিক্রি করতেও নৌপথে বানারীপাড়ার ভাসমান হাটে আসতেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধান চালের ব্যবসার উপরই বানারীপাড়ার অন্যান্য ব্যবসাও নির্ভরশীল ছিল। নিকট অতীতেও এ হাটে ধান থেকে চাল। উৎপাদনকারীÑকুটিয়ালদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার। নব্বই দশকের শেষ অবধি ৫ সহ¯্রাধিক পরিবার এ পেশার উপর নির্ভরশীল ছিল। উপজেলায় যে শতাধিক ধান ছাটাই কল বা রাইচ মিল ছিল, তার সংখ্যা এখন হাতেগোনা। স্থানীয় ৭০ ভাগ মানুষ এ ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরক্ষোভাবে জড়িত থাকলেও এখন সে সংখ্যা ১০ ভাগেরও কম। শনি ও মঙ্গলবার বানারীপাড়ায় ধান-চালের এ ভাসমান হাট বসলেও আগের দিনের রেশ ধরে রবি ও বুধবারেও বেচাকেনা চলে এ হাটে। তবে রবি ও বুধবারের হাটকে বলা হয় ‘গালার হাট’। নিকট অতীতেও উপজেলার নলশ্রী, দিদিহার, দান্ডয়াট, বাইশারী, মসজিদ বাড়ী, আউয়ার, কালির বাজার, খোদা বখস, মলঙ্গা, চাখার, বাকপুর, ঝিরারকাঠী, ভৈৎসর, চালিতাবাড়ী, চাউলাকাঠী, কাজলাহার, ব্রাক্ষ্মনকাঠী, জ¤ু^দীপ, নাজিরপুর সহ আশপাশের এলাকার ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষের জীবিকা এ হাটের উপর নির্ভরশীল ছিল। হাট থেকে ধান কিনে বাড়িতে নারী-পুরুষ সম্মিলিত শ্রমে তা প্রক্রিয়াজাত করে চাল তৈরী করে এ ভাসমান হাটেই বিক্রি করছেন। তবে তাদেরকে স্থানীয় মহাজনদের হাতে শোষিত ও বঞ্চিত হওয়ায় ধীরে ধীরে বিকল্প পেশা খুজে নিয়েছেন অনেকেই।এক সময়ে বানারীপাড়া বন্দর বাজার, পশ্চিম পাড় দান্ডয়াট থেকে শুরু করে রায়েরহাট পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার জুরে নদীতে ভাসমান অবস্থায় হাজার হাজার নৌকায় ধান চালের হাট বসলেও বর্তমানে বানারীপাড়ার লঞ্চঘাট সংলগ্ন সন্ধ্যা নদীতে ভাসমান চালের হাট এবং নদীর পশ্চিম পাড়ের দান্ডয়াটে একইভাবে ধানের হাট মিলছে। নানা কারনে ১৯৮৯-৯০ সালে মহাজনদের সাথে ব্যাপক সংঘাত আন্দোলনের রূপ নেয়। যার প্রভাব পড়ে এ ভাসমান হাটের উপরও। মহাজনদের সাথে কুটিয়ালদের দীর্ঘস্থায়ী বিরোধে সাধারন ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বিভিন্ন জেলা উপজেলা সদরে বিকল্প হাটবাজার গড়ে তোলে। যাতে করে গত এক দশকে কুটিয়াল পরিবারের সংখ্যা ৫ হাজার থেকে কমে ১ হাজারে নেমে এসেছে। বেশিরভাগ কুটিয়ালই তাদের মূলধন হারিয়ে ফেলায় গত দেড় দশকে বানারীপাড়ার ধানচালের ব্যবসা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। অনেকেই নৌকা বিক্রি করে দিয়েছেন। আড়ৎদাররা তাদের ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। বানারীপাড়ার আড়ৎদারপট্টির বহুঘর এখন ভাড়াটিয়াবিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। এ ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রায় ৪০ হাজার মানুষ এখন অর্থকষ্টে। বানারীপাড়ার এ ব্যবসা বন্ধ হওয়ার কারন সম্পর্কে খোজ নিয়ে জানা গেছে, ধান চাল কেনা বেচার জন্য যে সকল স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা আসত সেই সকল স্থানে নতুন মোকাম গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাল উৎপাদন হওয়ায় খরচ অনেক কম। তাই ব্যবসায়ীরা এখন আর এ ভাসমান হাটে আসছে না। প্রায় একই অভিমত স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরও। তবে এ ভাসমান হাটটিকে বাঁচিয়ে রাখতে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সহ ব্যবসায়ীদের যৌথ উদ্যোগ গ্রহনের দাবী জানিয়েছেন সাধারন মানুষ। আশানরূপ মুনাফা অর্জিত না হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী বানারীপাাড়ায় আসছেন না। এছাড়া আধুনিকতার ছোঁয়ায় পূর্ব পুরুষদের এ ব্যবসাকে নিম্ন মানের ও কষ্টসাধ্য মনে করে অনেকেই অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছে। ফলে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী বানারীপাড়ার ভাসমান হাটের জৌলুস এখন আর চোখে পড়ছে না।