শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। এই আপ্ত-বাক্যটির সাথে পরিচিত আমরা সবাই। শিক্ষাই মানুষকে আলোকিত করে। বিকশিত করে তার মননকে। আত্মিক সুপ্ত গুণাবলির বিকাশ ঘটায়। পরিচিত করে পরিবেশ ও প্রতিবেশের সাথে। শেখায় দায়িত্বানুভূতি ও দায়বোধ। শৈশব থেকেই ভালো-মন্দ বোঝার বোধ শেখায়। এতক্ষণ যা বলা হলো, তা হচ্ছে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা। শিক্ষার আরো একটি দিক রয়েছে; আর তা হচ্ছে দৈহিক পূর্ণতার বিকাশ। শৃঙ্খলাবোধ, নেতৃত্ব, পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও দলীয় চেতনাবোধ; এসবের বিকাশের জন্য প্রয়োজন খেলাধুলা। এ জন্যই বলা হয়, সুস্থ দেহে সুন্দর মন। শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক পূর্ণতা। এটি খেয়াল করেই জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠ আবশ্যিক করা হয়েছে। সরকারি বিধান অনুসারে প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে খেলার মাঠ থাকার কথা থাকলেও তা শুধু কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে। বাস্তবতা এর চেয়ে বহু দূরে।
২২ এপ্রিল দেশের প্রথম শ্রেণীর একটি দৈনিকের ইংরেজি সংস্করণে জানানো হয়েছে, ঢাকা শহরের ১২৯টি ওয়ার্ডের ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে ০.৫ বর্গকিলোমিটার জায়গা প্রয়োজন একটি খেলার মাঠের জন্য। জনঘনত্ব হিসেবে ঢাকা মহানগরীতে ৬১০টি খেলার মাঠ থাকার কথা। আছে সাকুল্যে ২৫৬টি। এর মধ্যে ২০টির আয়তন এক একরেরও কম। বাকিগুলোর ভেতর অনেক মাঠই এখন দখলদারদের দখলে, নয়তো উন্নয়ন কর্মকা-ে হারিয়ে গেছে। এ তো গেল মহানগরী ঢাকার সাধারণ জনগণের জন্য খেলার মাঠের অবস্থা। স্কুলগুলোর অবস্থা আরো করুণ। একেকটি বহুতল ভবন নিয়ে একেকটি স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোতে মুরগির মতো সংখ্যাতিরিক্ত ছাত্রছাত্রীর বসার ব্যবস্থা। পাঠ্যপুস্তকের ভারে এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীর পিঠ কুঁজো হয়ে যাওয়ার অবস্থা। সকাল সাড়ে ৭টায় শিশুরা এসে ঢুকে এসব খুপরিতে, বেরোয় ২টায়। ক্লান্ত-শ্রান্ত এসব শিশুদের না আছে কোনো বিশ্রাম বা খেলাধুলার ব্যবস্থা। শিশুরা তাদের মনোরঞ্জনের জন্য হয়ে পড়ে মোবাইল ফোন বা ট্যাবকেন্দ্রিক। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতা হারিয়ে যায় মোবাইল ফোনের মায়াবী জগতে। তারা হয়ে পড়ে আত্মকেন্দ্রিক সৃজনশীলতাবিহীন জড়পদার্থের মতো। পরিবার, সমাজ থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এসব শিশু সৃষ্টিশীল চিন্তার জগৎ থেকে হারিয়ে যায়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ২০২১ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ২০ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনো খেলার মাঠ নেই। নেই কোনো চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা। অধিদফতরের হিসাবে সারা দেশে মোট ৬৫ হাজার ৪৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে খেলার মাঠ রয়েছে এমন স্কুলের সংখ্যা ৫৪ হাজার ৮২৬টি। গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সবগুলোতে খেলাধুলার জন্য নির্দিষ্ট কোনো খেলার মাঠ নেই। এদিক দিয়ে শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সবচেয়ে করুণ। ঢাকা মহানগরে ৭৯৫টি, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৫৪১টি, রাজশাহীতে ৩৭টি, খুলনায় ৬৬টি, সিলেটে ৩২টি ও বরিশালে ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও এর কয়টিতে খেলাধুলার মাঠ রয়েছে তার হিসাব নেই। অথচ পড়াশোনা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের জন্য তিন থেকে ছয় বছর বয়সীদের জন্য একটি, সাত থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য একটি এবং ১৩ বছর ও তদূর্ধ্ব শিশু-কিশোরদের জন্য একটি খেলার মাঠ দরকার জনশক্তি উন্নয়ন পরিকল্পনার আলোকে। আমাদের নগরপিতা ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে, ভবিষ্যতের সিঙ্গাপুর বা সুইজারল্যান্ড বানানোর স্বপ্নে বা স্মার্ট সিটিজেন বানানোর কর্মপরিকল্পনায় এসবের কোনো স্থান আছে কি না? যেখানে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক অবকাঠামোই নেই সেখানে স্মার্ট সিটিজেন বা জাতি গড়ার প্রত্যাশা কতটুকু বাস্তবসম্মত তা ভাববার বিষয়। জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ বাধ্যতামূলক থাকলেও এর ব্যত্যয় দেখা যায় অহরহ। শহরের নামীদামি বেসরকারি স্কুলগুলোর অধিকাংশেরই নেই নিজস্ব খেলার মাঠ। আকাশচুম্বী ছাত্রবেতন নেয়া এসব প্রতিষ্ঠান সরকারি নীতির তোয়াক্কা না করে কিভাবে গড়ে উঠেছে কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায়, ভাবলে অবাক হতে হয়। খেলাধুলা শিশুদের মধ্যে সামাজিকতা ও সামাজিক দায়বোধ শেখায়। অবাক হতে হয় একটি আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম কিভাবে ভবিষ্যতে জাতিকে নেতৃত্ব দেবে? কিভাবে জাতিগঠনে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে?
খেলাধুলা লেখাপড়ার একটি অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। অঙ্গবিহীন মানুষ যেমন সমাজের বোঝা, তেমনি অপূর্ণাঙ্গ শিক্ষা তৈরি করে ভবিষ্যতের ঝুঁকিবহুল জনগোষ্ঠী। খেলাধুলা সামাজিকতার একটি বড় অনুষঙ্গ। এর মাধ্যমে শিশুরা একে অপরের সাথে মেলামেশা ও ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক নেতৃত্ব, শৃঙ্খলাবোধ ও সহযোগিতার বাস্তব পঠন পায়। তাদের চিন্তার পরিস্ফুটন ঘটে এর মাধ্যমে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশের প্রয়োজনে সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ‘ফিরিয়ে দাও শিশুদের খেলার মাঠ, বাঁচতে দাও তাদের’ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার জোর প্রয়োজন এখন। দলমত নির্বিশেষে এ ব্যাপারে সবারই যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। বিভিন্ন শিশু সংগঠন, ইউনিসেফ, শিশু মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ক্রীড়া মন্ত্রণালয়- সবারই জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন এ ব্যাপারে। লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ,Email-shah.b.islam@gmail.com