শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৭ অপরাহ্ন

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে তালাবন্দী হাজারো বই, নেই পাঠক

আয়নাল হক (স্টাফ রিপোর্টার) রংপুর
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৩

ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিটি এখন শুধু নামেই টিকে আছে। ১৯০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরিটি কালের বিবর্তনে এখন ধুকছে। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনায় ঐতিহ্যের জৌলুস হারিয়ে এখন এটি নামমাত্র লাইব্রেরি। স্বাধীনতা পরবর্তী জেলায় জেলায় সরকারি গণগ্রন্থাগার হওয়াতে কমে গেছে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির কদর। এখন বই, লাইব্রেরিয়ান, জনবল ও বরাদ্দ সংকটে তেলহীন বাতির মতো জ্বলছে এই জ্ঞান গৃহ। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে এখন বই পড়ার তেমন সুযোগ নেই। নেই আগের মতো পত্রিকাতে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার সুযোগ। জনবল সংকটের অযুহাতে বস্তায় ও তালাবন্দী হয়ে পড়ে আছে হাজারো বই। বই থেকেও যেন বই পড়তে মানা। তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কিছু বই রয়েছে উন্মুক্ত। খবরের কাগজ পড়ে অভ্যস্ত পাঠকরাও এখন হতাশ। সেখানে নেই আগের মতো পত্রিকা। সাতটি পত্রিকার তালিকা থাকলেও অর্থ সংকটে এখন পাঠকের খোরাক মাত্র পাঁচটি। জীর্ণ দশার এই লাইব্রেরিতে প্রতিদিনের নতুন সংযোজন বলতে শুধু পত্রিকাই। সরেজমিনে দেখা গেছে, এক সময়ের চার কক্ষ বিশিষ্ট লাইব্রেরিটি এখন অস্তিত্ব সংকটে। একটা আলমারিতে তালাবন্দি হয়ে আছে বহু নামিদামি লেখকের বই। বস্তাতেও পড়ে আছে অনেকগুলো বই। লাইব্রেরির ফাঁক-ফোঁকরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব বইয়ের কোনোটা ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক নয়তো সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ক। এখানে রয়েছে সাড়া জাগানো প্রেমের উপন্যাসও। সম্প্রতি কিছু নষ্ট ও জীর্ণ আলমারি রং করানো হয়েছে। এখন আলমারি চকচক করলেও তালাবন্দী বইগুলো চকচকে নয়। এখানে বই-পত্রিকা সংরক্ষণে নেই পর্যাপ্ত আলমারি। নতুনত্ব না থাকায় পুরাতন এসব বই-পত্রিকার স্তূপ কাছে টানছে না পাঠকদের।লাইব্রেরির চারটি কক্ষের একটা কোল ঘেঁষা জেলা শিল্পকলা একাডেমির পেটে চলে গেছে। বাকি তিনটির মধ্যে একটি পরিত্যক্ত। লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহৃত কক্ষে পাঠকের বসার জন্য রয়েছে কয়েকটি প্লাস্টিক চেয়ার। আছে বহু পুরাতন একটি টেবিল। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তির সেবা তো দূরের কথা লাইব্রেরির সেবার জন্য কেউ নেই। একজন বৃদ্ধ কেয়ারটেকার আর এক পরিচ্ছন্নতা কর্মীই এখানকার সব। পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক এর অভিভাবক হলেও তেমন কোন কার্যক্রম নেই। এ কারণে লাইফ সাপোর্টে বেঁচে থাকা রোগীর মতো ধুকে ধুকে চলছে প্রাচীনতম লাইব্রেরিটি। সম্প্রতি রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে পাঠক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লাইব্রেরিটি খোলা থাকে। রংপুর ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত অনেক পত্রিকা থেকে এখানে বাছাই করা পাঁচটি দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়। এখানে রয়েছে বিপুলসংখ্যক বই, পা-ুলিপি, পুথি, উৎকীর্ণলিপি ও প্রতœতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ।এখনকার কেয়ারটেকার আজিজুল ইসলাম ছানু। পনেরো বছর ধরে এখানে চাকরি করছেন। বেতনভাতা হিসেবে তার প্রতিদিনের হাজিরা ১০০ টাকার নিচে। মাস শেষে জোটে মাত্র ২৫০০ টাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের ছানু বলেন, লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। এর কোনো দাতা নেই। বছর দুয়েক আগে লাইব্রেরির সংস্কার কাজ করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী কোনো জনবল নেই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হলেও কোনো ব্যবস্থা হয়নি। একজন লাইব্রেরিয়ান ছিল, বেতন ঠিক মতো না পাওয়া তিনিও চাকরি ছেড়েছেন। এখন তেমন পড়ার মতো বইও নেই।প্রাচীন এই লাইব্রেরি ভবনটি বিরাট জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়, সঙ্গে পাশে রয়েছে রংপুর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ও খেলার মাঠ। পাঠক খুঁজে পাওয়া না গেলেও মাঠে বসে আড্ডা দেওয়ার তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা কম নয়। বইয়ের পাঠক হারানো লাইব্রেরিটি এখন দৈনিক পত্রিকা পড়ার লাইব্রেরিতে পরিণত হয়েছে। সরকারি ছুটি ও সপ্তাহে সোমবার ছাড়া বাকিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লাইব্রেরি খোলা থাকে। কেয়ারটেকার ছানু বলেন, লাইব্রেরিতে যা আছে সবগুলো তালাবন্দী, পাঁচটি পত্রিকা ছাড়া এখানে নতুন বলতে কিছুই নেই। যারা পাঠক তারাও পুরাতন। বই না থাকায় নতুন পাঠক সৃষ্টি হচ্ছে না। নতুন পুরাতন মিলে এখন অন্তত সাড়ে তিন হাজার বই রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে জনবল না থাকায় পাঠকরা ইচ্ছেমতো বই পড়তে না পাড়ায় তালাবন্দী বইগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন শুধু পত্রিকা পড়তে আসেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। লাইব্রেরিতে বসে কথা হয় মাহমুদুল হাসান নামের একজন পাঠকের সঙ্গে। তিনি শ্যামপুর ময়নাকুড়ি আলিম মাদ্রাসার আরবি প্রভাষক। চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী এই শিক্ষক সাংবাদিকদের বলেন, লাইব্রেরিতে আসি বই পড়তে কিন্তু পত্রিকা দেখেই চলে যেতে হয়। লাইব্রেরিতে লোকজন (জনবল) না থাকায় কেয়ারটেকার আলমারিতে থাকা বইগুলো পড়তে দেন না। এখানে অসংখ্য নামিদামি লেখকের বই রয়েছে কিন্তু পড়ার সুযোগ নেই। একটা আলমিরা ছাড়া সবগুলোতে তালা দেওয়া রয়েছে। লাইব্রেরির এমন করুণ অবস্থা দেখে কষ্ট লাগে। কামরুল হাসান নামে আরেক পাঠক সাংবাদিকদের বলেন, এক সময় এখানে অনেক বই ও পত্রিকার পাঠক ছিল। কিন্তু এখন পাঠক কমে গেছে। জনবল নেই। পড়ার উপযোগী কোনো বই নেই। কিছু পুরাতন বই আছে, তাও উইপোকা, তেলাপোকা কাটা, ধুলাবালু, বৃষ্টির পানি পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এভাবেই নামে মাত্র টিকে আছে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি।লাইব্রেরির বাহিরে টাঙানো সাইনবোর্ডে থাকা তথ্য বলছে, জ্ঞান চর্চার জন্যই ১৮৩২ সালে কু-ীর জমিদাররা রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। এক পর্যায়ে এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন রাজমোহন রায় চৌধুরী। আর পৃষ্টপোষকতা করেছিলেন তুষভা-ারের রমণীমোহন রায় চৌধুরী ও কাকিনার মহিমারঞ্জন রায় চৌধুরী। তবে কারো কারো দাবি ১৮৫৪ সালে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে এবং ১৯০৩ সালে এক অগ্নিকা-ে অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও এই লাইব্রেরিতে সংগ্রহ নেহাত কম নয়। ১৯৯১ সালে পাশেই নতুন একটি সরকারি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে সেখানেই মানুষজন বই পড়তে যান। স্থানীয় সংগঠকেরা জানান, ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শোষণ আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাক্ষী রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা সংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সরগরম ছিল এই লাইব্রেরি। বহু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, কবি-সাহিত্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সংগঠক মনা মানুষের ওঠা-বসা ছিল এখানে। বই-পত্রিকার সমারোহে ছিল হাজার হাজার পাঠকও। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগে। নতুন কমিটি না হওয়াতে এখন কেউ খোঁজখবরও নেন না। লাইব্রেরিকে বাঁচিয়ে রাখতে এর অবকাঠামো ঠিক রেখে নতুন করে সংস্কার করা এবং পাঠক সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন লাইব্রেরির আজীবন সদস্য সিনিয়র সাংবাদিক জয়নাল আবেদীন।তিনি আরও বলেন, পাবলিক লাইব্রেরি অনেক পুরোনো পাঠাগার। এখানে কত বছর ধরে নতুন বই নেই, কেউ বলতে পারবে না। এ লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য লোকজন নেই। এখানে নির্বাচন নেই। এর গ্রাহক বা দাতা নেই। এখন কোনোরকম খোঁড়ায় খোঁড়ায় চলছে। নেই শব্দে সমৃদ্ধ রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া নেই। বই আছে পাঠক নেই। বইবিলির জনবল নেই। পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী পত্রিকাও নেই। শতবর্ষী এই লাইব্রেরিটি এখন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে।
সৃজনশীল মানুষ গড়ে তুলতে হলে নতুন প্রজন্মকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতেই হবে। এই লাইব্রেরির এক সময়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য ও রংপুর বিভাগীয় লেখক পরিষদের সভাপতি কাজী জুননুন বলেন, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিকে নতুন প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। এর সঙ্গে অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। এটাকে এভাবে অবহেলিত রাখতে দেওয়া ঠিক হবে না। আধুনিক পাঠাগার করে রংপুরের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে লাইব্রেরি মুখি করার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। জনবল বাড়ানোসহ পরিচালনা কমিটি গঠন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা জনবল বাড়ানোর ব্যাপারটি নিয়ে ভাবছি। পাশাপাশি দুটি লাইব্রেরি থাকায় হয়তো পাঠক কম হতে পারে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com