শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৭:১৪ অপরাহ্ন

‘গাজায় মানবতা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে’

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৩

চোখের সামনে তিনি যে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছেন, সেটি তার চেহারা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে না। ধ্বংসস্তূপ থেকে শিশুদের নির্জীব দেহ বের করে আনা, তাঁবুতে সাদা চাদরে মোড়ানো সারি সারি লাশ এবং বিমান হামলায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া ইমারত।
মাহমুদ বাদাভি তার চোখের সামনে মানবতা গুঁড়িয়ে যেতে, পুড়তে, ছিন্নভিন্ন হতে দেখেছেন। ‘অনেক কঠিন পরিস্থিতি আসে। একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে, যা ঘটছে তার অনেক কিছুই দেখতে হয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হাত, মাথাৃ দেহ – যাই হোক, আমরা অভ্যস্ত,’ বলেন মাহমুদ বাদাভি। প্রত্যক্ষদর্শী মাহমুদ বাদাভির অ্যাম্বুলেন্স হত্যাযজ্ঞের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছুটে চলে। গাজার এক সরু গলিতে মাহমুদ দাঁড়ালেন, বিমান হামলায় আহত দুই শিশুকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার জন্য। এক ব্যক্তি তার কোলে কিছু একটা নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে এগিয়ে এলেন। তার কোলে মারাত্মকভাবে আহত এক বালক। মাহমুদের এক বন্ধু, যিনি আহতদের উদ্ধারকার্যে নিযুক্তদের সাহায্য করছেন, তাকে চিৎকার করে ওই আহত বালক সম্পর্কে আরো যতœশীল হতে অনুরোধ করে বলেন, ‘নাসির, ওর মাথা চৌচির হয়ে গেছে।’ তারপরও মাহমুদ বিচলিত না হয়ে শান্তভাব বজায় রাখেন। এমনটা নয় যে এই পরিস্থিতি তাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় না। কিন্তু মাহমুদ যে কাজে ব্রতী, তা সুষ্ঠুভাবে করার জন্য স্থির থাকাটা ভীষণ দরকার, যাতে তিনি আহতদের দিকে নজর দিতে পারেন, যাদের বাঁচানো সম্ভব। বিবিসি’র সংবাদদাতার সাথে কথা বলার সময় মিসাইল বিস্ফোরণের একটা বিকট শব্দ শোনা গেল। ‘এখানে যা অবস্থা তাতে বিরতি নেয়ার ফুরসত আমাদের কারো নেই। পরিস্থিতি ভীষণ খারাপ। এখন আমাদের খোঁজার চেষ্টা করতে হবে, কোথায় এই বিস্ফোরণ হলো, যাতে আহত আর মৃতদের কাছে পৌঁছতে পারি,’ বলেন তিনি। গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিগত দুই সপ্তাহে ছয় হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই শিশু বলে জানা গেছে। জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে, এক-তৃতীয়াংশ হাসপাতাল এবং দুই-তৃতীয়াংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ করতে হয়েছে। এসব হাসপাতাল হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ আরো জানিয়েছে, মজুত জ্বালানির ভা-ার ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো সংকটময় হতে চলেছে। আগামীদিনে কোন পরিষেবাকে গুরুত্ব দেয়া হবে আর কোনটা হবে না তা নিয়ে ‘কঠিন সিদ্ধান্ত’ নিতে হতে পারে। অন্যদিকে, ইসরাইল গাজা ভূখ-ে কোনোরকম জ্বালানি সরবরাহের বিরোধী। তাদের আশঙ্কা, ওই জ্বালানি হামাসের হাতে। তারা হামাসের বিরুদ্ধে জ্বালানি লুট করার অভিযোগও করেছে। গাজায় দিন-রাত প্রায় সব মিলেমিশে একাকার, যুদ্ধ চলছেই। গাজা ভূখ-ের এই ছোট্ট অংশ যা মাত্র ১৪১ বর্গমাইল (৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার) জুড়ে রয়েছে, তার সর্বত্রই যুদ্ধের চিহ্ন। ইতোমধ্যে ইসরাইল গাজার উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত প্রায় ১০ লাখ মানুষকে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। হামাসকে নির্মূল করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনী যাতে নির্বিঘেœ কাজ করতে পারে তাই এই নির্দেশ। কিন্তু ইসরাইল বিমান হামলা বন্ধ করেনি। গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ইসরাইলের বিমান আক্রমণ কিন্তু অব্যাহত। পালিয়ে যাব কী-না? গেলে কোথায় যাব? কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেব? – গাজায় দিন-রাত এসব প্রশ্ন মরিয়া হয়ে ঘুরছে মানুষের মনে। এর অর্থ, জরুরি পরিষেবার কাজে নিযুক্ত মানুষের ঘরে ফেরা বা সুরক্ষিত আশ্রয়ে থাকার প্রশ্নও নেই। মাহমুদ যখন তার কাজে বাসা থেকে বের হন, তখন তার স্ত্রী আর ছয় সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন থাকেন। একইসাথে তার পরিবারের সদস্যরাও মাহমুদের নিরাপত্তার জন্য চিন্তায় থাকে। যেদিন বোমার হানা তীব্র হয়, মাহমুদ চেষ্টা করেন, প্রতি ঘণ্টায় বাড়িতে ফোন করে কথা বলতে। কিন্তু টেলিফোন মারফত যোগাযোগ করাও কঠিন। ‘পরিবারের সকলের সাথে যোগাযোগ করাটাও ভীষণ কঠিন। বাড়ির সকলে সুরক্ষিত আছে কী-না সেটুকু জানার জন্যও যতটুকু পরিষেবা প্রয়োজন তাও অনেক সময় থাকে না,’ বলেন মাহমুদ। সংসার চালাতে মাহমুদ কঠিন পরিশ্রম করেন। সাথে তার সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। মাহমুদের এক মেয়ে ডাক্তার হতে চায়, বাবাই তার অনুপ্রেরণা। আর সাথে রয়েছে গাজায় থাকাকালীন চোখের সামনে দেখা যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। মাহমুদের এক ছেলেও রয়েছে, যে নার্স হিসেবে কাজ করতে চায়। অন্য এক মেয়ে শিক্ষিকা হওয়ার জন্য প্রস্তুত। রাত ঘনিয়ে এলে এক সময় বোমা হানায় ছেদ পড়ে। মাহমুদ একটু থামেন, তারপর অ্যাম্বুলেন্স এবং ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়ান। তার বাঁ হাতে ধরা স্ট্রেচার। পরের জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকেন মাহমুদ। উত্তেজনা ক্রমশ কমে আসে। কোনো অনুভূতিই যেন ছুঁতে পারে না তাকে। কিছুক্ষণের জন্য আবেগ-শূন্য হয়ে পড়েন তিনি, চোখ চলে যায় দূরে। যা কিছু তিনি দেখেছেন সেজন্য তার দু’চোখ কষ্টে ভরা। সূত্র : বিবিসি




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com