সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬:৫৮ অপরাহ্ন

ইসরাইলের একগুঁয়েমি ও ফিলিস্তিন সঙ্কট

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৩

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দেখা দিয়েছে চরম খাদ্যাভাব। সাথে সাথে পানির সঙ্কট। শিশুখাদ্যের অভাবে তড়পাচ্ছে শিশুরা। বয়স্করা অসহায়ভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসাসামগ্রীর জন্য চলছে হাহাকার। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের ভাষায় ক্ষুধাকে গাজাবাসীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরাইল। বিশ্ববাসীর চোখের সামনে লাখ লাখ মানুষকে এভাবে না খাইয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়াকে কোন আন্তর্জাতিক আইনে বৈধতা দেয়া হয়েছে, মানবতাবাদী মোড়লদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে।
অক্সফামের বিবৃতিতে গাজায় খাবার, পানি, ওষুধ ও জ্বালানি সরবরাহের অনুমতি দেয়ার আবেদন করা হয়েছে। সংস্থাটির বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্বনেতারা বসে থাকতে পারেন না। এ ব্যাপারে তাদের উদ্যোগ নিতে হবে। গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলা শুরুর মাত্র কয়েক দিন আগে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন সম্পর্কিত জাতিসঙ্ঘ কমিশনের চেয়ারম্যান নাভি পিল্লাই বলেছিলেন, ‘কমিশন তদন্তে দেখতে পেয়েছে, ক্রমবর্ধমান হারে সামরিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে ইসরাইলের তৈরি করা আইনের প্রয়োগ ও গাজায় তাদের বারবার হামলার লক্ষ্য ভূখ-ের ৫৬ বছরের বেআইনি দখলদারিত্ব বজায় রাখা।’ এ দিকে শুক্রবার রাতে (২৮ অক্টোবর) ইন্টারনেটসহ সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে জল, স্থল ও আকাশপথে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ওই হামলায় গাজা শহর এক জ্বলন্ত অগ্নিকু-ে পরিণত হয়। জাতিসঙ্ঘের বরাতে জানা যায়, গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে এক হাজার লাশ চাপা পড়ে আছে। এদিকে গাজায় ইসরাইলি আক্রমণে নিহত হন ২৫ সাংবাদিক। ইসরাইল সাফ জানিয়ে দিয়েছে, গাজার দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাদের নয়। ইসরাইলি যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর উচ্চারণ, ফিলিস্তিনিদের হয় পালাতে হবে অথবা মরতে হবে আর না হয় আমাদের বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী পশ্চিম তীর থেকে সব ফিলিস্তিনিকে বের করে দিয়ে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের কথা বলেছেন। অর্থাৎ একদিকে গাজাকে ফিলিস্তিনি শূন্য এবং পশ্চিমতীরের ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন করে বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্রের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তেলআবিব। গাজা বা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা আক্রমণের মুখে যাবে কোথায়, প্রশ্নে ইসরাইল বলেছে, মিসরের সিনাই মরুভূমি অথবা জর্দানে তারা নতুন করে বসতি স্থাপন করতে পারে।
২০০২ কোটি ডলারের সামরিক বাজেট সমৃদ্ধ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কল্যাণে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর দেশ ইসরাইল। পারমাণবিক শক্তির অধিকারী ইসরাইল লড়ছে সিআইয়ের হিসাবে ১০ থেকে ১৫ হাজার হামাস যোদ্ধার বিরুদ্ধে। তাদের না আছে বিমানবাহিনী, না আছে নৌবাহিনী, না আছে নিয়মিত সেনাবাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে প্রায় পাঁচ লাখ সদস্যের প্রশিক্ষিত সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী নিয়ে বীরত্বের (?) সাথে লড়াই করছে ইসরাইল। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র দু’টি বিমানবাহী রণতরী ও ৭০০ মেরিন সেনা পাঠিয়েছে ইসরাইলকে সাহায্য করতে। যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি অতি উৎসাহে এগিয়ে এসেছে এ জোটে যোগ দিয়ে হামাসকে উপযুক্ত (?) শাস্তি দিতে। এ যেন মৃতপ্রায় মানুষের ওপর শকুনের ভাগাভাগি! এদিকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্দেশে বলেছেন, এ যুদ্ধ শুধু ইসরাইলের স্বার্থে নয়; পুরো পশ্চিমা বিশ্বের জন্য লড়ছে ইসরাইল। ফিলিস্তিন ও ইসলাইলের যুদ্ধকে পূর্ব-পশ্চিম যুদ্ধের অবয়বে ঠেলে দেয়ার গভীর চক্রান্ত এঁটেছে ইসরাইল। ভাবখানা এমন, এভাবে যদি পুরো পশ্চিমা বিশ্বকে বৈষয়িক ও নৈতিক সাহায্যে উদ্বুদ্ধ করা যায়। একই সাথে যুদ্ধবিরতির যেকোনো প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘এখন যুদ্ধের সময়’।
এই অসম যুদ্ধ ও জাতিগত নিধনের বিপক্ষে জেগে উঠেছে বিশ্ব মানবতা। জাতিসঙ্ঘে সর্বোচ্চ ভোটে গৃহীত হয়েছে যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার প্রস্তাব। ইসরাইল তার মুরুব্বি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় অস্বীকার করেছে এ সিদ্ধান্ত মানতে। ইউক্রেনের জন্য দরদে বিগলিত পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ নেতারা গাজার শিশুদের ব্যাপারে নিশ্চুপ। মহিলা ও বয়স্কদের দুর্দশায় তাদের মুখে কোনো শব্দ নেই। এর বিরুদ্ধে পৃথিবীর দেশে দেশে জেগে উঠেছে শান্তিকামী মানুষ। খোদ তেলআবিবেও সে দেশের শান্তিপ্রিয় নাগরিকসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, পদত্যাগ চেয়েছেন নেতানিয়াহুর। ইউক্রেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত যত মৃত্যু হয়েছে, যত লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে, গাজায় মৃতের সংখ্যা ও বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা তার চেয়ে বহুগুণে বেশি। অথচ ইউক্রেনের বেলায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের চোখে ঘুম নেই। অপর দিকে, গাজায় ইসলাইলি নৃশংসতা নিয়ে তাদের কোনো কথা নেই।
গাজায় ইসরাইলি হামলায় হতাহতের ব্যাপকতা ও ইসরাইলি বাহিনীর বর্বরতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নারকীয়তাকেও হার মানিয়েছে। ইসরাইলের এই একগুঁয়েমির কারণে এ সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। এ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবসহ রাশিয়া, চীন, মিসর, জর্দান, সৌদি আরব, তুরস্ক ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। সব সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে যেভাবে ইসরাইল একরোখা ও একপেশে শক্তির মদমত্ততা দেখাচ্ছে তাতে অমূলক নয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার। পরাশক্তির একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয়া ভার্সাই চুক্তি যেমন জন্ম দিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের; বর্তমান গাজা পরিস্থিতিতে পরাশক্তিগুলোর পক্ষপাতিত্ব তেমনি এক আশঙ্কার দিকে এগোচ্ছে। এর দায় ইসরাইল ও সংশ্লিষ্ট জোটের পরাশক্তিকে বহন করতে হবে। সব কিছুর ঊর্র্ধ্বে জাগ্রত হোক বিশ্ববিবেক। শান্তির শ্বেত কপোত অবারিতভাবে উড়ুক শান্তির প্রত্যাশায়- এ প্রত্যাশা আজ সবার। লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ঊসধরষ-ংযধয.ন.রংষধস@মসধরষ.পড়স




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com