শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৭ পূর্বাহ্ন

ফিলিস্তিনিদের জীবন কি বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়?

হানি আলমাধৌন
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৩

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বসে মৃত্যুপুরী গাজার ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতার আঁচ পাচ্ছি। কখন এই তা-বলীলার অবসান ঘটবে, তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। গাজার ধ্বংসস্তূপে দিন কাটাচ্ছেন আমার পিতামাতা। ১০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণ ঝরেছে এবারের হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে। বহু নারী, শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ নির্বিচার মৃত্যুর শিকার হয়েছেন, যা সবার মতো ব্যথিত করেছে আমাকেও। এই মর্মান্তিক ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণীয় নয়। আমার হূদয় ভেঙে যাচ্ছে। প্রতিদিন আশায় বুক বাঁধি এই চিন্তায়, দুঃস্বপ্নের কালো অধ্যায় শেষ হবে খুব তাড়াতাড়িই, কিন্তু তা যেন কখনোই হওয়ার নয়! ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে মুহুর্মুহু। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আহাজারিতে ভারী হচ্ছে বাতাস। এই গভীর সংকটের শোক কোনোভাবেই ভোলার নয়। ভয়ংকর জীবনহানির খেলা কখন শেষ হবে, তা-ও অজানা। প্রতিদিন স্ত্রী ও আমার ঘুম ভাঙে চরম আতঙ্ক নিয়ে! সকালে যখন ঘুম থেকে উঠি, তখন প্রায় ৬ হাজার মাইল দূরের নিজ ভূখ- গাজার যে খবর পাই, তাতে ভারী হয়ে ওঠে আমাদের মন। ফিলিস্তিনিদের ওপর যে নৃশংসতা চলছে, আশা করি তা দেখছে গোটা বিশ্ব। এই উপত্যকার সংবাদ আমাদের শোকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, হতাশাকে করে তোলে গভীরতর। এ যেন অস্ত্রোপচারের পর অপারেশন থিয়েটার থেকে জেগে ওঠার মতো অনুভূতি! সত্যিই, গাজাবাসীর মতোই আমরাও এক অস্থির সময় পার করছি।
দুই-তিন দিন আগের ঘটনা। ইসরাইলি বাহিনীর বোমার আঘাতে বাবা-মা ও সব ভাইবোনকে হারিয়েছে আমার মামাতো ভাই আহমদ। মাত্র চার মিনিট আগে বাড়িতে থাকলে লাশ হতে হতো তাকেও! গাজার অবস্থা এখন এমনÍজীবন ও মৃত্যুর মাঝে দূরত্ব মাত্র চার মিনিটের! কী বিভৎস দৃশ্য, ভাবতে পারেন! এসব সংবাদ শরীরকে বরফশীতল করে তোলে। ঠান্ডা, অবশ হয়ে আসে মাথা। গাজায় দায়িত্ব পালনরত ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিসে (ইউএনআরডব্লিউএ) কর্মরত আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে যেসব সংবাদ পাই, তা আমার হূদয়কে একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। হতাহতের সংবাদ তো শুনছে সারা পৃথিবী; কিন্তু খাদ্য, পানি, ওষুধ ও জ্বালানি ঘাটতির কারণে যে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে গাজাবাসী, তার কতটুকু জানতে পারছি আমরা? ইসরাইলি অবরোধের মুখে দীর্ঘ ১৬ বছরে গাজা একেবারে পঙ্গু হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য হলে সত্য, গাজার ৭৫ শতাংশ জনসংখ্যার খাদ্যসহায়তা বিশেষ প্রয়োজন। পোশাক-পরিচ্ছদ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের কথা বাদ দিলাম, দুই বেলা দুমুঠো আহারের জোগাড় না হওয়াটা চরম মানবিক দৃশ্য বইকি। সারা বিশ্ব দেখেছে, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়ে গেছে বোমার আঘাতে। দুঃখের সঙ্গে জানাতে হয়, এটা আমার শিক্ষালয়। শুধু আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গাজার বাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও একই হালÍধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। পরিতাপের বড় বিষয়, গাজার শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা ছেড়ে দিয়েছে! বেঁচে থাকার প্রথম মৌলিক চাহিদা তথা খাদ্যের সংস্থানই যেখানে দুরূহ ব্যাপার, সেখানে শিক্ষার দিকে মনোনিবেশ করাটা কেবল কঠিনই নয়, অসম্ভবও।
গাজায় যে ধরনের অবস্থা চলছে, যে ধরনের মানবিক পরিস্থিতি নেমে এসেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, উদ্ভূত বিপর্যয়কর অবস্থায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গর্ব করার মতো আর কিছু বাকি নেই! অর্থাৎ, প্রশ্ন উঠতেই পারে, গাজা তথা ফিলিস্তিনিরা কি বিশ্বের কাছে এতটুকু মূল্যের দাবি রাখে না? বিশ্বের কাছে ফিলিস্তিনিদের জীবনের কি কোনোই দাম নেই? ৭ অক্টোবর যখন হামাস হামলা চালিয়ে বসে ইসরাইলের ভূখ-ে, তখন থেকেই গাজাবাসীর আতঙ্কময় জীবনের শুরু। প্রতিটি মুহূর্ত আমার মায়ের মুখ থেকে শুনছি, কী মর্মান্তিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে একেকটা সেকেন্ড পার করছেন তারা! জানিয়ে রাখতে চাই, ইসরাইল বাহিনী যখন পালটা হামলা শুরু করল গাজায়, তার পরের কয়েক দিন পরিবারের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি আমি। এরপর যখন পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হলো, মায়ের মুখ থেকে শুনেছি, কী ভয়াবহ অবস্থা ঘিরে ধরেছিল তাদের! মায়ের ভাষায়, ‘দিনরাত ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিই আমরা! ভাবি, এই বুঝি বোমা এস পড়ল আমাদের মাথার ওপর! এই বুঝি মারা পড়লাম বিকট শব্দের নিচে চাপা পড়ে!’
গাজাবাসী ঠিক কী ধরনের অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে, আমার মায়ের কথায় সে সম্পর্কে ধারণা করা যায়। চরম ভয় আর অনিশ্চয়তাÍএটাই আজ গাজাবাসীর নিত্য সঙ্গী। একটা ঘটনা আমার মনকে চরমভাবে ব্যথিত করে তোলে। ঘটনাটা আট বছর বয়সি আমার ভাতিজা ইয়াজানকে নিয়ে। ইয়াজান একটা কম্বল হাতছাড়া করতে চাইছে না এই বিশ্বাসে যে, তার ধারণাÍবোমার আঘাত এলে ঢাল হিসেবে তা ঠেকিয়ে দেবে কম্বলটি! হূদয়বিদারক ও হূদয়গ্রাহীÍদুটি শব্দই এক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হয়! চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সময়ে এই ছোট্ট শিশুর বাঁচার আকুতি আমাদের সামনে বেদনাবিধুর দৃশ্যের অবতারণা করে। বিপজ্জনক পৃথিবীতে বাঁচার জন্য এ ধরনের নিরাপত্তার অনুভূতি গভীর ভারাক্রান্ত করে তোলে। ইয়াজানের মতো হাজারো কচি কাঁধে সংঘাতের কঠিন বোঝা কতটা চাপ দিচ্ছে, তা বর্ণনাতীত। গাজার বর্তমান চিত্র কতটা প্রকট, কী কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন গাজার শিশুরা, ইয়াজানের হূদয়গ্রাহী দৃশ্যের দিকে চোখ দিলেই তা পরিষ্কার বোঝা যায়।
এক টুকরো রুটির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে গাজাবাসী। ভাবা যায় এই দৃশ্য! পানির জন্য হাহাকার শোনা যাচ্ছে উপত্যকা জুড়ে। খাদ্যের ঘাটতি ও পানির জন্য হাহাকারÍযুদ্ধক্ষেত্রে এই চিত্র সর্বময়। রুটি আর পানিÍগাজাবাসীর জন্য এ যেন অতি মূল্যবান বস্তু! এর জন্যই মাইলের পর মাইল ছুটছে তারা। কী দুঃখজনক পরিস্থিতি! আমার আরেক ভাতিজা ওমর আমাকে বলেছে, ‘যত বার আমি বাড়ি থেকে বের হই, নিজেকেই নিজে বলিÍ‘এই যাওয়াই আমার শেষ যাওয়া’! পরিবারকে হয়তো আর অক্ষত দেখতে পাব না। আর হয়তো বাড়ি ফেরা হবে না।’ গাজায় যে মানবিক সংকট চলছে, তা যে কোনো ট্র্যাজেডিকেও হার মানাবে। এখানকার প্রতিটি মুহূর্ত চরম ভয় আর যন্ত্রণায় ভরা। এই পরিস্থিতির উত্তরণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসা শুধু অপরিহার্যই নয়, অনিবার্যও। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে, সব পক্ষ এক জায়গায় হয়ে অতি জরুরি ভিত্তিতে যুদ্ধ বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন পৃথিবী থেকে শেষ হয়ে যায়নি।
আমরা যদি গাজা উপত্যকায় বসবাসরত বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই, তাহলে তারা চরম হতাশা ও আশাহীনতার অতল গহ্বরে হাবুডুবু খেয়ে মারা পড়বে। বছরের পর বছর দখলদারিত্বের করাল গ্রাসের শিকার ফিলিস্তিনিরা আজ বড্ড ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত! আন্তর্জাতিক আইন বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। অথচ দুঃখজনকভাবে গাজাবাসীর জন্য যেন এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়!
মাতৃভূমি গাজার চলমান পরিস্থিতি আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। দূর পরবাসে বসে যখন নিজের ভূখ-ের ওপর নির্বিচার আক্রমণ দেখছি, তখন তাদের সাহায্য করতে না পারার যন্ত্রণায় ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ইসরাইলি বাহিনী সম্ভবত গাজার কোমলমতি শিশুদের এটা বোঝাতে চায়, এই শিক্ষা দিতে চায় যে, ‘আমরা পরাধীন জাতি’। আমাদের আগে আমাদের দাদা-দাদিকেও তারা এমনটাই শেখাতে চেয়েছিল। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে গাজা ছেড়ে এসেছি আমি। রাফাহ ক্রসিং থেকে যখন বের হচ্ছিলাম, তখন আমার বন্ধুদের উদ্দেশে বারবার বলেছিলাম, ‘মাতৃভূমির প্রতি খেয়াল রেখো। মাতৃভূমিকে যতেœ রেখো।’ আজ সেই কথা যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে! ( উৎস: ইত্তেফাক অন লাইন) লেখক: জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) অধীন মার্কিন দাতব্য প্রতিষ্ঠান ফিলানথ্রপির পরিচালক সিএনএন থেকে অনুবাদ: সুমৃৎ খান সুজন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com