সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৩৮ পূর্বাহ্ন

‘নার্স নেলি’

মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩

বেগম রোকেয়ার ছোট গল্প

আগ্রায় তাজমহল দেখিয়া আরও একটি কথা মনে উদয় হইল। নারীবিদ্বেষী পুরুষগণ স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধে যতই দীর্ঘ বক্তৃতা ঝাড়ুন না কেন, সত্যের কথা অনিবার্য। শিক্ষা-স্ত্রীলোক ও পুরুষ নিব্বিংশেষে সর্ব্বদা বাঞ্ছনীয়। স্থলবিশেষ অগ্নি গৃহদাহ করে বলিয়া কি কোন গৃহস্থ অগ্নি বর্জ্জন করিতে পারে?
উল্লেখিত বক্তব্যটি নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়ার। এখানে নারীর শিক্ষার অধিকার ও প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট। আর এও সত্য একথার মধ্যে পুরুষদের নারী বিদ্বেষী মনোভাবের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট আঘাত। প্রকৃত সত্য কিন্তু তা নয়। নারী শিক্ষা ও নারী অধিকারের বিষয়ে তিনি অবিচল সংগ্রাম করেছেন একথা শতসিদ্ধ এবং স্বীকৃত। কিন্তু কেউ কেউ বলে থাকেন তিনি কোথাও কোথাও পুরুষের এবং ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তাদের এমন বক্তব্যের পিছনে দু’টি কারণ থাকতে পারে। এক, রোকেয়াকে পরিপূর্ণ না পড়ে আংশিক মূল্যায়ন করে সমাজে বিভাজন তৈরি করা। দুই, ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিশেষ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইসলামকে অপমানিত করার জন্য তাদের এ হীন প্রয়াস। আমার দৃষ্টিতে দ্বিতীয় কারণটি বেশ গ্রহণযোগ্য। এ কারণগুলোর বিশ্লেষণের জন্য বেগম রোকেয়ার ‘নার্স নেলী’ গল্পের মূল্যায়ন করবো যাতে তাঁকে নিয়ে বানানো গল্পের কালো অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং পরিষ্কার হয় ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনে ভারতীয় মুসলামনরা কিভাবে ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল, যা আজও চলছে।
বেগম রোকেয়া গল্পটির শুরুতে স্পষ্ট করে দাবী করেছেন ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত’। অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারতে ঘটে যাওয়া একটি পরিকল্পিত দূরভিসন্ধির চিত্র এই গল্পটি, যা আমাদের ভৌগলিক মানচিত্রের পাশাপাশি মানসিক মানচিত্রকে পাল্টে দিয়ে আমাদের প্রকৃত পরিচয় সম্পূর্ণ ভুলিয়ে দিয়ে সমাজের শিকড় বিহীন পরগাছায় পরিণত করেছে।
এ গল্পের বক্তা জোবেদা ও মূল ঘটনা তার চাচাতো বোন নয়ীমাকে ঘিরে। নয়ীমা যখন তিন বছর তখন মা মারা যাবার পর তার বাবা দিশেহারা হয়ে যায়। ফলে, জোবেদার মা নিজের পাঁচ সন্তানের সাথে নয়ীমাকেও লালন পালন করেছেন। নয়ীমার বাবার টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। তাই নয়ীমাকে পরিচর্যার জন্য যেদিন জোবেদাদের বাড়ীতে আনা হল সাথে পাঁচটি চাকরানীও দেয়া হল। পরিবারের সব মেয়ে যেভাবে কোরআন শিক্ষা লাভ করছিল নয়ীমাও সেভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগল। যখন তার দশ বছর জোবেদার মেজো ভাই জামাল আহমদ প্রায় আট বছর পর বিলেত থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে এল। জামাল কথার এক ফাঁকে নয়ীমার পড়ার খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে সে বাংলা বা ইংরেজি কোনটাই পড়তে জানতো না। তখন সে বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল কেন পড়াশোনা শিখেনি। পড়া শিখলে অন্তত একজন বাঙালি কালেক্টরের স্ত্রী হতে পারতো।
এখানে দু’টি বিষয় ফুটে উঠল। এক, জামাল ইংরেজি শিক্ষিত হবার পরও নারীদের সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি পুরানো। কেননা, নয়ীমার পড়ার প্রয়োজন কেবল ভাল ঘরের স্ত্রী হবার জন্য। তাহলে জামাল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভারতীয়দের জন্য কি বার্তা বয়ে আনলেন? ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হবার পরও সে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য যে ব্যক্তিস্বার্থকেই চরিতার্থ করার ইচ্ছা প্রকাশ পায়। অথচ কথায় কথায় আমরা বাঙালি মুসলমানদের শিক্ষায় অনগ্রসরতার জন্য গালাগাল দিয়ে থাকি। একবারের জন্যও ব্রিটিশ উপনিবেশের পূর্বে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিল বুঝার চেষ্টা করিনি। দুই, অশিক্ষিত বলে বাঙালি পুরুষ নারীদের দাসী বানিয়ে রাখে কিন্তু ইংরেজি শিক্ষিত হয়েও জামাল আহমদ কি করলেন?
ভাগ্যগুনে নয়ীমা শীঘ্রই কালেক্টর জামাল সাহেবের স্ত্রী-ই হলেন। দীর্ঘ নয় বৎসর সুখে সংসার করলেন এবং জমিলা ও জাফর নামে দু’সন্তানের জননী হলেন। দীর্ঘ নয় বছরে একবারের জন্যও মনে হয়নি সে অশান্তি বা দাসত্বের শিকলে বন্দি। নয় বছর পর নয়ীমা অসুস্থ হলে মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও জামাল তাকে শহরের এক হাসপাতালে নিয়ে গেল চিকিৎসার জন্য। শুরু হল যত বিপত্তি। কেননা জামাল আহমেদ বা নয়ীমা জানতোনা চিকিৎসার নামে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক দাসত্বের শিকলে বন্দি করার জন্য ক্রিশ্চান মিশনারির সদস্যরা ফাঁদ পেতে বসে আছে।
আমরা জানি যেকোন দেশে ধর্মান্তরিত বেশির ভাগ মানুষ আর্থিকভাবে অসচ্ছল। তাদের অসচ্ছলতা থেকে বাঁচানোর লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করা হয়। আর ভারতীয় ক্রিশ্চান মিশনারিজদের বেলাতেও একথা সত্য। তাই নয়ীমাকে দেখে মিশনারিজ সিস্টারদের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। কেননা, ‘এই বার দেখিব। পোড়া সমালোচকেরা আর বলিতে পারিবে না যে আমরা কেবল দুর্ভিক্ষ পীড়িত অন্নক্লিষ্ট পথের কাঙ্গাল ধরিয়া কনভার্ট করি।’ আর এমন লক্ষ্য ঠিক করে নিয়মিতভাবে চার পাঁচজন সিস্টার সেবার নামে পালাক্রমে তাকে ক্রিশ্চান ধর্মের দীক্ষা দিতে লাগল এবং সমাজ সংসার, স্বামী-সন্তান সম্পর্কে বিষিয়ে তুলল। এখন তার কোন কিছুই ভাল লাগে না। কেবল খ্রীস্টান ধর্ম তার ধ্যান জ্ঞান হয়ে গেল।
ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে উপনিবেশ স্থাপন করার পূর্বে চক্রান্তকারীরা সে দেশের দুর্বলস্থান সমূহ চিহ্নিত করতো এবং মানবিক দিকগুলিকে ধীরে ধীরে দুর্বল করার চেষ্টা করতো। এখানেও সিস্টাররা প্রথমে নয়ীমার দুর্বল স্থানগুলি চিহ্নিত করেছে এবং এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, নয়ীমা ‘নিজের ধর্ম্ম সম্বন্ধীয় দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস কিছুই জানেনা’। তাই নয়ীমার ‘নির্ম্মল অন্তরে যীশু মহিমার গভীর রেখা অঙ্কিত হইল।’ এখানেও দু’টি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এক, মুসলমানরা ইসলাম ধর্মের মধ্যে ‘দর্শন, বিজ্ঞান ও ইতিহাস’ আছে তা জানার চেষ্টা করে না। বরং তোতা পাখির মত মুখস্থ করে অথবা একে তাবিজ বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখে কিন্তু এর যে বিশাল কার্যক্ষমতা আছে তা জানবার চেষ্টা করে না। দুই, অন্যরা যখন আমাদের কোন দুর্দিনে এগিয়ে আসে আমরা তাদের উদ্দেশ্য না জেনে আমাদের সব তাদের বিলিয়ে দিয়ে একসময় সর্বস্বান্ত হয়ে যাই। আর তখনই উপনিবেশিক শক্তি আমাদের যা শিখায় বা তারা যা বলে আমরা তাই বিশ্বাস করি। জার্মান দার্শনিক গ্রামস্কির মতে ‘হেজিমনিক’ জ্ঞানের কারণেই আমাদের এ দুরবস্থা। কিন্তু নয়ীমার এ দুরবস্থা দেখে রোকেয়া মন্তব্য করলেন, ‘তিনি ক্রমে আরোগ্য লাভ করিতে লাগিলেন, কিন্তু তাঁহার অন্তর কলুষিত হইতে আরম্ভ করিল। যে কখনও আলোক দেখে নাই, তাঁহার নিকট জোনাকীর আলোই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বোধ হয়। নয়ীমার দশাও সেইরূপ।’
নয়ীমা হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফিরে এসেই সবার সাথে বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শুরু করল। তাই এক সকালে জোবেদার মাকে ‘কৈফিয়ৎ তলব করিলেন যে তাঁহাকে উচ্চশিক্ষা দেওয়া হয় নাই কেন?’ এতে পরিবারের সবাই বিস্মিত হয়ে যায় এবং ভাবেন দীর্ঘ রোগভোগের কারণে হয়তো নয়ীমা একটু অপ্রকৃতস্থ। তাই জোবেদার মা শান্ত গলায় আদর করে নয়ীমাকে বলল, ‘পাগল মেয়ে বলে কি?’
এতেই নয়ীমা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং একের পর এক প্রশ্নবানে সবাইকে অপমান শুরু করল। সে বলল, ‘এক অক্ষর লেখা পড়া শিখান নাই যে, আজ ভদ্রসমাজে বসবার উপযুক্ত হতেম। … মূর্খ লোকেরা শিক্ষা মর্ম্ম কি বুঝবে।’ প্রাথমিকভাবে নয়ীমাকে সঠিক বলে ধারণা করবেন কেউ কেউ। কিন্তু সিস্টারদের কাছে যে শিক্ষা পেয়ে বয়োজেষ্ঠ্যদের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার করছে তা কি আমাদের শঙ্কিত করে না?
আমরা জানি বেগম রোকেয়া সারা জীবন নারী শিক্ষার জন্য আন্দোলন করে গেছেন। তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন সমাজের প্রচলিত ধ্যান ধারণা পাল্টিয়ে নারী পুরুষকে সুশিক্ষার পথে আনতে। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে এখানে তিনি সে সময়ে নারীদের শিক্ষার প্রতিবন্ধকতাগুলো কোথায় ছিল সেটিও চিহ্নিত করেছেন। তিনি জোবেদা ও তার মায়ের মুখ দিয়ে সে সময়ের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেন এভাবে, ‘আমি পড়াশোনা শেখা মন্দ বলছি না; কিন্তু আমরা পাড়াগাঁয়ে থেকে সুবিধা করতে পারিনি। মেয়েদের জন্য স্কুল নেই, মক্তব নেই, পাঠশালা নেই। ঘরে পড়াবার জন্য ভাল শিক্ষয়িত্রী পাওয়া যায় না।’
এখানে যা স্পষ্ট, তা হলো যে, সত্যিকার অর্থে মুসলিম নারী বা পুরুষ কেউ শিক্ষার বিপক্ষে নয়। দুই, ব্রিটিশরা এদেশ দখলের পর যদি মানুষের মঙ্গল কামনা করতো তবে সর্বত্র শিক্ষালয় স্থাপন করতো। কিন্তু তা না করে বরং কোথাও কোথাও স্থানীয় মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। যেমনটি বেগম রোকেয়ার বেলাতেও ঘটেছে। তিন, যে সব বুদ্ধিজীবীরা ঔপনিবেশিক শাসনামলে নারী শিক্ষার প্রতিবন্ধকতার জন্য মুসলমান পুরুষদের আধিপত্যবাদী মানসিকতার কথা বলেন, তার বিরুদ্ধেও এক অনন্য দলিল এই বক্তব্যগুলি। চতুর্থ, মুসলমানরা যে নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার তা এখানে ওঠে এসেছে।
তবে উল্লেখিত আলোচনার পিঠে কেউ আবার প্রশ্ন করতে পারেন, মিশনারিজ স্কুলে পড়াতে বাধা কোথায় ছিল অথবা সিস্টারদের বাসায় এনে প্রথমে যদি স্বচ্ছল মুসলিম নারীদের পড়ানো হতো তবে পরবর্তীতে তারাই হতদরিদ্রদের শিক্ষিত করতে পারতো। এ ধরনের চিন্তার জবাবও এ গল্পে পাওয়া যায়। জামাল আহমদের ময়ে জমিলাকে পড়া লেখা শিখাতে বাসায় একজন ইউরোপীয় গবর্নেস নিযুক্ত করা হলো। তিনি ‘তাঁহার নিয়মানুসারে প্রথমে বাইবেল হইতে গল্প বলিয়া পরে অন্য কাজ আরম্ভ করিতেন।… পরে তিনি ধীরে ধীরে স্বীয় প্রভাব বিস্তার করিয়া একাধারে আমার ভাবীজানের সঙ্গিনী, জমিলার শিক্ষয়িত্রী, এবং এ সংসারের গৃহিণী হইলেন। এখন মিস লরেন্স এ বাড়ীতে সর্ব্বেসর্ব্বা।’
এখানে কি স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি কেন সে সময়ে মুসলমান পরিবারগুলো মিশনারিজ পাঠশালা ও সিস্টারদের কাছ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতেন?
একদিন সবাইকে রেখে নয়ীমা ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষিত হলো এবং বাড়ী ছেড়ে চলে গেলেন ‘লাল কুঠি মিশনে’। সাথে নিয়ে গেলেন ২৫০০০ টাকা মূল্যমানের স্বর্ণগহনা এবং নগদ ১৭০০০ টাকা। আর নিজের নামও পরিবর্তন করে নিলেন মিশনের পরামর্শে। তিনি হয়ে গেলেন ‘নেলী’। এখানে প্রথমত প্রশ্ন জাগে ধর্মের টানে বাসা ছাড়ার সাথে এত গহনা ও টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলেন কেন? আর সিস্টাররা সে পরামর্শ কেন দিলেন? আর নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে কি নিজের সর্বস্ব হারানোর পথকে পরিষ্কার করেননি? যদিও গহনা ও নগদ টাকার বিষয়ে আদালত রায় দিয়েছে নয়ীমা তথা নেলীর পক্ষে কিন্তু মিস লরেন্স আদালতে যেভাবে যুক্তি উপস্থাপন করলেন এবং জামাল সাহেবের উকিলদের বাধা দিয়ে এটা প্রমাণ করেছে সে সময়ে আদালত ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ ছিল।
লালকুঠিতে নেলী প্রথম প্রথম বেশ আমোদেই ছিলেন কিন্তু দিনে দিনে তার সাথে থাকা গহনা ও টাকা নানা উপায়ে খসিয়ে নিল মিশনের ফাদার ও সিস্টাররা । একপর্যায়ে ‘নয়ীমাকে মুষ্টি অন্নদান করা ও তাঁহাদের পক্ষে ভার বোধ হইতে লাগিল। এখানে সবাই খাটিয়া খায়, বাড়ী বাড়ী পড়াইতে যায়, প্রচার করিতে হয়। কেবল নয়ীমা বসিয়া খাইবে কেন? শেষে তাঁহারা নয়ীমাকে হাসপাতালে নার্সগিরী করিতে দিলেন।’ আর নেলীর ভাগ্যে নির্মমতা এত বেশি ছিল যে স্বাভাবিকভাবে বর্ণনা করাও কঠিন। কেননা, সে মূলত হাসপাতালে অসুস্থ রোগীদের মল-মূত্র ও ক্ষত শরীরের রক্ত পরিষ্কার করত। কিন্তু তার নামের সাথে নার্স যোগ করা ছিল একটি কৌশল যাতে ভারতীয়রা মনে করে মিশনের লোকেরা এদেশের মানুষদের উপযুক্ত কাজ দিয়ে যোগ্যতার মূল্যায়ন করে। ব্রিটিশরা কখনো এদেশের মানুষদের সঠিক মূল্যায়ন করেনি। তাই বেগম রোকেয়াকে দেখি আমাদের এ অজ্ঞতাকে ব্যঙ্গ করতে।
জামাল আহমদ বিলেত থেকে পড়াশোনা করে এসে এদেশে কালেক্টর হয়েছেন। তাই জোবেদা ব্যঙ্গ করে বলছে, ‘ভাইজান, আপনি বাংলা, ইংরাজী অনেক পড়ে বিলাত গিয়ে, শেষে এতদিনে জেলা মেজিস্ট্র্রেট, না, কালেক্টর হয়েছেন।’ আমরা কি জোবেদার এই ব্যঙ্গ কথাগুলোর সত্যিকারের অর্থ বুঝতে পারি?
ধর্মে দীক্ষিত হবার পর নেলীকে শিখানো হলো ইসলাম ধর্মকে আঘাত করতে। কেননা যেহেতু সে অর্থসহ কোরআন পড়েছে তাকে দিয়ে আঘাত করা সহজ হবে। তাই ‘নয়ীমা তাঁহার কোরান শরীফখানি সঙ্গে আনিয়েছিলেন যে অকাট্য যুক্তি দ্বারা তাহার প্রত্যেকটা আয়েৎ খন্ডন করিয়া জগৎকে দেখাইবেন, মুসলমান ধর্ম্ম কেমন অসার; অন্ধ বিশ্বাসীর ধর্ম্ম।’ কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাসের শিকার তা বুঝতে নয়ীমাকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। তাই দিনে হাসপাতালে মল-মূত্র পরিস্কার করে রাত জেগে আল্লাহর দরবারে কান্নায় পড়ে থাকতো নেলী। ‘সোবহান্ আল্লাহ! রাত্রি জাগিয়া নামাজ পড়ায়- অশ্রু প্লাবনে সেজদার স্থান ভিজাইয়া দেওয়ায় এতে শান্তি লাভ হয়!’
আর এ প্রেক্ষাপটে বেগম রোকেয়া বলেন, ‘নয়ীমা স্বকৃত পাপের ফল ভোগ করিতেছে- ইহা ত তাহার ন্যায্য প্রাপ্য, তাহাতে আমার দুঃখিত হইবার কারণ কি?’ আমরা সত্যিকারে নয়ীমার জন্য করুণাবোধ করি কিন্তু দুঃখবোধ করি ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য যে মুসলমানরা দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের কারণে সব হারানোর পরও নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে অধ্যয়ন করেনা। বরং অন্যের লিখিত মিথ্যা ইতিহাস পড়ে পূর্বপুরুষদের গালমন্দ করে।
নয়ীমার হেন আচরণে ফলে জোবেদার মা দুই মাসের মধ্যে মারা যায়। আর তার দু’সন্তান জমিলা ও জাফর এক বছরের অন্তরে পরবাসী হয় এবং জামাল আহমদ চাকুরী ছেড়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এসবের জন্য কে দায়ী, নয়ীমা না মিশনের দুষ্টচক্রান্তকারীরা? যদি মিশনের লোকেরা দায়ী হয় তবে আজো আমরা কেন তাদের রেখে যাওয়া নোংরা পথেই নিজেদের পরিচালিত করে তথাকথিত আধুনিক বলার চেষ্টা করছি?
এ গল্পে আরেকটি বাস্তবতা তুলে ধরেছেন বেগম রোকেয়া তা হলো নারী শিক্ষায় যাঁরা অবদান রাখেন তাদের কেউ মনে রাখেনা বরং যারা ভোগবিলাসিতায় জীবন যাপন করে মানুষকে বিপথে নিয়ে যায় তাদের স্মরণ করি। তিনি আগ্রায় তাজমহলে শায়িত মমতাজের কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন রাখেন নারী অগ্রগতিতে কোথায় তিনি অবদান রেখেছেন? অথচ, ‘আর নূরজাঁহান বেগম? তার স্মৃতি রক্ষার জন্য কণামাত্র আয়োজন করা হয় নাই। …. অনেকে সে কবরস্থানের অস্তিত্ব পর্যন্ত জানেনা।’ তাই তিনি বেশ আক্ষেপ করে বলেন, ‘কিন্তু নূরজাঁহান বেগম চিরস্মরণীয়া হইয়া থাকিবেন। সে কি বস্তু, যাহা নূরজাঁহানকে অমর করিয়াছে? ঐ শিক্ষা। সুশিক্ষার প্রসাদে জগজ্জ্ব্যোতিঃ জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন। খোদা না খাস্তা ভূমিকম্পে কিম্বা কোন প্রবল শত্রুর কামানে তাজমহল ধ্বংস হইতে পারে, কিন্তু নূরজাঁহান বেগমের স্মৃতির মৃত্যু নাই।’
বেগম রোকেয়ার এ গল্প থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি। কেননা, প্রথমত, আমরা সব সময় রোকেয়ার পর্দা ও নারী শিক্ষার চিন্তাকে ইসলাম ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে দেই এবং ইসলাম ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করার মাধ্যম বিশেষ স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করি। রোকেয়াকে ভুল উপস্থাপনের মাধ্যমে আমরা তাঁকে এবং তাঁর বিশ্বাসকে খাটো করছি। তিনি ধর্মকে বেশ শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার আহ্বান করেছেন। দ্বিতীয়ত, নারী শিক্ষায় যাঁরা অবদান রেখেছেন তাদের অবমূল্যায়ন করে সত্যিকারের নারী শিক্ষা বিস্তার করা সম্ভব কিনা তাও ভেবে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন, নওয়াব ফয়জুন্নেছা বাঙালি নারীদের শিক্ষার জন্য যে অবদান রেখেছেন তা কেউ মূল্যায়ন করে না। কেননা সে মূল্যায়নের মাধ্যমে ফয়জুন্নেছার ধর্ম বিশ্বাস সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠবে, এমন আশঙ্কা থেকেই তাকে কেউ স্মরণ করে না। অথচ আজ নারী শিক্ষার অবদানের জন্য কোন এক পাকিস্তানি পুতুলকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করলে আমরা আনন্দে লাফাতে থাকি ।
এ গল্পের সমাপ্তিটি বেশ করুণ। কেননা, নেলী মারা গেলে মিশন তাকে মাটি পর্যন্ত দিতে রাজী হয়নি। কারণ ইতিমধ্যে তাদের কাছে নয়ীমা তথা নেলীর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। তাই তার মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জামাল আহমদের কাছে টেলিগ্রাম পাঠায়, ‘কবর প্রস্তুত রাখ, নার্স নেলীর শবদেহ পাঠানো হইল।’
পরিশেষে এ গল্পের যে শিক্ষা তা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশেষ করে মুসলমান ধর্মের সঠিক পথ অবলম্বন না করলে মানুষের পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে তা নার্স নেলীর চেয়ে কেউ বেশি বুঝার কথা নয়। তাছাড়া যারা ক্রমাগতভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশে মুসলামনদের পিছিয়ে পড়ার জন্য তাদের পশ্চাৎমুখীতার কথা বলেন তারা এ গল্প থেকে সঠিক তথ্যটি নিয়ে পরিশুদ্ধ হবার শপথ নিয়ে দেশকে শিকড়বিহীন করার হাত থেকে রক্ষা করবেন বলে আশা করছি, গল্পের শুরুতেই বেগম রোকেয়া দাবী করেছেন সত্যি গল্প অবলম্বনে এটি লেখা। আর একথাও পাশাপাশি স্বীকার করবো ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিশ্চান মিশনারিগুলোর মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি কখনো ভাল ছিল না বরং সেগুলি তাদের অন্তরের বিষ মেশানো কালো অধ্যায় যার দলিল এই গল্পটি।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com