রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৮ পূর্বাহ্ন

সুজন কাজের ফাঁকে ইংরেজী বলে ভাইরাল

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় রবিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩

দিনমজুরির কাজ করতে করতে সুন্দর করে ইংরেজিতে কথা বলছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছেলে সুজন পাহান। আর এইসব ভিডি কন্টেন্ট বানিয়ে ইতি মধ্যে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে বর্তমান ভাইরাল সে। সুজন বাড়ি ঠাকুরগাঁও রুহিয়া থানার কশালগাঁও গ্রামে। আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায় তারা। সুজনের জন্মে দুই বছর পর মারা যান বাবা বগা পাহান। দুবছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে চলে মা দুলালী পাহানের অভাবের সংসার। অন্যের বাড়িতে কাজ করে ছেলের লেখাপড়া করান দুলালী পাহান। পঞ্চম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তার মা অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। এরপর মায়ের দেখাশোনা ওষুধসহ সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে সুজন পাহানের কাঁধে। নিজে কর্ম করে খাওয়ার মতো কিছুই রেখে যাননি তার বাবা। বসভিটা টুকুও অন্যের। কিন্তু মায়ের স্বপ্ন, অভাবের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়ে উঠা একমাত্র মেধাবী ছেলে একদিন অনেক বড় চাকরি করবে। মায়ের স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে সুজন মাঠে কাজ করার পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা অব্যাহত রেখেছেন। সুজনের সহপাঠীরা শিক্ষাজীবন থেকে অকালে ঝরে পড়লেও সুজন কষ্ট করে নিজের শিক্ষা-জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুজন বর্তমানে রুহিয়া ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রি ২য় বর্ষের পরিক্ষা দিয়ে ৩য় বর্ষে ভর্তির অপেক্ষায় আছেন। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাতে কাস্তি নিয়ে ফসলের মাঠে ধান কাটতে কাটতে, কখনও আবার গৃহস্থালির কাজ করতে করতে, চলতে ফিরতে শিশুদের নিয়ে সব সময় ইংরেজিতে কথা বলার চর্চা জারি রেখেছেন অদম্য সুজন। প্রতিবেশীরা ভিনদেশি ভাষা বুঝতে না পারায় অনেক সময় হাসি-ঠাট্টা করে তাকে পাগলও বলে। তবুও ইংরেজিতে কথা বলার চর্চা থামাননি এই যুবক। ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘর থেকে তিনি স্বপ্ন দেখেছে নিজের জীবনমান উন্নয়ন করে কীভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের সামনে এগিয়ে নেয়া যায়। তাদের কাছে নিজেকে অনুপ্রেরণা হিসেবে গড়ে তোলার। সুজন পাহানের মামা সুটকেস পাহান বলেন, আমার ভাগিনার বয়স ২ বছর তখন তার বাবা মারা যায় এবং আমি তাকেসহ আমার বোনকে নিয়ে আসি আমার বাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি সে মানুষের বাসায় কাজ করত। বেশ কিছু দিন ধরে সে ইংরেজিতে কথা বলে এতে আমরা সবাই অবাক হই। অনেক কুটুক্তি করি। কিন্তু এখন ইনটারনেটে তাকে সবাই চেনে। আমরা অনেক খুশি। প্রতিবেশী বালা পাহান বলেন, সুজন যখন ইংরেজীতে কথা বলে সে যে বাংলাদেশের ছেলে এটা বুঝা যায় না। মনে হয় কোন বেদিশী কথা বলতেছে। আমরা সবাই অবাক হয়ে তার কথা শুনি। এটা আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য গৌরবের। সে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে এবং দিন মজুরের কাজ করে তার মাকে দেখে। সুজনের সহপাঠি নাজমুল সাকিব বলেন, সুজন আমার ক্লাসমেট। সে বেশির ভাগ সময় কলেজে আসে না। কাজ করে মানুষের বাসায়। কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে তার ইংরেজী বলা ভাইরাল ভিডিও দেখছি। সে যে এত মেধাবী আগে জানতাম না। আমরা কলেজের সব ক্লাসমেট গর্বীত। রুহিয়া ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক জাহাঙ্গীর বলেন, সুজন পাহান অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। তার ইংরেজী বলার ধরণ অবাক করার মত। এটা আমাদের কলেজের গর্ব। তার লেখাপড়ার জন্য আমাদের কলেজ থেকে সুজন পাহানকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। সুজন পাহান বলেন, স্মার্ট ও টেকনোলজির যুগে ভালো কিছু করতে গেলে বাংলা ভাষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শেখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অভাব অনটনের সংসারে যেখানে পাঠ্যবই পড়ার সময় নেই। সেখানে ভালো ইংরেজি শিখতে চাওয়াটা নিজের কাছেও কখনো কখনো অপ্রাসঙ্গিক লেগেছে, তবে প্রবল আগ্রহ ও ইচ্ছাশক্তির কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। আমি ফেসবুকে ইংরেজিতে কথা বলার ভিডিও দেখেই ইংরেজি রপ্ত করার চেষ্টা করেছি এবং নিজের ইংরেজি চর্চার ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করছি। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজি কোর্স করার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি জীবনে। সুজন বলেন, সারা দিন ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করি। মানুষ হাসি-ঠাট্টা করে। অনেকেই ভাবে আমার বুঝি মাথার সমস্যা দেখা দিয়েছে, কিন্তু আমি এসবের তোয়াক্কা করি না। মাঠের ফসলের সঙ্গে কাজের সময়, গৃহস্থালির কাজে ও গবাদি পালনের সময় সবখানে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করি। মাঠে কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে নিত্যদিনের খরচ আর জীবনযাপনে চলে যায়। একটি ছোট চাকরি হলেও স্বপ্ন পূরণে একধাপ এগোতে পারবো। সুজনের মা দুলালি পাহান বলেন, আমার ছেলের ইচ্ছাশক্তি অনেক। অনেক কষ্টে তাকে বড় করেছি। যদি নিজে কাজ করতে পারতাম তাহলে তাকে কখনও সংসার সামলাতে এত চাপ নিতে হতো না। ছেলেটার একটি চাকরি হলে খুব ভালো হতো। নিজেকে মেলে ধরে দেশের কল্যাণে কাজ করতে পারতো। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বেলায়েত হোসেন বলেন, মেধাবী ও প্রতিভাবান যারা আছে তাদের জন্য সরকার সব সময় কাজ করছে। আমরা যারা সরকারের প্রতিনিধি আছি আমাদের কাজ সরকার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। ইতি মধ্যে সুজব পাহানকে আমি একটি ফোন উপহার দিয়েছি। উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে সব ধরণের সহযোগিতা করা হবে প্রয়োজন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com