প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং ধানমন্ডিতে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। দেশের মহান সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি প্রথমে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাংলাদেশ সশস্র বাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকষ দল এ সময় রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়, তখন বিউগেলে করুণ সুর বাজানো হয়। পরে দলের নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান হিসেবে শহীদ বেদীতে আরও একটি পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। প্রধানমন্ত্রী এখানে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কুশল বিনিময় করেন। এরপর তিনি রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে গিয়ে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর এই অবিসংবাদিত নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে তিনি সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
এখানেও প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান হিসেবে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আরেকটি পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। গতকাল ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আল-বদর, আল-শামসরা তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্তে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আল-বদর ঘাঁটিতে নির্মম নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুরের জলাভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বি, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দিন হোসেন, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এস এ মান্নান, সাংবাদিক ও কবি সেলিনা পারভীন, সাহিত্যিক মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক অনোয়ার পাশা, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ সহ আরো অনেকে। বুদ্ধিজীবী হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
দেশকে কখনোই পরাজিত শক্তির দোসরদের হাতে তুলে দেওয়া হবে না : প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অগ্নিসংযোগকারি ও রেললাইনের ফিশপ্লেট উপড়ে ফেলার সঙ্গে জড়িতদের একাত্তরের পরাজিত শক্তির দোসর হিসেবে বর্ণনা করে দেশকে তাদের হাতে তুলে না দেওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “যারা অগ্নিসংযোগ করছে এবং রেললাইনের ফিশপ্লেট তুলে ফেলছে তারা পরাজিত শক্তির (একাত্তরের) দোসর। আমরা কখনই পরাজিত শক্তির হাতে দেশকে তুলে দেব না।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে একথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, যারা এদেশে জ্বালাও-পোড়াও অগ্নিসংযোগ করে, রেল লাইনের ফিসপ্লেট তুলে ফেলে এরাতো পরাজিত শক্তির দালাল, পরাজিত শক্তির দোসর। কাজেই এদেরকে না বলুন। এদের বাংলাদেশের রাজনীতি করারই কোন অধিকার নেই। খুনি, সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী, দুর্নীতিবাজ এদের বাংলাদেশে কোন স্থান নেই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশের মানুষ তাদের অধিকার, ভোটের অধিকার ফিরে পেয়েছে। তারা সেই ভোটের অধিকার প্রয়োগ করবে। তারা শান্তিতে বাস করবে। উন্নত জীবন পাবে সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
তিনি জাতির পিতা মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, “আমরা এই দেশকে আর কখনো এই পরাজিত শক্তির হাতে তুলে দেব না।”
“বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে চলবে এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী জাতি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে, শহীদদের কাছে এটাই আমাদের অঙ্গীকার,” যোগ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, এমপি, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য অ্যাডভোকেট তারানা হালিম, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সহ-সভাপতি যথাক্রমে শেখ বজলুর রহমান ও নুরুল আলম রুহুল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ফয়জুর রহমান আহমেদের ছেলে ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলিম চৌধুরীর মেয়ে অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠ করেন।
আলোচনা সভাটি সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, এমপি এবং সহপ্রচার সম্পাদক সৈয়দ আব্দুল আউয়াল শামীম।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে মানুষ সেবা পায়। এখনতো মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিটি মৌলিক অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি। আজকে বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। আর এই সম্মানটা দিতে পারে না আমাদের দেশের কিছু কুলাঙ্গার। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন ওই হানাদার বাহিনীর দোসর যারা ছিল এরাই তাদের প্রেতাত্মা হয়ে মানুষের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। আর মানুষ হত্যার পরিকল্পনা করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে আমার একটা আবেদন থাকবে প্রত্যেকটি এলাকায় যেখানে রেললাইন আছে যানবাহন চলাচল করছে সেখানে যখন কোন ঘটনা ঘটাবে সাথে সাথে জনগণ যদি মাঠে নামে এরা হালে পানি পাবে না। কাজেই আমি জনগণের কাছে আহ্বান জানাবো সকলকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ, এরা কেবল ধ্বংস করতে জানে এরা কোন কিছু সৃষ্টি করতে জানে না। এরা কেবল মানুষ খুন করতে পারে মানুষের জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে পারে না। এরা মানুষের সর্বনাশ করতে পারে কিন্তু মানুষের জীবনটাকে উন্নত করতে পারে না। আর কোথাও এ ধরণের রেলের ফিসপ্লেট তুলে ফেলা বা রেললাইন তুলে ফেলা, আগুন দেওয়া-যখনই যে করতে যাবে সরাসরি তাদেরকে ধরতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। রেলে চড়ে মানুষ যাবে সেখানে রেললাইন তুলে ফেলে দিয়ে মানুষ হত্যা করবে, তারা আবার কথা বলে কোন মুখে? “হত্যাকারীরা কখনো গণতন্ত্র দিতে পারে না। এটা দেশের মানুষকে বুঝতে হবে,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, আজকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমরা আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবীদেরকে হারিয়েছি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি। আর শহীদের রক্ত কোনদিন বৃথা যায় না। বৃথা যায়নি। আজকের বাংলাদেশ এই ১৫ বছরে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি এবং সেই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।