সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের গ্রুপ, সাব-গ্রুপ। সংগঠনের কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা নেতাদের গ্রুপিং, এমপি-অ্যান্টি এমপি গ্রুপিং দীর্ঘদিনের। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নের পর এখন প্রকট হয়ে উঠেছে মনোনীত আর স্বতন্ত্রের দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন জায়গায় সংঘাতেরও খবর পাওয়া যাচ্ছে। গঠনতন্ত্র লংঘন হলেও নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সুযোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন সামাল দিতে গিয়ে প্রকারান্তরে আসনে আসনে দ্বন্দ্ব সংঘাতই উসকে দিচ্ছে দলটি। তৃণমূল নেতারা দলের এ সিদ্ধান্তকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানালেও ভেতরে ভেতরে বলছেন, ‘স্বতন্ত্রই এখন তাদের গলার কাঁটা।’ সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থিতার দ্বন্দ্ব নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘শতফুল ফুটতে দিন। সবচেয়ে সুন্দরটা আমি বেছে নেবো।’
দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর এই শতফুলের কাঁটা নিয়ে তৈরি হয়েছে দুশ্চিন্তা। ৩০০ আসনের মধ্যে শীর্ষনেতা ও মন্ত্রী পর্যায়ে মাত্র ৩২ নেতার আসন বাদ দিয়ে বাকি সব আসনে রয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাদের বেশিরভাগই দলের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীই বেশি শক্তিশালী। এটিই এখন আওয়ামী লীগকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। দল হিসেবে দ্বিধাবিভক্ত করার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি আসন হাতছাড়া হওয়ারও জোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি এনিয়ে দীর্ঘদিনের সঙ্গী ১৪ দলীয় জোট শরিকদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে চরম ক্ষোভ।
এ বিষয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের জবাব, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর অনুমতি দলের প্রয়োজনে কৌশলগত সিদ্ধান্ত। স্বতন্ত্র প্রার্থী যদি হেভিওয়েট কারও সীমানা পেরিয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যায় (জয়ী হয়), এটাতে আমরা বাধা দিতে পারি না। গণতন্ত্র হলো প্রতিযোগিতা। সুষ্ঠু নির্বাচন, সুস্থ প্রতিযোগিতা। এখানে প্রার্থীকে প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করি আমরা। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর অনুমতি দলের প্রয়োজনে কৌশলগত সিদ্ধান্ত। স্বতন্ত্র প্রার্থী যদি হেভিওয়েট কারও সীমানা পেরিয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যায় (জয়ী হয়), এটাতে আমরা বাধা দিতে পারি না। গণতন্ত্র হলো প্রতিযোগিতা। সুষ্ঠু নির্বাচন, সুস্থ প্রতিযোগিতা। ‘আওয়ামী লীগ থেকে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাদের বহিষ্কারের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেই’ বলেও জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক।
কেন্দ্রের এমন নির্দেশনা ও মনোভাবের কারণে এ নিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা কিছু বলতে পারছেন না। কিন্তু এ নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছেন তারা। বিশেষ করে, যেসব জায়গায় নৌকার প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র শক্তিশালী, সেখানে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুই করার নেই আপাতত।
তবে এ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো। জোট শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, জোটকে আসন ছেড়ে দেওয়ার পরও আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতা স্বতন্ত্রের নামে সেখানে লড়াই করছে। তাহলে সেটা আওয়ামী লীগ বনাম জাসদ, আওয়ামী লীগ বনাম ওয়ার্কার্স পার্টি বা আওয়ামী লীগ বনাম তরিকত ফেডারেশন হয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের জোটের যে নীতি, সেই নীতি তো মার খাচ্ছে এই নির্বাচনে। এতে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে। জোট ও দলের ভেতরে বিশৃঙ্খলা হবে। দল দীর্ঘদিনের জন্য ভাগাভাগিতে পড়ে যাবে। এটা রাজনৈতিক রুচিরও বাইরে। রাজনৈতিকভাবে আমি মনে করি না এই স্বতন্ত্র কৌশলে লাভের কিছু আছে। আমি মনে করি এটাকে উৎসাহিত করার দরকার নেই।
তিনি বলেন, জোটের আসনে আওয়ামী লীগের বড় নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর অর্থ হচ্ছে, এক হাতে দিয়ে আরেক হাতে সিটটা কেড়ে নেওয়া। আমি আশা করি, জোটনেত্রী শেখ হাসিনা ও জোটের সমন্বয়ক; তারা বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন।
জানা গেছে, ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের ছয়টি আসন ছাড়ার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তবে এ ছয়টি আসনেই রয়েছে আওয়ামী লীগের শক্ত বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী। তারা থাকলে ভোট ভাগ হবে। জোটপ্রার্থীদের বিজয়ী হয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়বে। একইভাবে সারাদেশের ৩২ আসন ছাড়া সবকটি আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আছে। এসব আসনে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ হচ্ছে। পাশাপাশি নিজ দলের বিদ্রোহীর কাছে নৌকা হেরে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়ে যাচ্ছে।
কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। উপজেলা নির্বাচনে এমপিকে চ্যালেঞ্জ করে তার প্রার্থী পরাজিত করে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ। এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যানের মারামারি গণমাধ্যমের কল্যাণে ভাইরালও হয়েছে। সেই আবুল কালাম আজাদ চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। পরিস্থিতি কী হবে, আগের ঘটনা থেকে অনুমেয়।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। এখানে স্বতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছেন বর্তমানসহ তিনবারের এমপি ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরী।
নির্বাচনেও মুখোমুখি দুই গ্রুপ: ফরিদপুর-৪ আসনে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহ আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এখানে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন) স্বতন্ত্র প্রার্থী। গত দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এই প্রার্থীকেই হারিয়ে নিক্সন এমপি হয়েছেন। ফরিদপুর-৩ আসনে নৌকা মনোনীত প্রার্থী শামীম হকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী এ কে আজাদ। নির্বাচনের লড়াইয়ের আগেই তারা লড়াইয়ে নেমেছেন মনোনয়ন বাতিল ঘিরে। একই চিত্র বরিশাল-৪ এ। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শাম্মী আহম্মেদের প্রার্থিতা বাতিলে আদা-জল খেয়ে নেমেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমানে নৌকার এমপি পঙ্কজ নাথ। এরকম বেশ কয়েকটি জায়গায় নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটের আগেই লড়াইয়ে নেমেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। ভোট কী হবে, সহজেই অনুমেয়। বরিশাল-৫ আসনে নৌকার প্রার্থী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। একই চিত্র নরসীংদী-৫, মাদারীপুর-৩, কুমিল্লা-৮, নোয়াখালী-২ সহ ২৬৮ আসনে। এসব প্রার্থী মাঠে থাকলে ফলাফল সহজেই অনুমেয়।
নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী নৌকার প্রার্থীর জন্য চ্যালেঞ্জ কি না, এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন বলেন, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী যদি এলাকায় জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেন, যদি প্রার্থীর নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় থাকে, জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকে, এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কোনো সমস্যা নয়। যেখানে প্রার্থীর সঙ্গে নেতাকর্মীদের সমন্বয়ের অভাব আছে, জনগণের আস্থার অভাব আছে, সেখানে হয়তো সংকট তৈরি হতে পারে। আমার জানামতে অনেক আসনে এ সমস্যা নেই। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে কোনো সমস্যা নয়। এতে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বতাপূর্ণ হচ্ছে। স্বতন্ত্র কেউ নির্বাচিত হয়ে আসতে পারলে ভালো। এতে কোনো সমস্যা নেই। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোট উৎসবমুখর করতে সহায়ক হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে কিছু সমস্যা তো হতেই পারে। গত মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) জোটের শরিকদের আপত্তি ও দলীয় প্রার্থীদের অস্বস্তি থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো বিকল্প নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের সুযোগ নেই।- (ছবি ও খবর জাগোনিউজ২৪.কম-এর সৌজন্যে)