দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। ছোট ছোট কিছু দল, যেগুলোর কোনো ধরনের জনভিত্তি নেই কিংবা সরকারের আনুকূল্যে গঠিত ‘কিংসপার্টি’ নামে পরিচিত, সেগুলো নির্বাচন করছে। এসব দলে বিএনপির সাবেক নেতাদের ভিড়াতে চেষ্টার ত্রুটি করা হয়নি। তাতে যে সাড়া মেলেনি, তা ইতোমধ্যে পরিস্কার হয়ে গেছে। বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অন্যান্য ইসলামপন্থী দল, যাদের ব্যাপক জনভিত্তি ও অনুসারী রয়েছে, তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ফলে আগামী নির্বাচনটি যে একতরফা হতে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগের সামনে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দেশি-বিদেশি যে চাপ রয়েছে, সে চাপ উপেক্ষা করেই আরেকটি নির্বাচন করতে যাচ্ছে, যা দেশের জন্য এক ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করবে বলে, ইতোমধ্যে সচেতন নাগরিক সমাজ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ সংকট শুধু রাজনৈতিক নয়, চলমান অর্থনৈতিক যে সংকট, তা আরও গভীর করে তুলবে। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সরকার যেনতেনভাবে নির্বাচন করে ফেলবে ঠিকই, তবে নির্বাচনের পর অর্থনীতিতে সুনামি বয়ে যাবে, যা সামাল দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। দেশ এক গভীর সংকটে নিক্ষিপ্ত হবে। আমরা যদি শুধু অর্থনীতির দিকে তাকাই তাহলে দেখব, প্রত্যেকটি সূচক নি¤œগামী। যে জিডিপি নিয়ে সরকার ঘন ঘন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করত, তা প্রায় ৫-এ নেমে এসেছে। আমদানি-রফতানি, বিনিয়োগ, গার্মেন্ট খাতে শঙ্কাজনকভাবে অর্ডার কমে যাওয়া, জনশক্তি রফতানিতে ধস, রিজার্ভের ক্রমাগত অবনতি, মাথাপিছু আয় কমে যাওয়া, বেকারত্ব বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠা ইত্যাদি বিষয়গুলো এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। সার্বিক অর্থনীতির এই দুর্দশার মধ্যেই একটি একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যাতে খরচ হবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
দুই.
সরকার একতরফা নির্বাচন করবে, এটা জানা কথা। তার লক্ষ্য, যেভাবেই হোক ক্ষমতায় থাকা। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করা নিয়ে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার পরামর্শ এবং বিরোধীদলগুলোর দাবি উপেক্ষা করেই সরকার নির্বাচন করতে যাচ্ছে। বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদল এবং অ্যান্টি আওয়ামী লীগ ভোট মিলিয়ে প্রায় ৭০ ভাগের বেশি মানুষ এ নির্বাচনের বাইরে থেকে যাবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। বাকি ৩০ ভাগের মধ্যেও যে আওয়ামী লীগ ও তার জোটভুক্ত দলগুলোকে ভোট দেবে, তার নিশ্চয়তা নেই। সঙ্গতকারণেই বরাবরের মতো আগামী নির্বাচনটিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তবে তার তোয়াক্কা আওয়ামী লীগ করছে না। এটা বোঝা যাচ্ছে, বিএনপি নির্বাচনে আসুক সে তা চায় না। দলটির প্রায় সব কার্যকর শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে জেলে রাখা এবং হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার ও ঘরছাড়া করে ছিন্নভিন্ন করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বিএনপিকে ছন্নছাড়া করে মাঠ ফাঁকা করার মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদল তার যাত্রাপথ মসৃণ করছে। তার লক্ষ্য, কোনো রকমে নির্বাচন করে ফেলতে পারলে আর কোনো সমস্যা নেই। তখন বিরূপ হয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলোকে ম্যানেজ করা যাবে। অনেকে ক্ষমতাসীনদলের এমন নির্বাচন করার আকাক্সক্ষাকে কম্বোডিয়ার স্বৈরশাসক হুন সেনের শাসনামলের সাথে তুলনা করেছেন। হুন সেন যেমন বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন, গ্রেফতার করে প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দিয়ে নির্বাচন করেছে, তেমনি বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদলও একই প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে। দেখে নেয়া যাক, হুন সেন কিভাবে তার শাসনামল পরিচালনা করেছে। ১৯৮৫ সাল থেকে হুন সেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। সেই থেকে দেশটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবলে পড়ে। বিরোধীদলকে দমন করে নিজের ইচ্ছামতো নির্বাচন করে বারবার ক্ষমতায় আসেন। পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিবারই তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ১২৩ টি আসনের মধ্যে ৯০ আসন পেয়ে বিজয়ী হয়। দুটি প্রধান বিরোধীদল কিছু সংখ্যক আসন পেয়েছিল। চার বছর পর ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে দুটি বিরোধীদল এক হয়ে ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টি গঠন করে। তার আগেই, এই দলটিকে যিনি নেতৃত্ব দিতে পারেন, হুন সেন তাকে কারাদ- দেন। এর ফলে তাকে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। হুন সেনের দলের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিরোধীরা খুব ভালো ফলাফল করে, তারপরেই শুরু হয় দলগুলোর ওপর নিপীড়ন। বিরোধীদলের নেতাদের গ্রেফতার করে সাজা দেয়া শুরু হয়। চার বছর পর ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে ছোট ছোট কিছু দল থাকলেও হুন সেনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কার্যকর কোনো বিরোধীদল থাকেনি। হুন সেন একতরফা নির্বাচন করে সব আসনে বিজয় লাভ করে পুনরায় ক্ষমতায় আসে এবং নির্বাচন কমিশন, আদালত, মিডিয়ার উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। কারো পক্ষে টুঁ শব্দ করার ক্ষমতা ছিল না। এতে তার ব্যাপক সমালোচনা হলেও হুন সেন তা পাত্তা দেননি। এরকম বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও বিরোধীদলগুলো দমে যায়নি। দমন-পীড়নের মধ্যেই নিজেদের সংগঠিত করে। কারণ, পরের বছরই অর্থাৎ ২০২৩ সালে নির্বাচন। তারা সংগঠিত হয় ক্যান্ডেললাইট পার্টি নামে। এই দলকে যিনি নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তাকে হুন সেন কারাদ- দেন। তারপরও বিরোধীদলগুলো সংগঠিত থাকে। তবে হুন সেন তার ক্ষমতা পাকাপাকি করতে এ বছরের জুলাই মাসে তার আজ্ঞাধীন নির্বাচন কমিশন মিথ্যা এবং অত্যন্ত দুর্বল অভিযোগের ভিত্তিতে ক্যান্ডেললাইট পার্টির নিবন্ধন বাতিল করে দেয়। বিরোধীরা তখন সাংবিধানিক আদালতে যায়। ওই আদালত সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে নির্বাচন কমিশন একেবারে ঠিক কাজটিই করেছে বলে রায় দেয়। তারপর জুলাই মাসে নির্বাচন হয় এবং হুন সেনের দল একচ্ছত্র বিজয় লাভ করে। হুন সেনের শাসনামলের সাথে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদলের আচরণের যে হুবহু মিল রয়েছে, তা পাঠকরা বুঝতে পারছেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, হুন সেন তার ক্ষমতার জন্য চ্যালেঞ্জ বা ক্ষমতা হারাতে পারে এমন দলকে নিষিদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে এমন দল বিএনপিকেও কিন্তু ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ করার দাবী আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগ করেছে। এজন্য সংগঠনটি বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী’ দল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং ক্রমাগত তা বলে যাচ্ছে। গত ১০ আগস্ট বিএনপির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এক সমাবেশ করেছিল যুবলীগ। ওইদিন সংগঠনটি বিএনপির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিল। একইদিন বিএনপির সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ করার দাবিতে যুবলীগের সাধারণ স¤পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনেও (ইসি) স্মারকলিপি দিয়েছিল। সর্বশেষ গত ৫ নভেম্বর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে এক অবস্থান কর্মসূচিতে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ বিএনপির রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি বলে মন্তব্য করেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ১০ অক্টোবরও যুবলীগের পক্ষ থেকে একই দাবি করা হয়েছিল। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদল তার প্রধান প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন বা প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দেয়ার জন্য হুন সেনের মতো প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে। আপতদৃষ্টিতে এ দাবি যুবলীগ করলেও তাতে যে ক্ষমতাসীন দলের সম্মতি রয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার সুদূরপ্রসারী প্রক্রিয়া নিয়েই ক্ষমতাসীনদল এগুচ্ছে। আগামী নির্বাচনটি কোনো রকমে করে ফেলতে পারলে পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়ে যদি বিএনপিকে নিষিদ্ধ করে দেয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
তিন.
কম্বোডিয়ার নির্বাচনী মডেলের মূলকথা হচ্ছে, বিরোধীদলকে দমন করতে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যেগুলো দৃশ্যত আইনি মনে হবে। যাকে বলা হয়, আইনের শাসন নয়, আইন দিয়ে শাসন করা। দেশের প্রয়োজনে আইন নয়, আইনের প্রয়োজনে আইন এবং তার যেমন খুশি তেমন ব্যবহার। কম্বোডিয়ার হুন সেনের এই নীতির সাথে কি বর্তমান ক্ষমতাসীনদলের নীতির মিল নেই? মিল রয়েছে। শুধু বিরোধীদলের অভিযোগ নয়, বিদেশী বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থাও তাদের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আইন ক্ষমতাসীনদলের ইচ্ছা, অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। বিরোধীদল দমাতে আইনের অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে। সংবাদ ও গণমাধ্যম দমাতেও নিপীড়নমূলক আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কি কম্বোডিয়া মডেলে নির্বাচন করা সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমি মনে করি, তা হবে না। এই মডেলে চেষ্টা করা হয়, যাতে কার্যকর কোনো বিরোধীদল না থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে ‘কিংস পার্টি’ তৈরি করে চাপ দিয়ে নির্বাচন করা যায় না। এমনকি নির্বাচনী বৈতরণী পার হলেও খুব বেশি দূর যাওয়া যাবে না। তাছাড়া, বাংলাদেশের পরিস্থিতি কম্বোডিয়ার মতো নয়। কম্বোডিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের যে যোগাযোগ, তা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তাদের চাপও কম। অন্যদিকে, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশ্বের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের বাণিজ্য ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ, নিরাপত্তা সহযোগিতা, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ইত্যাদি রয়েছে। তৈরি পোশাক ফেরত দেয়ার খবরে বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিসা পলিসি গ্রহণ করে, তখন এতো আলোচনা হলো কেন? কারণ, সেটা অপ্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগের জায়গায় ¯পর্শ করে ফেলেছে। নির্বাচনের এখন অনেকদিন বাকি। চাপ আসার আশঙ্কা বাদ দেয়া যায় না। নির্বাচন হয়ে গেলেও নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে যদি চাপ আসে, সেই চাপ বাংলাদেশের পক্ষে মোকাবেলা করা অত্যন্ত কঠিন হবে। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা খুবই ভঙ্গুর। আলী রীয়াজ বলেন, আমি এবং আমার সহযোগীরা মিলে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলাম যার নাম ‘লুন্ঠিত ভবিষ্যৎ’। সেখানে আমরা দেখিয়েছিলাম, এই সংকট কীভাবে তৈরি হয়েছে। কী ধরনের অর্থনৈতিক নীতির কারণে জ্বালানি খাত, ব্যাংকিং খাত, মেগা প্রজেক্ট, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন রকমের লুটপাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যার ফলে একটি শ্রেণী তৈরি হয়েছে। এভাবে অর্থনীতি অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে জোর করে একটি নির্বাচন করে ফেললে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এটা ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সাল নয়। এবারের চাপ পড়বে অর্থনীতির উপর। বলার অপেক্ষা রাখে না, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্মারকে (প্রেসিডেনশিয়াল মেমোরেন্ডাম) সই করেছেন। গত ১৬ নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি খাতকে স¤পৃক্ত করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেছেন, যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবেন, শ্রমিকদের হুমকি দেবেন, ভয় দেখাবেন, তাদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এ নীতি ঘোষণায় বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তারের কথা উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে। গার্মেন্ট খাতে শ্রমিকদের আন্দোলন দমানো এবং নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে, তাতে এ নীতি প্রয়োগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, কোনো কারণে শ্রম অধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র তার নতুন নীতিটি বাংলাদেশের ওপর কার্যকর করলে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এ দেশের রপ্তানি খাতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বরাবরই সোচ্চার অবস্থানে রয়েছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টিকারীদের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা এবং তা কার্যকর করা শুরু করেছে। দেশটি সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের জন্য চিঠিও দিয়েছে। সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এসব কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে নির্বাচন হলেও পরবর্তীতে যে দেশটি নানা অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, তার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যদি তাই হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তার ভার বহন করা সম্ভব হবে না।
চার.
এটা এখন পরিস্কার, ক্ষমতাসীনদলের কাছে ‘ক্ষমতা’ একমাত্র মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের দৈন্যদশা নিয়ে তেমন কোনো উদ্বেগ নেই। এ সময়ে মানুষ গোল্লায় গেলেও তাতে কিছু যায় আসে না। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর যা করার করবে। সমস্যা হচ্ছে, নির্বাচন পর্যন্ত এবং নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর যে সময়, এ সময়ের মধ্যে ইতিবাচক কিছু যে ঘটবে না, তা পর্যবেক্ষকরা ভালোভাবে বুঝলেও সরকার তা বুঝতে চাইছে না। কম্বোডিয়ার হুন সেনও বোঝেনি। ফলে জুলাইয়ে নির্বাচনের পরপর যুক্তরাষ্ট্র তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে সাথে সাথে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেন। আগেই বলা হয়েছে, কম্বোডিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় খুবই কম। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপে হুন সেনকে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের বহুবিধ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, যেগুলো বাধাগ্রস্ত হলে দেশের অর্থনীতি হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব শুধুমাত্র একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছে এবং উদ্বেগ প্রকাশ করছে, তা না করে সরকার যদি শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার জন্য কম্বোডিয়া মডেলে একতরফা নির্বাচন করে, এর খেসারত তাকে কতটা দিতে হবে, তা বলা না গেলেও, এটা নিশ্চিত দেশকে অনেক বড় খেসারত দিতে হবে। ( সংকলিত)