(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
ইন্টারনেটের সৌজন্যে খবরপত্রের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।- বি.স
(পূর্ব প্রকাশের পর)
এরই মধ্যে হঠাৎ যেন জীবনের সামান্য সন্ধান পেলাম। একটা বাচ্চা ছেলে দার্শনিকের মতো নিস্পৃহভাবে নিজের দেহের বস্ত্রের ভার সংক্ষেপ করবার চেষ্টা করছে। জামাটা খুলে ফেলেছে। প্যান্টটা খোলবার চেষ্টা করেও সে পেরে উঠছে না। চিনে বাচ্চা। সে হঠাৎ টলতে টলতে এসে আমার হাতটা চেপে ধরল। একটু হাসল। তার কথা বুঝি না। কিন্তু ইঙ্গিতেই সমস্ত ব্যাপারটা বোঝা গেল। বেচারা প্যান্টটা ভিজিয়েছে। কার্পেটের খানিকটাও সপসপে করে ফেলেছে।
পরবাসীয়া হাঁ হাঁ করে উঠল। বললে, কার্পেটটা এই সব পাজি ছেলেদের জন্যে থাকবে না। একবার এক জার্মান খোকা নাকি কার্পেটের উপরই প্রকৃতির বৃহত্তর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফেলেছিল। এই পরবাসীয়াকেই আবার নাক টিপে সুইপারকে ডাকতে হয়। সেই থেকেই পরবাসীয়া বাচ্চা ছেলেদের ভয় পায়।
বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিতে যাচ্ছিলাম। পরবাসীয়া আমাকে এমনভাবে টেনে ধরল যেন আমি একটা তাজা বোমাকে মাথায় তুলে নিতে যাচ্ছিলাম। বললে, বাবু, এই চিনা বাচ্চাদের রকমসকম আমি বুঝি না। ওর আরও দুষ্টুবুদ্ধি আছে। এখনই হয়তো আবার জমাদারকে ডাকতে হবে।
বাচ্চাটা তখন টলতে টলতে নিজের ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পেরে সে হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। পরবাসীয়াকে নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে এক চিনা ভদ্রলোক আর মহিলাকে পাওয়া গেল।
তারা ইংরেজি জানেন না। বাচ্চাটাকে না পেয়ে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। শ্রীমান যে কখন দরজা খুলে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের এই কোণে হাজির হয়েছেন বুঝতে পারেননি। তারা চিনে ভাষায় আরও কীসব ধন্যবাদ জানাতে লাগলেন। পরবাসীয়া আন্দাজে সেসব বুঝে নিয়ে, নিজস্ব উৎকল ভাষায় মাকে প্রচুর বকুনি দিতে লাগল। এবং এই কলকাতা শহরটা যে সুবিধের নয়, এখানে ছেলেধরার যে অভাব নেই তা বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগল।
ঘর থেকে বেরিয়ে পরবাসীয়া বললে, আমার লেনিনবাবুকে সন্দেহ হয়। কলকাতার এই শাজাহান হোটেলে কমরেড লেনিন আবার কোথা থেকে হাজির হলেন? কিন্তু পরবাসীয়ার পরের কথায় বুঝলাম, লেনিনবাবু আর কেউ নন, লিনেন ক্লার্ক নিত্যহরিবাবু।
নিত্যহরিবাবুর নাকি ছেলেদের উপর খুব লোভ। সুযোগ পেলেই বাচ্চাদের ঘর থেকে নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে বসিয়ে রাখেন। তাদের সঙ্গে আড্ডা দেন। এমন আচ্ছা, যাতে কোনো ভাষা দরকার হয় না। নিজের চাদর, বালিশ, বিছানা, ন্যাপকিনের হিসেব করতে করতে নিত্যহরিবাবু মুখভঙ্গি করেন, ছেলেদের কাতুকুতু দেন; উপর থেকে বিছানার উপর লাফিয়ে পড়েন, আর ছেলেরা হই হই করে ওঠে। এর জন্যে দু-একবার নিত্যহরিবাবু বকুনিও খেয়েছেন।
আমাকে দেখেই নিত্যহরিবাবু রেগে উঠলেন, দাঁড়ান মশায়। আমার এদিকে বাইশখানা তোয়ালে কম পড়ছে, আর আপনি এখন এলেন কথা বলতে।
চোখে একটা চশমা লাগিয়ে ভদ্রলোক কাপড়ের পাহাড়ের মধ্যে বসে রয়েছেন। একদিকে কাচা কাপড়। আর মেঝেতে ময়লা কাপড়।বুঝুন মশায়, আমার অবস্থাটা বুঝুন। বাইশটা তোয়ালে গাঁটের পয়সায় কিনতে গেলে, আমাকে তো ডকে পাঠাতে হবে।
পরবাসীয়া বললে, আপনার নামে কমপ্লেন আছে।
কমপ্লেন? আমার নামে? এত বড় আস্পর্ধা? কে? তিরিশ বছর আমি এই হোটেলে কাটিয়ে দিলাম। লাটসায়েবের বালিশ, বিছানার চাদরের হিসেব আমি করেছি, তারা কিছু বলেননি; আর কিনা আমার নামে কমপ্লেন?
বললাম, এক নম্বর সুইটে গতকাল রাত্রে বালিশ কম ছিল।
কিছুতেই নয়, ন্যাটাহারিবাবু চিৎকার করে উঠলেন।
আমি চলে আসতে যাচ্ছিলাম। নিত্যহরিবাবু হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, হাতে খাতাটা নিয়ে বললেন, এক নম্বর সুইট। বালিশ কম। হতে পারে না। নিত্যহরি ভটচাযের এমন ভীমরতি ধরেনি যে স্পেশাল সুইটে বালিশ কম দেবে। চলুন তো দেখি।
হাফ শার্ট, ধুতি আর কে এম দাশের ছেঁড়া চটি পরে নিত্যহরিবাবু আমাকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে চললেন এক নম্বর সুইটের দিকে।
যেতে যেতে বলতে লাগলেন, আপনার তো সাহস কম নয়। আপনি নিত্যহরির ভুল ধরতে এসেছেন! এই হোটেলের প্রত্যেকটা ঘরে কটা করে বালিশ আছে, কটা তোষক আছে, কটা তোয়ালে আছে, তা এ-শর্মার মুখস্থ। ম্যানেজার সায়েবের ঘরে আছে ছখানা বালিশ। তার মধ্যে দুটো পালকের বালিশ, খোদ সিম্পসন সায়েব যা মাথায় দিতেন। দুনম্বর সুইটে আছে আটটা। এক নম্বরে চারটে। আর আপনি বলছেন বালিশ নেই?
এক নম্বর সুইটের চাবি খুলে ভিতরে ঢুকে দেখা গেল একটা মাত্র বালিশ পড়ে রয়েছে। দেখে নিত্যহরিবাবু প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেন। পরমুহূর্তেই চিৎকার করে বলে উঠলেন, অসম্ভব! নিশ্চয়ই নেশার ঘোরে মেঝেতে খেলাধুলো করেছে, তারপর ভুলে গিয়েছে।
আমি বললাম, গতকাল ড্রাই-ডে ছিল।
নিত্যহরিবাবু কিন্তু আমল দিলেন না। হ্যাঁ। ড্রাই-ডেতে কলকাতা একেবারে বাউনের ঘরের বিধবা হয়ে যায়!
নিত্যহরিবাবু হঠাৎ মেঝেতে বসে পড়ে খাটের তলায় উঁকি মারলেন। তারপর আবিষ্কারের আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন। হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকে পড়ে তিনটে বালিশ বার করে বললেন, দেখুন স্যার। একটু হলেই আমার চাকরি যাচ্ছিল। কেউ বিশ্বাস করত না যে, আমি বালিশ দিয়েছি এবং সেই বালিশ ওঁরা মেঝেতে নিয়ে খেলাধুলা করছিলেন। লাটসায়েবের বালিশ সাপ্লাই করেও, এই আটটি ইয়ার সার্ভিসের পর নিত্যহরি ভটচায্যির চাকরি যাচ্ছিল।
আমি দেখলাম, সত্যিই ঘরের মধ্যে খাটের তলায় বালিশ ছিল। আমার মুখের অবস্থা দেখে নিত্যহরিবাবুর বোধহয় একটু দয়া হল। বললেন,
আপনার বয়স কম। হোটেলের কিছুই দেখেননি আপনি। নেশা কি শুধু মদে হয়! একদম বাজে কথা! বেশি বয়সের মেয়েমানুষের মাথায় যখন ভূত চাপে তখন চোখে নেশা লেগেই থাকে। তা বাপু, পয়সা দিয়ে হোটেলের ঘর ভাড়া করেছ। বালিশ নিয়ে খেলা করো। নিত্যহরিবাবু ঢোক গিললেন। কিন্তু বালিশও নিচেয় ফেলে দেব, আবার ন্যাটাহারিকে বাম্বু দেব, সে কি কথা!
গতিক সুবিধে নয় বুঝে পরবাসীয়া কখন আমাকে একলা ফেলে রেখে কেটে পড়েছে। এবার আমিও অ্যাবাউট টার্ন করে পালাবার চেষ্টা করব ভাবছিলাম।
নিত্যহরিবাবু তখন বলছেন, আপনি হয়তো ভাবছেন ধেড়ে। মোটেই নয়। রং লাগলে ধেড়েরাও খোকাখুকু হয়ে যায়। ন্যাটাহরির এই স্টেটমেন্ট সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত চলবে, জেনে রাখবেন। ন্যাটাহারি পরের মুখে ঝাল খায় না, সে নিজের হাতে তিরিশ বছর ধরে বালিশ সাপ্লাই করছে।
এবার পালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু নিত্যহরিবাবু হাতটা চেপে ধরে বললেন, যাচ্ছেন কোথায়?
আমি বললাম, নিচেয়।
অত সহজে নয়। অত সহজে আমার হাত থেকে কেউ ছাড়া পায় না। মনে হল সেই ভোরবেলাতেও নিত্যহরিবাবুর চোখ-দুটো ধক ধক করে জ্বলছে।
কেন, কী করতে হবে? নিত্যহরিবাবুকে আমি প্রশ্ন করলাম।
তার দুটো চোখের তেজ এবার কমে এল। মনে হল, নিত্যহরিবাবু নিজেকে শান্ত করবার চেষ্টা করছেন। আস্তে আস্তে তিনি বললেন, আমার হাতে একটু জল দিন।
বললাম, জল কী করবেন?
পাপ! পাপ ধুয়ে ফেলতে হবে না?
বাথরুমে বেসিন রয়েছে। কল রয়েছে। কিন্তু নিত্যহরিবাবু এক নম্বর সুইটের কলে হাত দেবেন না। যেন এ-ঘরের সর্বত্র পাপ ছড়ানো রয়েছে। বাথরুমে গিয়ে একটা মগ আবিষ্কার করলাম এবং সেই মগে জল বোঝাই করে নিত্যহরিবাবুর হাতে ঢালতে লাগলাম। বেসিনের উপরেই একটা পাত্রে লিকুয়িড সোপ ছিল। কিন্তু নিত্যহরিবাবু সেদিকে হাত বাড়ালেন। না। পকেট থেকে একটা সাবানের টুকরো বার করলেন। কোথায় কখন বালিশ ঘেঁটে হাত ধুতে হবে ঠিক নেই; তাই পকেটে কয়েক টুকরো সাবান নিত্যহরিবাবু সব সময়েই রেখে দেন। কার্বলিক সাবানে হাতটা ভালো করে ধুতে ধুতে নিত্যহরিবাবু বললেন, গত জন্মে নিশ্চয় হাজার হাজার ধোপার লাখ লাখ কাপড় আমি চুরি করেছিলাম।
নিত্যহরিবাবু আমার হাতটা চেপে ধরে বললেন, এই হোটেলের স্ট্যাটিসটিকস জানেন? বলুন তো কটা বালিশ আছে?
আমি বললাম, আমি কী করে জানব?
উনি ফিস্ফিস্ করে বললেন, সাড়ে নশ। আগে হাজারটা ছিল। পঞ্চাশটা ছিড়ে গিয়েছে। তার তুললাগুলো আমার ঘরের এক কোণে জমা হয়ে আছে। পাপ! আমার কানের কাছে এগিয়ে এসে নিত্যহরিবাবু মুখটা ভেংচে বললেন, হাজারটা পাপ!
নিত্যহরিবাবু যেন আমার মনের মধ্যে ক্রমশ গেঁথে বসছেন। নিজের অজ্ঞাতেই প্রশ্ন করে বসলাম, কেন? পিপ কেন?
আপনার বাবা কি আপনাকে লেখাপড়া শেখাননি? তিনি কি মাস্টারের মাইনে বাকি রাখতেন? নিত্যহরিবাবু আমাকে ধমক দিয়ে প্রশ্ন করলেন।
বললাম, মাইনে তিনি সময়মতো দিয়েছেন। তাঁর সাধ্যমতো কাউকে তিনি ফাঁকি দেননি।
তবে? আপনার মাস্টার তাহলে কী শিখিয়েছে আপনাকে? জানেন না, হোটেলে, সরাইখানায়, শুড়িখানায় প্রতিমুহূর্তে হাজার হাজার লাখ লাখ পাপ সৃষ্টি হচ্ছে?
এখানে হাজার হাজার লোক আসেন নিজের কাজে। তারা কী পাপ করছেন? আমি ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করলাম।
আলবত করছে। পাপ না করলে কাউকে কি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়? না, ঘরের বাইরে রাত কাটাতে হয়? নিত্যহরিবাবুর চোখ দুটো আবার জ্বলতে আরম্ভ করেছে। বললেন, কদ্দিন চাকরি করছেন?
এই দিনকতক হল। আমি উত্তর দিলাম।
বয়ে গিয়েছেন? ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
মানে?
রোজির সঙ্গে আলাপ হয়েছে? নিত্যহরিবাবু নিজের প্রশ্নটি সরল ভাষায় উত্থাপন করলেন।
চিনি, কিন্তু তেমন কোনো পরিচয় নেই।
ও ছুঁড়িও আমার কাছে একবার একস্ট্রা বালিশ চেয়েছিল। আমি স্রেফ না বলে দিয়েছিলাম। তারপর ভাবলাম, আমি না বলার কে? যে বালিশ চাইবে, তাকে বালিশ দাও। যত খুশি চাইবে, ততো দাও। আমার কী? আমি নিজে হাতে করে ওর ঘরে বালিশ দিয়ে এসেছিলাম। তা ছুঁড়ি পরের দিন ভোরবেলাতে বালিশ দুটো ফেরত দিয়েছিল।
দুটো লোককে আপনাদের বুঝলাম না। আপনাদের সত্যসুন্দর বোস। একবার ভুল করেও একস্ট্রা বালিশ চাইল না। আর মার্কো সায়েব। রসিক লোক মাল টেনে টইটম্বুর হয়ে থাকেন। কিন্তু ওই পর্যন্তÍকোনোদিন বাড়তি বালিশ নিলে না। মেয়েমানুষ যেন বাঘ।
আমি অবাক হয়ে নিত্যহরিবাবুর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। বালিশ বেশি চাইতে হলে আগে চাই ড্রিঙ্কস্-আমাদের মুনি-ঋষিরা যাকে বলেন মাল। শাজাহানের শুড়িখানায় যাতায়াত করেন তো?
বললাম, ওখানে এখনও আমার ডিউটি পড়েনি।
উনি বললেন, মেয়েদের বলি, মা লক্ষ্মী, কর্তাদের সব স্বাধীনতা দেবে। কিন্তু বাড়ি ছাড়তে দেবে না। খুঁটি থেকে ছাড়া পেলেই বিপদ। কার বেড়া ভাঙবে, কার ক্ষেতে ঢুকবে কিছুই ঠিক নেই।
নিত্যহরিবাবুর মধ্যে আমি এক অদ্ভুত মানুষকে দেখতে পাচ্ছি। আস্তে আস্তে তিনি বললেন, সাপ! আমি এতদিনে বুঝেছি, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা কেউটে সাপ ঘুমিয়ে আছে। কারুর মধ্যে সেই চিরকালই ঘুমিয়ে থাকে। আর কারুর কারুর বাড়ি ছাড়লেই ভিতরের সেই সাপটা ফোস করে ওঠে। লক লক করে ওঠে জিভটা।
আমার কেমন ভয় ভয় করছিল। ওই ঘরে আর থাকতে ইচ্ছে করছিল। নিত্যহরিবাবুরও বোধহয় ভালো লাগছিল না। তাই এক নম্বর সুইটের বিছানা থেকে উঠে পড়ে বললেন, চলুন, আমার ঘরে যাওয়া যাক।
বালিশ, বিছানা, চাদর-এর পাহাড়ের এক কোণে নিত্যহরিবাবু শুয়ে থাকেন। বললেন, এইখানেই আমি থাকি; আর ছোটো শাজাহানে খাই।
ছোট শাজাহান! সে আবার কোথায়? আমি প্রশ্ন করলাম।
বড় শাজাহানের পিছনে। বলুন তো, শাজাহানের একটা ডিনারের সবচেয়ে বেশি চার্জ কত? নিত্যহরিবাবু প্রশ্ন করলেন।
আমি বললাম, এ তো সবাই জানে। পঁয়ত্রিশ টাকা।
আর ছোট শাজাহানে চোদ্দ পয়সা। চোদ্দ পয়সায় ফুলকোর্স ডিনার। ভাত, ডাল, তরকারি। মধ্যিখানে দাম বাড়িয়ে চার আনা করবে বলেছিল। শাজাহানের স্টাফরা একসঙ্গে প্রতিবাদ করি। চার আনা আমরা কোথা থেকে দেব? তখন বাধ্য হয়ে চোদ্দ পয়সায় রেখেছে, শুধু ডালটা একটু পাতলা হয়েছে; আর থালাটা যে-যার ধুয়ে দিতে হয়। নিত্যহরিবাবু বললেন, আপনার কথাই আলাদা। গাছে না উঠতেই এক কাদি। চাকরিতে না-ঢুকতেই বড় শাজাহানের ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ আর ডিনার।
আমি চুপ করে রইলাম। কী উত্তর দেব? ন্যাটাহারিবাবু নিজেই বললেন, আপনাদের অবশ্য জুনো সায়েব অনেক কম দেয়। গেস্টরা লাঞ্চের সময় যা খান, তার বাড়তিগুলো দিয়ে আপনাদের ডিনার। আর ডিনারের বাড়তি দিয়ে আপনাদের পরের দিনের লাঞ্চ। আজ লাঞ্চে সায়েব আপনাদের কী খাওয়াবে জানেন?
নিত্যহরিবাবুর খবর সংগ্রহের ক্ষমতা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
ম্যাড্রাস কারি। খেতে চমৎকার, কিন্তু খবরদার খাবেন না। আপনার পেট কেমন? লোহা খেলে হজম হয়ে যায়?
মোটেই না, পেটটা একেবারেই আমার ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট নয়।
তা হলে ম্যাড্রাস কারিটা একদম বাদ দিয়ে খাবেন। ওটা লন্ডনের বীরস্বামী সায়েবের আবিষ্কার। বীরস্বামী, গোল্ড মেডালিস্ট, অনারারি কুকিং অ্যাডভাইসার টু দি সেক্রেটারি অফ্ স্টেট ফর ইন্ডিয়া। ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ এম্পায়ার এগজিবিশনে গিয়েছিলেন, তারপর লন্ডনে রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন। তার কাছেই তো জুনো ইন্ডিয়ান রান্না শিখেছিল বলে। কিন্তু আসলে বীর স্বামী ওকে ঘাড় ধরে বার করে দিয়েছিলেন। আমাদের দেবেন কুক না থাকলে, জুনোর জারিজুরি এতদিনে বেরিয়ে পড়ত। যা বলছিলাম প্রথম দিন মাংস কিনে এনে হয় কোল্ড মিট। দ্বিতীয় দিনেও তাই। তৃতীয় দিনে বিরিয়ানি। আজকে সেই মাংসই ম্যাড্রাস কারি ফর দি স্টাফ।
নিত্যহরিবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসছিলাম। উনি বললেন, একটু থামুন। আপনি ছেলেমানুষ। আপনাদের মনে যাতে দাগ না পড়ে, আর একটু দাগ পড়লেই যাতে ধরা পড়ে, তার ব্যবস্থা করছি। রোজি তো আপনার ঘর অকুপাই করে নিয়েছে। আপনার মালপত্তর সব পাশের ঘরে চালান হয়ে গিয়েছে। ওখানে আমি সবকিছু সাদার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
এক বান্ডিল কাপড়-চোপড় নিয়ে উনি জোর করে ছাদে আমার সঙ্গে চলে এলেন। রোজি নিজের ঘরে বসে তখন দাঁত বার করে হাসছে। আমাকে দেখেই বললে, আমার কাজকর্ম সব শেষ। এখন ছাদে বসে বসে শরীরটাকে সূর্যের আগুনে মচমচে টোস্ট করব। তারপর লাঞ্চ খাব। তারপর জানো কী করব? ম্যাটিনি শোতে সিনেমায় যাব। জিমিরও যাবার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকোয়েটে কাজ পড়ে গিয়েছে! ওর টিকিটটা রয়েছে। তুমি যাবে?
আমি অবাক হয়ে গেলাম, রোজি আমাকে সিনেমায় নেমন্তন্ন করছে। বললাম, অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমারও ডিউটি রয়েছে।
রোজি বললে, অল রাইট, তাহলে আমার বোনকে নিয়ে যাই। তবে বিনা নোটিশে ওকে সিনেমায় নিয়ে গেলে ওর বয়ফ্রেন্ডরা দুঃখিত হয়, ডাকতে এসে তারা ফিরে যাবে।
(সংকলিত)
——চলবে