১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সর্বপ্রথম ভাষাসংক্রান্ত একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন। তার এই দাবির সমর্থনে দৈনিক আজাদ পত্রিকা একাডেমি প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা সম্পর্কে জনমত সৃষ্টির ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান গণপরিষদে পাসকৃত বিলের মাধ্যমে জন্ম বাংলা একাডেমির। মধ্যযুগীয় কবি দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনু গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু একাডেমির প্রকাশনা বিভাগের। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে শিক্ষামন্ত্রী আজিজুল হক সাহেব বর্ধমান হাউজকে ভাষা গবেষণাগার হিসেবে রূপান্তরের প্রস্তাব অনুমোদন করান। ১৯৫৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির। বাংলা সাহিত্যের চর্চা, গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাংলা একাডেমি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউজে বাংলা একাডেমি সগৌরবে আজো স্বমহিমায় দেদীপ্যমান। দেশজ সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সমকালীন শিল্প ও সাহিত্য সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রচারের মাধ্যমে জাতীয় মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন; এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু এই প্রতিষ্ঠানের। প্রতিষ্ঠার পর ৬২ বছর সময় পেরিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে একাডেমির যেমন অনেক সফলতা রয়েছে, তেমনি ব্যর্থতার তালিকাও বিরাট। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলা সাহিত্যকে, সাহিত্যিককে বিদেশী ভাষায় ভাষান্তর, পরিচিতির ক্ষেত্রে মন্থর গতির প্রশ্ন তুলতে পারেন যে কেউই।
মূলত ভাষার উৎকর্ষের সাথে সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য একাডেমির প্রতিষ্ঠা হলেও এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে খুবই কম। বরেণ্য সাহিত্যিকদের রচনাসমগ্র প্রকাশের প্রশংসনীয় উদ্যোগ আয়োজন কেন জানি না মাঝপথে থেমে গেছে। বিশেষ করে জাতীয় কবির রচনা, তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে জাতির মানসের পরিচিতির আয়োজনের দৈন্যতা দৃষ্টিকটু ঠেকে বৈকি! একইসাথে বাংলা একাডেমির স্বপ্নদ্রষ্টা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রসঙ্গও কেন জানি না অবহেলিত। বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে বাঁধা একাডেমির সদস্য পদ। এভাবেই বিধি নিষেধের বেড়াজালে আটকে আছে একাডেমির স্বকীয়তা ও চলার পথ। ভাষার উৎকর্ষ, বানান শুদ্ধিকরণ, সাহিত্যিক তৈরির প্রশিক্ষণ কোথায় যেন মুখ লুকিয়েছে। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বানান শুদ্ধিকরণের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা-ও এগোয়নি সমান গতিতে। নতুন সাহিত্যিক তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ এবং একাডেমির উদ্যোগে তাদের প্রথম বই মুদ্রণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ নিঃসন্দেহে এটি একটি মহতী উদ্যোগ ছিল।
ব্যাকরণ, কাব্য, সাহিত্য, লোকসাহিত্য এবং বাংলা গানের ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার নিয়ে কোন উদ্যোগের অভাব নিয়ে কেউ ভাবেন কি না জানি না। পাঠক তৈরির জন্য নিয়মিত আয়োজনের কথা আর শোনা যায় না। বাংলা একাডেমি ভাষা কেন্দ্রিক উন্নয়ন আয়োজনের পরিবর্তে এখন অধিকাংশেই বইমেলা কেন্দ্রিক কার্যক্রমে জড়িয়ে গেছে। একাডেমির ওয়েবসাইটে, অন্যান্য আয়োজনে এবং বিভিন্ন ধরনের ডিসপ্লেতে বই মেলাই এখন মুখ্য। অথচ বইমেলার মূল আয়োজক প্রকাশক সমিতি। বাংলা একাডেমির ভূমিকা এখানে সহায়ক প্রতিষ্ঠানের। এ কথা যেন সবাই বেমালুম ভুলেই গেছেন। ঘোষণাপত্র অনুসারে বাংলা একাডেমি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রতিটি সরকারই এর নিয়ন্ত্রক ভূমিকা পালন করায় ঘোষণার আঙ্গিকে ভাষার উন্নয়ন, উৎকর্ষ, চর্চা, বিকাশের ধারা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপূর্ণতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে বারবার। একইসাথে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী ভাষা চর্চা, উন্নয়ন, পাঠক ও লেখক তৈরি, ভাষান্তর প্রক্রিয়ার পুরোটাই শিক্ষার সম্পর্কিত হলেও এটাকে ন্যস্ত করা হয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। এ ব্যাপারে ভাববার যথেষ্ট অবকাশ আছে একাডেমির কাজের সমন্বয় সাধনের জন্য। একাডেমি তার নিজস্ব কর্মধারায় ফিরে আসুক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পথে। জাতির মনন ও মানসিকতার বুদ্ধিদীপ্ত উৎকর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হোক আপন স্বাতন্ত্র্যে- এই প্রত্যাশা সবার। লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ Email- shah.b.islam@gmail.com