শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৬ অপরাহ্ন

রবীন্দ্রনাথের বিয়ের গল্প

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৩

জোড়াসাঁকোর জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীকে রবীন্দ্রনাথের জন্য পছন্দ করে জ্ঞানদানন্দিনী শ্বশুর মশায়কে বিস্তারিত জানালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যথারীতি কুল-গোত্র ইত্যাদি দেখে বিয়ে ঠিক করেন। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন, তাঁর মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী। ২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ রোববার ইংরেজি ৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩ বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। এই দিন অবশ্য ঠাকুরবাড়িতে একটি দুর্ঘটনাও ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথের বড় বোন সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় শিলাইদহে মারা যান। বিয়ের দিন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ২২ বছর ৭ মাস ২ দিন। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে অনুযায়ী কন্যাহ্বানে বিয়ের অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাত্রপক্ষ বিয়ের জন্য পাত্রীর পিত্রালয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলে কন্যাহ্বানের নিয়মানুযায়ী পাত্রীকে পাত্রের বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করা হয়। পাত্রীপক্ষ সদলবলে কলকাতায় চলে আসেন। বেণীমাধব রায়চৌধুরী আত্মীয় স্বজনসহ কলকাতায় একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। ‘রবি জীবনী’র লেখকের মতে, বেণীমাধব রায়চৌধুরীর পাথেয় রাহা খরচ বাবদ ষাট টাকা, তাদের থাকবার বাড়ি ভাড়া বাবদ বাইশ টাকা তিন পাই খরচ বহন করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার ক্যাশ বইতে সে হিসাব রয়েছে। সেই ক্যাশ বই অনুসারে প্রতীয়মান হয় রবীন্দ্রনাথের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র ছাপা হয়েছিল এবং ডাকযোগে সে নিমন্ত্রণপত্র বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই দীনেশচন্দ্র সেন, নগেন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিজের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন নিজের হাতে লেখা একটি বিচিত্র রকমের পত্রে। কবির নিজের হাতে লেখা নিজের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রটি হুবহু এরকম:
আগামী রবিবার ২৪ শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন।
ইতি
অনুগত
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই চিঠির উপরের দিকে সচিত্র এম্বোস করা ছিল, ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়’। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মের প্রাণপুরুষ হলেও তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল খুলনা অঞ্চলের হিন্দু বিবাহ রীতি অনুসারে। দুটি কারণে এমনটি হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়ে থাকে। ঠাকুর পরিবারের আদি নিবাস খুলনা অঞ্চলে এবং পরবর্তীকালে ঠাকুর পরিবারের অধিকাংশ বধূরা খুলনা-যশোর অঞ্চলের মেয়ে ছিলেন। বিয়ের আগে গায়ে হলুদ ও আইবুড়ো ভাতের স্ত্রী-আচার যথানিয়মে পালিত হয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঘরোয়া’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘গায়ে হলুদ হয়ে গেল। আইবুড়ো ভাত হবে। তখনকার দিনেও বাড়ির কোনো ছেলের গায়ে হলুদ হয়ে গেলেই এ বাড়িতে তাকে নিমন্ত্রণ করে প্রথম আইবুড়ো ভাত খাওয়ানো হতো। তারপর এ বাড়ি ও বাড়ি চলত কয়েকদিন ধরে আইবুড়ো ভাতের নেমন্তন্ন। মা গায়ে হলুদের পরে রবিকাকাকে আইবুড়ো ভাতের নিমন্ত্রণ করলেন। মা খুব খুশি, একে যশোরের মেয়ে, তায় রবির মা তার সম্পর্কের বোন। খুব ধুমধামে খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। রবিকাকা খেতে বসেছেন উপরে, আমার বড় পিসিমা কাদম্বিনী দেবীর ঘরে, সামনে আইবুড়ো ভাত সাজানো হয়েছে- বিরাট আয়োজন। পিসিমারা রবিকাকাকে ঘিরে বসেছেন, এ আমাদের নিজের চোখে দেখা। রবিকাকা চৌড়দার শাল গায়ে, লাল কী সবুজ রঙের মনে নেই, তবে খুব জমকালো রঙচঙের। বুঝে দেখো, একে রবিকাকা তায়, ওই সাজ, দেখাচ্ছে যেন দিল্লির বাদশা! তখনই তার কবি বলে খ্যাতি, পিসিমারা জিজ্ঞেস করছেন, কী রে বউকে দেখেছিস, পছন্দ হয়েছে? কেমন হবে বউ ইত্যাদি সব। রবিকাকা ঘাড় হেঁট করে বসে একটু করে খাবার মুখে দিচ্ছেন। আর লজ্জায় মুখে কথাটি নেই।’
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের অনুষ্ঠানের একটি বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে হেমলতা দেবীর ভাষ্যে। তিনি লিখেছেন, ‘ঘরের ছেলে, নিতান্ত সাধারণ ঘরোয়াভাবে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়েছিল। ধুমধামের সম্পর্ক ছিল না তার মধ্যে। পারিবারিক বেনারসি-শাল ছিল একখানি, যার যখন বিয়ে হতো সেইখানি ছিল বরসজ্জার উপকরণ। নিজেরই বাড়িতে পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করতে এলেন অন্দর মহলে। স্ত্রী আচারের সরঞ্জাম সেখানে সাজানো। বরসজ্জার শালখানি গায়ে জড়ানো। রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন পিঁড়ির ওপর। নতুন কাকিমার (কাদম্বরী দেবী) আত্মীয়া যাকে সবাই ডাকতেন ‘বড়ো গাঙ্গুলীর স্ত্রী’ বলে, রবীন্দ্রনাথকে বরণ করলেন তিনি। তার পরনে ছিল একখানি কালো রঙের বেনারসি জরির ডুরে।
কনে এনে সাতপাক ঘোরানো হলো। শেষে বর-কনে দালানে চললেন সম্প্রদান স্থলে। সম্প্রদানের পর বর-কনে এসে বাসরে বসলেন। রবীন্দ্রনাথের বৌ এলে তাঁর থাকবার জন্য একটা ঘর নির্দিষ্ট করা ছিল আগে থেকেই। বাসর বসল সেই ঘরেই। বাসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ দুষ্টুমি আরম্ভ করলেন। ভাঁড়, কুলো খেলা আরম্ভ হলো। রবীন্দ্রনাথ ভাঁড় খেলার বদলে ভাঁড়গুলো উপুড় করে দিতে লাগলেন ধরে ধরে। তাঁর ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী বললেন, ‘ও কি করিস রবি, ভাঁড়গুলো সব উল্টেপাল্টে দিচ্ছিস কেন?’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘জান না কাকিমা – সব যে উলট-পালট হয়ে যাচ্ছে’ – কাকিমা আবার বললেন, ‘তুই একটা গান কর, তোর বাসরে আর কে গান করবে, তুই এমন গাইয়ে থাকতে?’ রবীন্দ্রনাথ বাসরে গান জুড়ে দিলেন :
‘আ মরি লাবণ্যময়ী কে ও স্থির সৌদামিনী’
পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে মার্জিত বদনখানি! দুষ্টুমি করে গাইতে লাগলেন কাকিমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বেচারি কাকিমা রবীন্দ্রনাথের কা- দেখে জড়োসড়ো। ওড়নায় মুখ ঢেকে মাথা হেঁট করে বসে আছেন।
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের নয় দিন পর তাঁর বিয়ের খবর ‘সাধারণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এভাবে, ‘গত রবিবারে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ অতি সমারোহের সহিত সুসম্পন্ন হইয়াছে। পাত্রীটিকে নাকি যশোহর হইতে আনা হইয়াছে। (উৎস: বঙ্গদর্শন, অন লাইন,কলকাতা,ভারত)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com