শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০২:২৪ অপরাহ্ন

সময় ব্যবস্থাপনা ও ইসলাম

জাফর আহমাদ 
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৩

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এ ভূপৃষ্ঠের প্রতিটি জিনিসই ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমার মহীয়ান ও দয়াবান রবের সত্তাই অবশিষ্ট থাকবে’ (সূরা আর-রাহমান : ২৬-২৭)। আপাতদৃষ্টিতে পৃথিবীর বয়স অফুরান মনে হলেও অবশ্যই তারও জীবনের পরিসমাপ্তি অতি সন্নিকটে। খুব দ্রুতই তার অবসান ঘটবে। কিন্তু তার বুকে বিচরণ ও বসবাসকারী সব সদস্যই খুবই সীমিত সময় নিয়ে অবস্থান করতে দেখা যায়। বিশেষত তার অধিবাসীদের মধ্যে প্রধান ও মূল অধিবাসী মানুষের সময় ও স্থায়িত্ব আরো অতি নগণ্য। মানুষের সাহায্যের জন্য সৃষ্ট অন্যরা কাল থেকে কালান্তরে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও মানুষের পক্ষে তা অসম্ভব। মানুষের বয়স বা সময় এতটাই সীমিত যে, তা ঘণ্টা, মিনিটে গণনা করার জন্য খুব বেশি ডিজিটের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই সীমিত সময়ে তাদেরকে অনেক অনেক কাজের আঞ্জাম দিতে হয়। পেশাদারিত্বের বাইরে সামাজিক জীব হিসেবে তার যোগাযোগের আওতা ও ক্ষেত্র বিশাল। বেঁচে থাকার জন্য রুটি-রুজি যেমন প্রয়োজন তেমনি সামাজিক যোগাযোগও একান্ত প্রয়োজন। মানুষের সীমিত সময়টুকুকে ভাগ করা হলে ব্যক্তির তারতম্যভেদে প্রতিটি মিনিটে প্রায় কয়েক ঘণ্টার কাজ ভাগে পড়বে। তাই সময় ব্যবস্থাপনা (Time Management) নামক ইনস্ট্রুমেন্টের উদ্ভব ঘটেছে। বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার প্রভূত উন্নতির এ যুগে এসেও এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব এতটুকু হ্র্রাস পায়নি। প্রযুক্তি মানুষের এক মাসের দুই মাসের এভাবে ছয় মাসের কাজকে এক ঘণ্টায় সমাধান করে দেয়ার পরও সময় ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব কমেনি; বরং বেড়েই চলেছে। সময় ব্যবস্থাপনার ওপর পৃথিবীর বিখ্যাত মনীষীরা বিশাল বিশাল রচনা তৈরি করে চলেছেন। সবার লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো- ‘সীমিত সময়ের মধ্যে বেশি আরো বেশি কাজ করার কলাকৌশল আবিষ্কার করা।’
ইসলাম সময় ব্যবস্থাপনার (Time Management) ব্যাপারে আদৌ কোনো নির্দেশনা বা গুরুত্বারোপ করেছে কি না তা দেখার চেষ্টা করি। প্রথমেই চলুন আমরা আল-কুরআনের একটি ছোট্ট সূরা আল আসরের কাছে যাই, ‘সময়ের কসম, মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করতে থেকেছে, একে অন্যকে হক কাজ ধৈর্যের উপদেশ দিচ্ছে।’ আল্লাহ তায়ালা সময়ের কসম করে সময় ব্যবস্থাপনার (Time Management) গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছেন। সময় মানে বিগত ও বর্তমানকাল হতে পারে। চলতি বা বর্তমানকাল কোনো দীর্ঘ সময়ের নাম নয়। বর্তমানকাল প্রতি মুহূর্তে বিগত হচ্ছে এবং অতীতে পরিণত হচ্ছে। আবার ভবিষ্যতের ভা-ার থেকে প্রতিটি মুহূর্ত বের হয়ে এসে বর্তমানে পরিণত হচ্ছে এবং বর্তমান থেকে অতীতের না ফেরার অতল গহ্বরে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে সময়ের কসম দ্বারা এই দুই ধরনের সময়ই অন্তর্ভুক্ত। অতীতকালের কসম মানে মানুষের ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, যারা সময়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা করেছে আর যারা করেনি তাদের কার কি পরিণাম হয়েছে। আর বর্তমানকালের কসম খাওয়ার অর্থ হলো- এ কথাটি ভালোভাবে বুঝে নেয়া যে, বর্তমান যে সময়টি অতিবাহিত হচ্ছে সেটি এমন একটি সময় যা প্রত্যেক ব্যক্তি ও জাতিকে কাজ করার জন্য দেয়া হয়েছে। যারা এ সীমিত সময়ের সদ্ব্যবহার করবে কেবল তারাই সফলকাম হবে, পক্ষান্তরে অবহেলায় বিনষ্টকারীরা উভয় জগতে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
আমরা এই সীমিত সময়টুকুর গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য একজন পরীক্ষার্থীর তার পরীক্ষা হলের উদাহরণটি এখানে পেশ করতে পারি। পরীক্ষা হলের দুই-তিন ঘণ্টা একজন পরীক্ষার্থীর কাছে অতি মূল্যবান। তাদের কাছে সে সময়ের ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা ভিন্নভাবে আবির্ভূত হয়। এ সময়ে নগণ্য প্রতিটি সেকেন্ডকে অতিমূল্যবান পুঁজি হিসেবে দেখা হয়। কারণ এই তিনটি ঘণ্টার মূলবান সময়টুকুতে নির্ধারিত হবে তার জীবনের জয়-পরাজয়, উন্নতি-অবনতি ও সফলতা-বিফলতা। এ সময়টুকুতে রচিত হবে জীবনের ভিত। তা ছাড়া মানুষের সীমিত সময়টুকুকে একজন বরফওয়ালার পুঁজির সাথে তুলনা করা যায়। সে বাজারে জোর গলায় হেঁকে চলছে… দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পুঁজি গলে যাচ্ছে। দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পুঁজি গলে যাচ্ছে। মানুষকে যে আয়ুষ্কাল দেয়া হয়েছে তা বরফের মতো দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। একে যদি হেলায় বা ভুল কাজে ব্যয় করা হয় তা হলে সেটিই মানুষের জন্য ক্ষতি।
সুতরাং এ সময়কে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সঠিক কাজে ব্যয় করে অধিক ফায়দা আহরণের চেষ্টা করতে হবে। সময় ব্যবস্থাপনা হচ্ছে নিজেকে এমনভাবে পরিচালনা করা, যাতে মানুষকে যে সময়ের গ-িতে আবদ্ধ সেই সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। বিখ্যাত বই The Effective Executive-এর লেখক পিটার ড্রাকার সময় ব্যবস্থাপনার জন্য তিনটি ধাপ অনুসরণের সুপারিশ করেছেন। সেই অধ্যায়টি হলো- ‘নিজের সময়কে জানুন’।
১. আপনার সময়ের বিশ্লেষণ করুন। ২. নিষ্ফল বা নিরর্থক চাহিদাগুলো ছাঁটাই করুন। ৩. হাতে সময় নিয়ে আপনার কাজগুলো সম্পন্ন করার লক্ষ্য স্থির করুন।
এবার চলুন ইসলাম প্রাত্যহিক জীবনে আমাদেরকে কি নির্দেশনা দিয়েছে।
১. আপনার সময়ের বিশ্লেষণ করুন। রাসূল সা: পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয়ের ওপর অগ্রাধিকার বা গুরুত্ব দেয়ার জন্য বলেছেন। ‘বৃদ্ধকাল আসার আগে যৌবনের, অসুস্থতার আগে সুস্থতার, দরিদ্রতার আগে সচ্ছলতার, ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগে অবসরের ও মৃত্যু আসার আগে জীবনের।’ সময় বিশ্লেষণে হাদিসখানা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। পরিকল্পনা, সম্ভাব্যতা, পারিপার্শি^কতা ও প্রতিটি কাজের জন্য বিশ্লেষণমূলক সঠিক সময় নির্ধারণ ও বিন্যস্তকরণ ইসলামের দাবি।
২. নিষ্ফল বা নিরর্থক চাহিদাগুলো ছাঁটাই করুন। লেখকের এ সুপারিশের অনেক আগে কুরআন বলছে- ‘সেই মুমিনরা সফলকাম হয়েছে, যারা বাজে কাজ থেকে বিরত থেকেছে’ (সূরা মুমিনুন-১ ও ৩)। এখানে ফালাহ মানে সাফল্য ও সমৃদ্ধি। এটি ক্ষতি, ঘাটতি, লোকসান ও ব্যর্থতার বিপরীত অর্থবোধক শব্দ। বাজে কাজ মানে এমন প্রত্যেকটি কথা ও কাজ যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন ও যাতে কোনো ফল লাভও হয় না, পরিণামে কল্যাণকর নয়, আসলে যার কোনো প্রয়োজন নেই এবং যেগুলোর উদ্দেশ্যও ভালো নয়। যারা মুমিন তারা এগুলো থেকে বিরত থাকে, সে দিকে তারা দৃষ্টি ফেরায় না, সে ব্যাপারে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করে না, এ ধরনের কাজে তার মহামূল্যবান সীমিত সময় ব্যয় করে না। সূরা ফুরকানে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে বলা হয়েছে- ‘যখন তারা এমন কোনো জায়গা দিয়ে পথ চলে যেখানে বাজে কথা ও কাজের মহড়া চলে, তখন তারা ভদ্রভাবে জায়গা অতিক্রম করে চলে যায়।’ সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে একজন প্রকৃত মুমিনের পরিচয় ধরে তোলা হয়েছে। অর্থাৎ মুমিন এমন ব্যক্তি যিনি সময় ব্যবস্থাপনায় বাজে কথা ও কাজকে প্রশ্রয় দেন না। অর্থাৎ অনর্থক বাজে কথা ও কাজে সময় ব্যয় মুমিনের কাজ নয়। দায়িত্বানুভূতির ব্যাপারে সদা জাগ্রত থাকেন। যে জিনিসটিকে জীবন, বয়স, সময় ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয় সেটি আসলে একটি মাপাজোকা মেয়াদ। এই মাপাজোকা সময় বাজে কথা ও কাজ পরিণামে যার কোনো কল্যাণকর কিছুই নেই, সেখানে সময় ব্যয় করা মানে নিজেকে ধ্বংস করা। মুমিনের অবসর সময় বলতে কিছু নেই; বরং একটু অবসর সময় যদি চলে আসেও তাতেও আল্লাহ কাজ দিয়ে দিচ্ছেন। ‘কাজেই যখনই অবসর পাও, ইবাদতের কঠোর শ্রমে লেগে যাও এবং নিজের রবের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করো’ (সূরা আলাম নাশরাহ : ৭-৮)। অবসর মানে নিজের কাজকাম থেকে অবসর পাওয়া। এটি জীবিকা আহরণ ও পেশাদারি কাজও হতে পারে আবার ইসলামী দাওয়াত, ইসলামের প্রচার-প্রসারের কাজও হতে পারে। এই কাজ থেকে যখনই সামান্যতমও অবসর পাবে, তখন সেই সময়টুকু বেহুদা ব্যয় না করে ইবাদতের পরিশ্রম ও সাধনায় ব্যয় করে এবং সবদিক থেকে দৃষ্টি ও মনোযোগ ফিরিয়ে এনে একমাত্র নিজের রবের প্রতি মনোযোগ হয়ে যাও।
৩. হাতে সময় নিয়ে আপনার কাজগুলো সম্পন্ন করার লক্ষ্য স্থির করুন। লেখকের এ কথার অর্থ হলো- দুই বা ততধিক কাজ একই সাথে না করে; বরং একটি কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য যেই সময় প্রয়োজন, ততটুকু সময় শুধু সেই কাজের জন্যই নির্ধারণ করুন। তা হলে কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হবে। এলামেলো অগোছালো কাজ ১০টা করার চেয়ে একটি কাজ সুচারুরূপে পালন ভালো। ইসলাম যেই কাজটিকে ইহসান এবং এর কর্মীকে মুহসিন নামে আখ্যায়িত করেছে।
ইহসান আরবি শব্দ। ‘হুসন’ শব্দ থেকে এসেছে। যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘সুন্দর ব্যবহার’। ভালোভাবে কোনো কাজ সম্পাদন করা, কারো কষ্ট লাঘব করা ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায় ‘ইহসান হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য উত্তমরূপে ইবাদত করা এবং তার সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি এবং তাঁর সৃষ্টির প্রতি যাবতীয় কর্তব্য সুন্দর ও উত্তমরূপে সম্পাদন করার নামই ইহসান।
একজন ইসলামী বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘ইহসান মানে হচ্ছে, কাজ ভালোভাবে ও সুচারুরূপে সম্পন্ন করা। কাজ করার বিভিন্ন ধরন আছে। তার একটি ধরন হচ্ছে যে, কাজটি করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, সেটি কেবল নিয়মমাফিক সম্পন্ন করা। দ্বিতীয় ধরন হচ্ছে, তাকে সুচারুরূপে সম্পন্ন করা এবং নিজের সমস্ত যোগ্যতা ও উপায়-উপকরণ তার পেছনে নিয়োজিত করে সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে তাকে সুসম্পন্ন করার চেষ্টা করা। প্রথম ধরনটি নিছক আনুগত্যের পর্যায়ভুক্ত। এ জন্য তাকওয়া ও ভীতি যথেষ্ট। আর দ্বিতীয় ধরনটি হচ্ছে ইহসান। এ জন্য ভালোবাসা প্রেম ও গভীর মনোসংযোগ প্রয়োজন হয়।
সময় হলো অদ্বিতীয় সম্পদ, সময় অস্থিতিস্থাপক, সময় ক্ষয়প্রাপ্ত, যা কখনো জমা থাকে না, সময় কখনো প্রতিস্থাপনযোগ্যও নয় এবং এর কোনো বিকল্পও নেই। সুতরাং সময়কে কাজে লাগান। একে হেলা করবেন না। তা হলে নিজেই অবহেলিত হয়ে যাবেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com