আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আল্লাহ এ পৃথিবীর মালিক। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন রাজ্যের ক্ষমতা দান করেন। আর যার থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নেন।’ (সূরা আলে-ইমরান-২৬) আরো ইরশাদ করেন- ‘আমি যাদেরকে জমিনের ক্ষমতা দান করি, তারা সালাত কায়েম করে, জাকাত-ভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থা চালু করে, সৎকাজের আদেশ করে এবং অসৎ ও পাপাচার থেকে (জনগণকে) বিরত রাখে।’ (সূরা আল হজ-৪১)
পৃথিবীতে দু’ধরনের শাসক রয়েছে। যেমন- ন্যায়পরায়ণ ও ধার্মিক শাসক এবং জালিম ও অসৎ শাসক। ন্যায়পরায়ণ শাসকের গুণাবলি হলো-
১. দেশকে নিজের কাছে আমানত মনে করা; ২. পরকালের জবাবদিহিতার চিন্তা করা; ৩. প্রজাদের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করা; ৪. অন্যায়ের কাছে মাথানত না করা; ৫. সদা নিজের মধ্যে আল্লাহভীতি জাগ্রত রাখা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী, আল্লাহর ওয়াস্তে সত্যের সাক্ষ্যদানকারী হও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে যায়।’ (সূরা আন নিসা-১৩৬) পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী একজন ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন হজরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ রা:। তার মধ্যে যেমন ছিল আল্লাহভীতি, তেমনি ছিল পরকালভীতি। আর তা তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
হজরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ রা:- তিনি হলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব রা:-এর নাতি। তাকে প ম খুলাফায়ে রাশেদিন বলা হয়। তিনি উমাইয়া যুগে পুনরায় রাশেদার যুগ ফিরিয়ে এনেছিলেন। তার আড়াই বছরের শাসনকাল ছিল ইসলামের সোনালি যুগের প্রতিচ্ছবি। তিনি প্রজাদের উদ্দেশে একটি ভাষণে বলেছেন- ‘হে মানব সমাজ! তোমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করা হয়নি এবং অর্থহীনভাবে ছেড়েও দেয়া হয়নি। তোমাদের জন্য অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সময় আছে, যাতে আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্মের ফয়সালা করবেন। অতএব, সে ব্যক্তি তখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যে আল্লাহর ওই রহমত থেকে দূরে সরে থাকবে যা সবকিছুকে বেষ্টন করে রেখেছে এবং এমন জান্নাত থেকে বি ত থাকবে যা আসমান ও জমিনতুল্য বিস্তৃত। আর তোমরা জেনে রেখো, আগামীকালের তথা পরকালের নিরাপত্তা ও মুক্তির গ্যারান্টি ওই ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট, যে এ পৃথিবীতে আল্লাহকে ভয় করবে এবং আধিক্যের বিনিময়ে স্বল্পকে ও স্থায়ী জিনিসের বিনিময়ে অস্থায়ী জিনিসকে বিক্রয় করে দেবে। তোমরা কি দেখছ না যে, তোমরা ধ্বংসপ্রাপ্তদের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছ এবং তোমাদের পরে আগতরা তোমাদের প্রতিনিধিত্ব করবে, এমনকি তাদেরকে সর্বোত্তম উত্তরাধিকারীর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। আর তোমরা প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর দিকে এমন ব্যক্তিকে বিদায় দিচ্ছ, যার দুনিয়ার হায়াত ফুরিয়ে গেছে এবং যার মৃত্যুর সময় এসে পৌঁছেছে। অনন্তর তোমরা তাকে মাটির গর্তে লুকিয়ে রাখো এবং বালিশ ও বিছানা ছাড়াই ছেড়ে আসো। সে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পার্থিব সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। শুধু তাই নয়; বরং সে হিসাবের মুখোমুখি হয়েছে। এখন সে পৃথিবীতে রেখে যাওয়া সম্পদের প্রয়োজনমুক্ত এবং দুনিয়া থেকে প্রেরিত ভালো আমলের মুখাপেক্ষী। আল্লাহর শপথ! আমি কেবল তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি না; বরং আমি তোমাদের চেয়ে বেশি গুনাহগার। আমি জানি না, তোমাদের কারো কাছে আমার যে পরিমাণ গুনাহ আছে তার চেয়ে বেশি কিছু আছে। সুতরাং আমি আমার ও তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আর যখনই তোমাদের কোনো প্রয়োজন আমার কাছে পৌঁছে যা সমাধান করার মতো সামর্থ্য আমার থাকবে, তখন আমি তা সমাধান করব। আর তোমাদের যে কেউ-ই হোক না কেন, আমার কামনা যে, তার হাত আমার ও আমার আত্মীয়-স্বজনের সাথে থাকবে, যাতে আমার ও তোমাদের জীবন যাপন বরাবর হয়ে যায়। আল্লাহর শপথ, আমি যদি এর চেয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করতাম, তাহলে আমার জবান তা সহজভাবে ব্যক্ত করত। আর পার্থিব সম্পদ অর্জন করার উপায়-উপকরণাদিতেও আমি অভিজ্ঞ ছিলাম। কিন্তু আমি তা করিনি। কারণ, আল্লাহর কিতাব তথা কুরআন মাজিদ ও ইনসাফপূর্ণ রীতি-নীতি আমার সামনে উপস্থিত। যার মধ্যে তিনি স্বীয় আনুগত্যের আদেশ করেছেন এবং অবাধ্যতা থেকে নিষেধ করেছেন।
খানাসিয়া নামক স্থানে তিনি এ বক্তব্য দিয়েছিলেন। এটি ছিল তার জীবনের সর্বশেষ বক্তব্য। বক্তব্য শেষে তিনি এতই ক্রন্দন করেছিলেন যে, তার চোখের পানিতে চাদর পর্যন্ত ভিজে গিয়েছিল। শুধু হজরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ রা: নন; বরং সোনালি যুগের সব রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, ধার্মিক ও সুশাসক। লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামিয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী