আল্লাহর রাস্তায় জানমাল দিয়ে সংগ্রাম করা মুক্তির একটি অন্যতম সোপান। তাই এ ক্ষেত্রে ভয়ভীতি ও কৃপণতা পরিহার করতে আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে বলেছেন, ‘শোনো, তোমরাই তো তারা, যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার আহ্বান জানানো হচ্ছে, অতঃপর তোমাদের কেউ কেউ কৃপণতা করছো, যারা কৃপণতা করছো, তারা নিজেদের প্রতি কৃপণতা করছো। আল্লাহ তায়ালা অভাবমুক্ত এবং তোমরা অভাবগ্রস্ত। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এরপর তারা তোমাদের মতো হবে না।’ (সূরা মুহাম্মাদ-৩৮)
‘আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন অভাবমুক্ত আর তোমরা হচ্ছো অভাবী। কারণ তিনিই তোমাদেরকে ধনসম্পদ দান করেছেন এবং তিনিই তোমাদের দানকে তোমাদের জন্য সঞ্চয় করে রেখে দেন। তিনি দুনিয়াতে তোমাদেরকে যা কিছু দান করেছেন সেগুলো থেকেও তিনি অমুখাপেক্ষী এবং পরকালের জন্য যা কিছু তোমাদের হিসাবে সঞ্চয় করে রাখেন, সেগুলো থেকেও অমুখাপেক্ষী। এসবে তার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং উভয় জগতে ও উভয় অবস্থায় তোমরাই তার প্রতি মুখাপেক্ষী। পৃথিবীতে জীবিকার জন্য তোমরা তার মুখাপেক্ষী। কারণ তিনি জীবিকার ব্যবস্থা না করে দিলে তা জোগান দেয়ার মতো ক্ষমতা ও শক্তি তোমাদের নেই। তেমনিভাবে পরকালেও তোমরা তার প্রতিদানের প্রতি মুখাপেক্ষী। কারণ তিনিই অনুগ্রহ করে তোমাদেরকে প্রতিদান দেবেন। তোমাদের নিজের প্রয়োজন মেটানোর মতো ব্যবস্থাই যেখানে তোমাদের নেই, সেখানে পরকালের জন্য অতিরিক্ত আর কী থাকবে? মানুষ ইহজগতে আল্লাহর পথে যা কিছু খরচ করে তার জমার খাতায় তা সঞ্চয় হিসেবে থাকে; এই সঞ্চয় প্রয়োজনের মুহূর্তে তার কাজে আসবে। সেই মুহূর্তটি যখন আসবে তখন তা শেষ সম্বল হিসেবে কাজে আসবে। কাজেই মানুষ যদি ইহজগতে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে গিয়ে কৃপণতা করে, তাহলে এই কৃপণতা প্রকৃতপক্ষে সে নিজের সাথেই করছে। কারণ এর ফলে তার নিজ সঞ্চয়ের ঘাটতি দেখা দেবে, এই সম্পদ তার নিজের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং সে নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করবে। এ কথা ঠিক যে, আল্লাহ তায়ালা যখন মানুষকে তার রাস্তায় খরচ করতে বলেন, তখন এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে তাদের মঙ্গলই কামনা করে থাকেন, তাদের সচ্ছলতাই কামনা করেন এবং এই দানককে পরকালে তাদের জন্য বিরাট সঞ্চয় হিসেবে রেখে দেন। এই দান থেকে তিনি নিজে কিছুই লাভ করেন না। কারণ তিনি তাদের এই দানের আদৌ মুখাপেক্ষী নন।’ (তাফসির ফি জিলালিল কুরআন)
হাদিসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সা:-এর সহধর্মিণী আয়েশা রা:-এর কাছে এক ভিক্ষুক এসে কিছু ভিক্ষা চাইল। আয়েশা রা: সিয়াম রেখেছিলেন। ঘরে একটি রুটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তিনি স্বীয় দাসীকে বললেন, এটি ফকিরকে দিয়ে দাও। দাসী সেই রুটিটি ফকিরকে দিয়ে দিলো। দাসী বলে, সন্ধ্যায় কোনো বাড়ি থেকে বা কোনো এক ব্যক্তি হাদিয়া পাঠিয়ে দিলো ছাগলের ভুনা গোশত। আয়েশা রা: আমাকে ডেকে বললেন, খাও। এটা তোমার রুটি থেকে উত্তম।’ (মুয়াত্তা মালিক-১৮৭৬)
কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন- ‘অতএব তোমরা সাধ্য মোতাবেক আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো, তোমরা (রাসূলের আদেশ) শোনো এবং (তাঁর) কথামতো চলো, আল্লাহর দেয়া ধনসম্পদ থেকে (তাঁরই উদ্দেশ্যে) ব্যয় করো, এতে তোমাদের নিজেদের জন্যই কল্যাণ রয়েছে। (তাগাবুন-১৬)
দানের ফজিলতের ব্যাপারে সাওবান রা: থেকে বর্ণিত : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন- ‘সর্বোত্তম দিনার হলো ওই দিনার যা নিজের সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের জন্য ব্যয় করা হয়। আর সে দিনারও উত্তম যে দিনার জিহাদের জন্য রক্ষিত পশুর জন্য ব্যয় করা হয়। আর সে দিনারও উত্তম যে দিনার জিহাদে অংশগ্রহণকারী স্বীয়-সাথীদের জন্য খরচ করা হয়। (মুসলিম-৯৯৪)আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সদকা করো, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকির-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে তা আরো বেশি উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন।’ (সূরা বাকারাহ-২৭১)
হাদিসেও বিভিন্নভাবে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সা: আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার জন্য উম্মতের প্রতি উৎসাহব্যঞ্জক আহ্বান জানিয়েছেন- ‘যে ব্যক্তি হালাল কামাই থেকে একটি খেজুর সমপরিমাণ সদকা করবে (আর আল্লাহ তায়ালা তো একমাত্র হালাল বস্তুই গ্রহণ করে থাকেন) আল্লাহ তায়ালা তা ডান হাতে গ্রহণ করবেন। অতঃপর তা তার কল্যাণেই বর্ধিত করবেন যেমনিভাবে তোমাদের কেউ একটি ঘোড়ার বাচ্চাকে সুন্দরভাবে লালন-পালন করে বর্ধিত করো। এমনকি আল্লাহ তায়ালা পরিশেষে সে খেজুর সমপরিমাণ বস্তুটিকে একটি পাহাড় সমপরিমাণ বানিয়ে দেন।’ (বুখারি-১৪১০)। আমাদের আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে- কোনো আমলকেই ছোট মনে করা যাবে না। কেননা কঠিন হাশরের ময়দানে একটি নেকির জন্য আহাজারি করলেও তা মিলবে না। এমন নেক আমল রয়েছে তা ছোট মনে হলেও বড় কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এমনকি পরিবারের জন্য ব্যয় করলেও দানের সওয়াব পাওয়া যায়। তাই তো বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সা: উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তুমি যা কিছুই ব্যয় করো, সেটিই তোমার জন্য দান হিসেবে গণ্য, এমনকি তোমার স্ত্রীর মুখে যে লোকমাটি তুমি তুলে দাও সেটিও।’ (বুখারি-৫৩৫৪)। লেখক : সাংবাদিক