এখন ঘরে ঘরে রঙিন টেলিভিশন। নানা মাপের, নানা ডিজাইনের। একসময় যে এই জাদুর বাক্স শুধু সাদা–কালো মানুষ দেখাত, তা বর্তমান প্রজন্ম হয়তো বিশ্বাস করবে না। প্রথম তৈরি হওয়া থেকে শুরু করে সাদা–কালো বিশাল বাক্স থেকে এখন বসার ঘরে শোভা পায় নান্দনিক সব টিভি। টিভির এই বিবর্তন হুট করে হয়নি। লম্বা সময় ধরে ধাপে ধাপে এই পরিবর্তন হয়েছে। চলুন জেনে নিই, আবিষ্কারের পর থেকে আজকের আধুনিক টিভির রূপান্তরের গল্পটি। বিগত শতাব্দীর এক বিস্ময়কর আবিষ্কার এই টেলিভিশন। ‘টেলি’ গ্রিক শব্দ, যার অর্থ দূরত্ব এবং ‘ভিশিওন’ লাতিন শব্দ, যার অর্থ দেখা। টেলিভিশন এমন একটি যন্ত্র, যার মাধ্যমে দূরে বসে ছবি দেখা যায়; আবার শব্দও শোনা যায়। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন লগি বেয়ার্ড ১৯২৬ সালে প্রথম টেলিভিশন আবিষ্কার করেন। ১৯২৮ সালে জেনারেল ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি ৩ (তিন ইঞ্চি) পর্দার প্রথম যান্ত্রিক টেলিভিশন জনসমক্ষে প্রদর্শন করে। এই টিভির নামকরণ করা হয় ‘অক্টাগন টেলিভিশন’। পরে ইংল্যান্ডে তৈরি হয় বেয়ার্ড টিভি। এই টিভি প্রথম বেতারের মাধ্যমে চলমান চিত্র প্রদর্শন করে। টেলিভিশন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালু হয় ১৯৪০ সালে। ১৯৩৬ সালে ‘ইমিভিসর’ নামে মাত্র ১০ সেট ফ্রেঞ্চ টিভি তৈরি হয়েছিল। আট ইঞ্চি পর্দার ওই টিভিতে ছবি দেখতে ম্যাগনিফাইং লেন্স ব্যবহার করতে হতো। ৪৫ কেজির বেশি ওজনের মার্কনি টিভির পর্দা ছিল মাত্র সাত ইঞ্চি। এরপর ১৯৪৮ সালে বাজারে আসে সাত ইঞ্চি পর্দার টিভি মটোরোলার ‘গোল্ডেন ভিউ’। এই টিভি ছিল তৎকালীন সময়ের সাশ্রয়ী ও সেরা টিভি। ১৯৪৯ সালে আসে নতুন বৃত্তাকার টিভি পার্থোল। এর ১২টি চ্যানেল ধরার ক্ষমতা ছিল।
১৯৫০ সালে বাজারে আসে প্রথম রিমোটযুক্ত টিভি। ১৯৫৩ সালে জাপানি কোম্পানি শার্প কাঠের ফ্রেমে ১৪ ইঞ্চির টেলিভিশন বাজারজাত করে, যা বেশ ব্যয়বহুল ছিল। প্রথম রঙিন টেলিভিশন আসে ১৯৫৪ সালে। এর পর্দা ছিল ১৫ ইঞ্চি। পঞ্চাশের দশকের আধুনিক রেকট্রো নকশার টিভি ফিলকো প্রেডিকা বাজারে আসে ১৭ থেকে ২১ ইঞ্চি পর্দা নিয়ে। এর বাজার শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। এরপর ১৯৬২ সালে জাপানিদের বানানো টিভি ছিল ‘মেইডেনসা’।
এর পর্দা ছিল ১০ থেকে ২১ ইঞ্চির। ১৯৮১ সালে জাপানিরা প্রথমবারের মতো এইচডিটিভি বা হাই ডেফিনেশন টিভি নির্মাণ করে। ১৯৯৮ সালে বিশ্ববিখ্যাত জাপানি ইলেকট্রনিকস কোম্পানি সনি বাজারে আনে সনি এফডি ট্রিনিট্রন ওয়েগা। এই টিভি আকারের দিক থেকে অনেক টিভি থেকে ছিল অনেক উন্নত ও আলাদা। চ্যানেল ছিল বহু। ধীরে ধীরে টিভি সেটে আসে আরও পরিবর্তন। একসময়ের বড় বাক্সের ‘ক্যাথোড রে টিউবের’ জায়গা দখল করে নেয় স্লিম এলসিডি টিভি। প্রযুক্তির উন্নয়নের ধারায় আমরা এমন টিভি দেখতে পাই। ২০০৭ সালে বাজারে আসে এলইডি টিভি। ফ্ল্যাট প্যানেল টিভি অতি অল্প সময়ে ভীষণ রকম গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময় বিক্রয় তালিকার শীর্ষে ছিল কোরিয়ান কোম্পানি স্যামসাং টিভি। এর মাধ্যমে সমতল টেলিভিশন এবং উচ্চ রেজল্যুশনের প্লাজমা টিভির সূচনা হয়।
প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতির ফলে এখন আমরা টিভি স্ক্রিন ও কম্পিউটার স্ক্রিনের মধ্যে তেমন পার্থক্য দেখি না। রেজল্যুশন বৃদ্ধির কারণে টিভির ছবির মান অনেক উন্নত হয়েছে, যা চোখের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। ২০১২ সালে প্রথম স্মার্ট টিভির সূচনা হয়। স্যামসাং এই যাত্রা শুরু করে। স্মার্টটিভিতে ইন্টারনেট ও নানা অ্যাপ সংযুক্ত করা হয়। ইন্টারনেটভিত্তিক এই টিভিগুলোকে বলা হয় ‘আইপিটিভি’। টিভিগুলোর সিগন্যাল ইন্টারনেটের মাধ্যমেই যায়। বেসিক টিভি আর ইন্টারনেট টিভির মধ্যে যেমন পার্থক্য আছে, তেমনি পার্থক্য আছে দামেও। বেসিক টিভির তুলনার ইন্টারনেট টিভির দাম একটু বেশি। আইপিটিভির মাধ্যমে নিজের ঘরে বসে মানুষ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছে।