শাসক দল আপাতত সেই সাংবিধানিক সংকট কাটিয়ে উঠে রাজনীতির খেলায় প্রতিপক্ষকে ডিগবাজি খাইয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। ইতিমধ্যে নির্বাচন-উত্তর মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, এই মন্ত্রিসভা থেকে অনেক ডাকসাইটে নেতাসহ মোট ৩০ জন সদস্য বাদ পড়েছেন। ’৯১ সালের পর গঠিত সবচেয়ে ছোট এই মন্ত্রিসভায় ৩৭ জনের মধ্যে ২২ জনই নতুন। এদের মধ্যে ১৪ জন আবার একেবারেই আনকোরা, অর্থাৎ এদের কেউই আগে কখনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী ছিলেন না। সে বিবেচনায় বর্তমান মন্ত্রিসভা নতুন-পুরনোর এক অনন্য মিশ্রণ বলা যায়। তবে সামনে রাজনীতি, কূটনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ অনেক। এ মুহূর্তে দেশের প্রধান সমস্যা মুদ্রাস্ফীতি। প্রায় দুবছর ধরে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া দেশের মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সরকারি হিসাবেই বিগত বছর মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল প্রায় দশ শতাংশের কাছাকাছি। বাস্তবে এর মাত্রা অনেক বেশি; আগে এক পাতা ডকুমেন্ট ফটোকপি করতে এক টাকা লাগত, এখন সেটার খরচ ৩ টাকা। এই নমুনা থেকে মূল্য বৃদ্ধির প্রকৃত চিত্র বোঝা যায়। সীমিত আয়ের মানুষ এই মূল্যস্ফীতির প্রধান শিকার। আয়-ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় যাদের কিছু সঞ্চয় ছিল, তারা সেটা ভেঙে খাচ্ছে, আর যাদের সেটা নেই, তারা ভোগ, বিশেষ করে খাবার কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। এই অবস্থা দীর্ঘদিন চললে একদিকে নি¤œ মধ্যবিত্তের এক বড় অংশের যেমন দারিদ্র্যসীমার নিচে অবনমন ঘটবে, তেমনি সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে।
মুদ্রাস্ফীতি সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয় ও বৈষম্য বৃদ্ধি করে। এমনিতেই এখন আয়বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশে গিনি সহগের মান ইতিমধ্যে ০.৪৯৯ হয়ে গেছে। তার ওপর ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ থেকে দেখা যায় যে, দেশে উচ্চতম আয়ের ১০ শতাংশ মানুষের হাতে জাতীয় আয়ের ৩০.৪ শতাংশ আয় কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে নি¤œতম আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের জাতীয় আয়ের হিসসা মাত্র ১৮ শতাংশ। এরপর আরও যে অসহনীয় দুবছর চলে গেছে, তাতে নিশ্চয়ই এ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে থাকবে।
যাদের কর্ম আছে, তাদের অবস্থাই নাকাল, আর যাদের আদৌ কর্ম ও আয় নেই, তাদের অবস্থা যে কী, তা সহজেই অনুমেয়। কভিডের সময় অনেক মানুষ কর্ম হারায়। সে অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার শুরু হওয়ার আগেই আরম্ভ হয় ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ও বিনিয়োগে ভাটা পড়ে। ফলে কর্ম সৃজনে শুরু হয় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। মুদ্রাস্ফীতি রোধকল্পে এখন দেশে চলছে বিলম্বিত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি। মূল্যস্ফীতি বাগে আনতে এ জাতীয় নীতি হয়তো আরও বেশ কিছুদিন চর্চা করার প্রয়োজন হবে। তাহলে বিনিয়োগ ও কর্ম সৃজনে প্রবৃদ্ধি কীভাবে ঘটানো যাবে? এ যেন হোমার রচিত অডিসির প্রধান কুশীলব ইউলিসিসের বাড়ি প্রত্যাবর্তনের সময় ইবঃবিবহ ঝপুষষধ ধহফ ঈযধৎুনফরং অবস্থা।
সস্তায় ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে সুদের হারে নয়-ছয়ের টুপি পরিয়ে দেওয়া হয়। এতে বিনিয়োগ না বাড়লেও সে ঋণের একটা বড় অংশ নয়-ছয় হয়ে যায়; অর্থাৎ অকার্যকর ঋণে (এনপিএল) পরিণত হয়ে যায়; এখন অকার্যকর ঋণের পরিমাণ ১.৫৬ লাখ কোটি টাকা, আর অবলপিত ও দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এর দ্বিগুণেরও বেশি। এই টাকা আদায়ের ব্যবস্থা তেমন দৃশ্যমান নয়। এসব ঋণের গ্রহীতারা প্রায় সবাই রাঘববোয়াল; যাদের অনেকের বিরুদ্ধে এই ঋণের টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কেউই সস্তা ঋণের তেমন একটা দেখা পাননি। অথচ দেশে এসব প্রতিষ্ঠানেই মোট শ্রমশক্তির ৩০ শতাংশ নিয়োজিত রয়েছে। দেশের শিল্পায়নে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য প্রধান উৎস হওয়ার কথা পুঁজিবাজারের। কিন্তু অপরিণামদর্শিতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে স্বল্পমেয়াদি জামানত গ্রহণকারী ব্যাংক দীর্ঘ মেয়াদে শিল্পে বিনিয়োগ করে পাহাড়সম মন্দ ঋণের ভারে আজ তারল্য সংকটে নিপতিত। আর পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করে তার স্বাস্থ্যকে কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের তথাকথিত স্বার্থরক্ষার নামে তাকে পাঠানো হয়েছে আইসোলেশনে; এখন আর সেই আইসোলেশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে না, কেউ আর সেখান থেকে বেরও হতে পারছেন না। পুঁজিবাজারকে এ অবস্থায় রেখে টাকা খরচ করে বিদেশে রোডশো করলে কোনো লাভ হবে না।
দেশে চলছে ডলার সংকট। রিজার্ভ অনেক নিচে নেমে গেছে; আইএমএফের দেওয়া সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এটা যে এখন সম্ভব নয়, সে কথা বিদায়ী অর্থমন্ত্রী নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন। এটা নিরসনে এখন আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কথা ছিল যে, শুধু বিলাস সামগ্রীর আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কিন্তু সেটা অনেক ক্ষেত্রেই পরিপালন করা হচ্ছে না। কয়েক দিন আগে একটা খবরে দেখলাম, বিগত অর্থবছরে দেশে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি হয়েছে ৬২০টি, তার আগের বছর এরূপ গাড়ির সংখ্যা ছিল মাত্র ২৩০টি। আবার এখন যে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তার একটা বড় অংশ হলো রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনী সামগ্রী। ফলে রপ্তানিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, অর্থাৎ হিতে বিপরীত ফললাভ হচ্ছে। এরপরও প্রতি মাসে চলতি হিসাবে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার করে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং ও রপ্তানির সম্পূর্ণ অর্থ দেশে না এনে মুদ্রা পাচারের এন্তার অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি কর্মী বিদেশে পাড়ি জমালেও আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে তাদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ বাড়ছে না; মাঝে মধ্যে বরং তা কমে যাচ্ছে। হাওলা ও হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের কারণে এমনটা হচ্ছে বলে সবার ধারণা। অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ এর দাওয়াই হিসেবে টাকা ও ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
কিন্তু আমার মনে হয় যে, এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেও হুন্ডির কারবার বন্ধ করা যাবে না। অবৈধ অর্থের লেনদেন হলো হুন্ডির প্রাণ-ভ্রমরা; কাজেই যতদিন অবৈধ অর্থের লেনদেন চলবে, ততদিন হুন্ডির চাহিদা থাকবে। এ জন্য হুন্ডি নিয়ন্ত্রণে তার প্রাণ-ভ্রমরাকে বাগে আনার কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। দেশে জিডিপি বাড়ছে, কিন্তু কর আদায়ের হার ক্রমেই কমছে। আগে এর হার ছিল ১০ শতাংশের মতো, এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৭.৫ শতাংশে। এত কম কর আদায় দিয়ে ক্রমবর্ধমান প্রশাসনিক, উন্নয়ন ও ঋণ পরিষেবার ব্যয় কীভাবে নির্বাহ করা যাবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। এদিকে আবার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে; নতুন ঋণ নিয়ে আগের ঋণের পরিষেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভর্তুকির অর্থ মেটাতে বন্ড ছেড়ে, অর্থাৎ ঋণ নিয়ে অর্থের জোগান দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হচ্ছে। ফলে ঋণের বোঝা ভারী হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তির্যক মন্তব্য প্রকাশ করেছে বটে, তবে দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে।
অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পদক্ষেপ দৃশ্যমান না হলে জনমনে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা সহজে দূর হবে না। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে নির্বিঘেœ পরিবৃত্তি কাল পাড়ি দেওয়ার প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে বিলম্বিত মূল্য পরিশোধের প্রতিশ্রুতিতে জরুরি পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। শীতকাল শেষে সার ও বিদ্যুতের চাহিদা যখন আরও বেড়ে যাবে, তখন জ্বালানি ও সার আমদানিতে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে যে উচ্চ সুদ বিরাজমান, সে প্রেক্ষাপটে এই কার্যক্রম কীভাবে দেশের প্রয়োজন মেটাবে ও দায়কে প্রভাবিত করবে, সেটা অগ্রভাগে প্রাক্কলন, পরিবীক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা জরুরি। এসব সমস্যা সমাধানে নিরন্তর কাজ করে যেতে হবে। কিন্তু আগের অর্থমন্ত্রীকে খুঁজেই পাওয়া যেত না। এ জন্য অনেক অর্থনীতিবিদ তাকে অনুপস্থিত মন্ত্রী অভিধায় ভূষিত করেছিলেন। এর বিপরীতে বর্তমান অর্থমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী অফিসে গিয়ে প্রথম দিন বলেছেন, ‘অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ আছে। রাতারাতি সব দূর করা যাবে না; সময় লাগবে। আমি বসে থাকার লোক নই।’ তার এই কথায় আমরা আস্থাশীল হতে চাই, আস্থাশীল হওয়ার সঙ্গত কারণও রয়েছে।
আবুল হাসান মাহমুদ আলী ছিলেন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পরপরই তিনি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিউ ইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরূপে স্বাধীনতার সপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। সেই সময় মে মাসে তিনি যখন ইংল্যান্ড থেকে নিউ ইয়র্ক যান, তখন মাহমুদ আলী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দেখা করানোর কাজে রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। আবু সাঈদ চৌধুরীর নিজের ভাষায়, ‘তিনি সকালে আসতেন, সব এনগেজমেন্ট শেষে রাত দুপুরে আমাকে রুমে রেখে বাসায় ফিরে যেতেন।’ তার ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’তে এসবের স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে।
মাহমুদ আলীর স্ত্রী শাহীন মাহমুদ আলীও যে স্বামীর উপযুক্ত সহধর্মিণী সে স্বাক্ষর তিনি তখনই রেখেছেন। আবু সাঈদ চৌধুরী তার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এ ব্যাপারে মাহমুদ আলীর স্ত্রী শাহীন মাহমুদ আলী আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেন। তিনি একটি দূতাবাসে ফোন করে আমার জন্য সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলে আমরা সেই রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যখন সাক্ষাতে লিপ্ত, তখন মিসেস আলী অন্য রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে ফেলতেন।’ মাহমুদ আলী পড়ালেখা অর্থনীতিতে, আর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন পররাষ্ট্র বিষয়ে। বর্তমান সংকটে এ দুটোর জ্ঞানই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে এই মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কর্মস্পৃহা প্রত্যাশা করি। ( দৈনিক বণিকবার্তার সৌজন্যে) লেখক: খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কলামিস্ট rulhanpasha@gmail.com