বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১৮ অপরাহ্ন

চৌরঙ্গী

শংকর
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২৪

(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
ইন্টারনেটের সৌজন্যে খবরপত্রের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।- বি.স
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আচ্ছা, আপনি বোসকে জিজ্ঞাসা করে রাখবেন, আমি পরে জেনে নেব। ফোকলা চ্যাটার্জি এবার ফোনটা ছেড়ে দিলেন।
স্ট্যাটিসটিকস শব্দের অর্থ বোসদার কাছে শুনেছিলাম। বোসদা বলেছিলেন, ছিঃ, তুমি না হাইকোর্টে কাজ করেছ। সভ্যতার মাপকাঠি জানো না? আজকের সভ্যতায় পুরুষকে মাপা হয় ব্যাংকের ফিগার দিয়ে, আর মেয়েদের মাপা হয় দেহের ফিগার দিয়ে। ৩৬-২২-৩৪, ৩৪-২০-৩৪-এতেই আমাদের পৃষ্ঠপোষকেরা সব বুঝে নেন।
কনির স্ট্যাটিসটিকস তখন আমাদের জানা ছিল না। মার্কোপোলো বলেছিলেন, ছমাসের পুরনো স্ট্যাটিসটিকস আমার কাছে আছে। কিন্তু তা দেওয়া যায় না।
ফোকলা চ্যাটার্জি আবার ফোন করেছিলেন। বোসদা টেলিফোন ধরে বলেছিলেন, হা স্যর, লেটেস্ট স্ট্যাটিসটিকসের জন্যে আমরা রিপ্লাই-পেড় টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিয়েছি, এখনও উত্তর আসেনি। বোসদা আরও বলেছিলেন, এবার খুবই সুন্দর জিনিস হবে। শুধু নাচ নয় স্যর, সঙ্গে অন্য জিনিসও আছে।
কী জিনিস মশাই? একটু হিন্ট দিন না। রঙ্গনাথনকে গরম করে রাখি। পুওর ফেললাÍওঁর বউ ভদ্রলোককে ডেলি বঁটা মারে!
বোসদা বললেন, স্যরি, এখন বলবার হুকুম নেই। ওখানেই বুঝতে পারবেন।
রাত আটটা থেকে শাজাহান হোটেলের সামনে গাড়িতে গাড়িতে জম-জমাট। যেন কোনো বিশাল জালে দেশের সব সুন্দর গাড়িগুলোকে মাছের মতো টানতে টানতে কেউ শাজাহান হোটেলের সামনে এনে জড়ো করেছে। গাড়ি আসছে, গেটের সামনে মুহুর্তের জন্য থামছে, দারোয়ানজি দরজাটা খুলে স্যালুট দিয়ে সরে দাঁড়াচ্ছে। সায়েব নেমে পড়ছেন।
সান্ধ্য পোশাকে সজ্জিত হয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে, আমাকে একবার ন্যাটাহারিবাবুর কাছে যেতে হয়েছিল। আমার বিছানার চাদরটা একটু ময়লা হয়ে গিয়েছিল। এক কাড়ি ময়লা কাপড়ের মধ্যে ভদ্রলোক বসেছিলেন। ন্যাটাহারিবাবু বললেন, আপনার চাদর পাঠিয়ে দিচ্ছি। তা আজ গাড়ি আসছে কেমন?
অনেকÍআমি বললাম।
দেশের সবাই এখন সায়েব হয়ে গিয়েছেন, ন্যাটাহারিবাবু বললেন। ১৭৫৭ সালে পলাশির আমবাগানে ইংরেজরা ভারতবর্ষ জয় করেছিল যারা বলে, তারা হিস্ট্রির কচু জানে! আসলে ইংরেজ জিতল তার অনেকদিন পরে, আমাদের এই চোখের সামনে উনিশো সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্ট। দেশটা রাতারাতি চিরকালের জন্যে ইংরেজের হয়ে গেল। ন্যাটাহারিবাবু থামলেন। তারপর আবার আরম্ভ করলেন, গান্ধী যখন আন্দোলন করছেন, লোকে যখন জেলে যাচ্ছে, বন্দে মাতরম্ গাইছে, খদ্দর পরছে, আমরা তখন ভয় পেতাম। বেশিদিন হোটেলের চাকরি আমাদের কপালে আর নেই। আমার সম্বন্ধী চৌরঙ্গী পাড়ার সায়েবি সিনেমার অপারেটর। আমরা দুজনে ভাবতাম, স্বাধীন হলেই এ-সব বন্ধ হয়ে যাবে। বিলিতি সিনেমায় মাছি বসবে না, শাজাহান হোটেল খাঁ-খাঁ করবে, মমতাজ বার লাটে উঠবে। ক্রাইস্ট, ক্রিকেট আর ক্যাবারেকে প্যাক করে দেশে পাঠিয়ে দিয়ে ব্যাটাচ্ছেলে সায়েবরা লম্বা দেবে। বুড়ো বয়সে আমাদের পথে বসতে হবে।
ন্যাটাহারিবাবু এবার উঠে পড়লেন। বললেন, আমাকে একবার আপনাদের কনি মেমসায়েবের কাছে যেতে হবে।
কনির ঘরের দিকে যেতে যেতে ন্যাটাহারিবাবু বললেন, অথচ তাজ্জব ব্যাপার, আমার বালিশের সংখ্যা শুধু বেড়ে যাচ্ছে। মদের বিক্রি ডবল হয়ে যাচ্ছে। ঘরও খালি পড়ে থাকছে না। সেই যে রঞ্জিত সিং বলেছিল, তাই হলÍসব লাল হয়ে গেল।
ন্যাটাহারিবাবু বললেন, যাই, আপনার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ঘ্যানঘ্যান করলে আমার চলবে না। এই কনি মেমসায়েবের আরও বালিশ লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে আসি। আমি পাশ-বালিশ পর্যন্ত অফার করব। ন্যাটাহারিবাবু নাকটা বাঁ হাতে ঘষতে ঘষতে বললেন, ব্যাটারা পাশ-বালিশ ব্যবহার করে না। আমার মাঝে মাঝে প্রতিশোধ নেবার জন্যে ওদের পাশ-বালিশের নেশা ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। দুএকজনের ধরিয়েও দিয়েছি। ওরা নাম দিয়েছে-ন্যাটাহারি পিলো। অভ্যাসটা একবার ধরলে আর ছাড়তে পারবে না। বারোটা বেজে যাবে। এই পাশবালিশ নিয়ে শুয়ে শুয়েই তো আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল।
বাইরে এসে দেখলাম, আরও গাড়ি আসছে। বুড়ো গাড়ি থেকে ছোকরা নামছে, ছোকরা গাড়ি থেকে বুড়ো নামছে। পুরুষ কলকাতার নির্যাস যেন আমাদের এই শাজাহান হোটেলে ভিড় করছে। আর, আমরা সেইখানে বসে আছি যার দুমাইল দূরে একদা রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অরবিন্দ, সুভাষচন্দ্র ভারত সন্ধানে আত্মনিবেদন করেছিলেন। উইলিয়ম জোন্স প্রাচ্যবাণীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ডেভিড হেয়ার ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন।
শাজাহানের মমতাজ রেস্তোরাঁয় আজ তিলধারণের স্থান নেই। রেস্তোরাঁর দরজার সামনে একটা টেবিল, টিকিট বই ও ক্যাশবাক্স নিয়ে উইলিয়ম ঘোষ জাঁকিয়ে বসে আছে। অনেকে অ্যাডভান্স টিকিট কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফোকলা চ্যাটার্জি তাঁর মিস্টার রঙ্গনাথনকে নিয়ে ইতিমধ্যেই সামনের সারিতে চেয়ার দখল করেছেন। মিস্টার চ্যাটার্জি আজ জাতীয় পোশাক পরেছেন। পরবাসীয়া দরজার মুখে দাঁড়িয়ে সায়েবদের জামাকড়ের দিকে নজর রাখছে।
এক ভদ্রলোক বুশশার্ট পরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। পরবাসীয়া বাধা দিলে। উইলিয়ম উঠে পড়ে দরজার সামনে নোটিসটা দেখিয়ে বললে, আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। আপনি এই ড্রেসে ঢুকতে পারবেন না। ইংরিজিতে দরজার সামনে জ্বলজ্বল করছে রাইট অফ অ্যাডমিশন রিজার্ভড।
ভদ্রলোকের মুখটা লাল হয়ে উঠল। বললেন, স্বাধীন ভারতে এখনও দক্ষিণ আফ্রিকার রাজত্ব চলছে? আমি বললাম, যথেষ্ট সময় রয়েছে, আপনি এখনও জামাকাপড় পাল্টিয়ে আসতে পারেন।
ভদ্রলোক রাগে গরগর করতে করতে চলে গেলেন। কিন্তু মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যেই সম্পূর্ণ সায়েব হয়ে ফিরে এলেন। দেখতে পেয়েই আমি তাকে নমস্কার করলাম। ভদ্রলোক বললেন, আমার আড়াইশো টাকা গচ্চা গেল। দোকান থেকে রেডিমেড কিনে পরে আসতে হল। আপনাদের টাইট দিচ্ছি এ-বিষয়ে আমরা কাগজে চিঠি লিখব।
মদ বিক্রি হচ্ছে প্রচুর। আটটা থেকেই তোবারক ও রাম সিং ভটাভট সোডার বোতল খুলছে। বিয়ার, হুইস্কি, রাম ও জিন বোতলের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে গেলাসের মধ্যে নাচানাচি করছে। মার্কোপোলো রাম সিং-এর কাছে খবর নিয়ে গেলেন। রাম সিং বললে, বহুৎ গরম। ছে-সাত হাজার রুপিয়াকো সেল হো যায়েগা।
ফোকলা চ্যাটার্জি দুটো হোয়াইট লেবেল টেনে, একটা বড়া পেগ ডিম্পস্কচ-এর অর্ডার দিলেন। এদিকে কাঁচা-পাকা চুলওয়ালা রঙ্গনাথন এক পেগ সিনজানো ভারমুথ নিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখেই চ্যাটার্জি বললেন, মিস্টার রঙ্গনাথনকে নিয়ে যে কী মুশকিলেই পড়েছি। বলছি যস্মিন দেশে যদাচার। স্কটল্যান্ডের মেয়ে কনি, আর স্কটল্যান্ডের মাল ডিম্পল। কিন্তু রঙ্গনাথন সায়েব ইটালিকে কোলে করে বসে আছেন।
রঙ্গনাথন মৃদু মাথা নেড়ে বিমর্যভাবে বললেন, ব্লাড় প্রেসার। চ্যাটার্জি বললেন, একটা পেগ চড়ান। প্রেসার তালগাছ থেকে মাটিতে নেমে আসবে। আর কনি আপনার সর্পগন্ধার কাজ করবে। ভারি সিডেটিভ মেয়ে নার্ভগুলোকে যেন ঘুমপাড়িয়ে দেয়। ক্যালকাটায় ওর এই ফাস্ট-কিন্তু আমার এক বন্ধু কায়রোতে ওকে দেখেছে। ওর শো দেখবার জন্যে বন্ধু আমার দামাস্কাস থেকে কায়রো চলে গিয়েছিলেন।
রঙ্গনাথন বললেন, হুইস্কিটা ঠিক আমার অভ্যাস নেই। জিভ কেটে ফোকলা বললেন, এই সব ইয?ংম্যানদের সামনে ও-কথা বলবেন না। বাহান্ন বছর বয়সে হুইস্কি অভ্যাস করেননি শুনলে এরা হাসতে আরম্ভ করবে। ক্যালকাটায় এটা আমাদের স্বপ্নেরও অতীত।
রাম সিং তোবারক আলি এবং অন্যান্য ওয়েট বয়দের ছোটছুটি বাড়ছে, সিগারেটের কটু ধোঁয়ায় হ-এর বাতাস ঝাঁঝালো হয়ে উঠেছে, যেন একটু আগেই কারা টিয়ার গ্যাস ছুড়ে দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটাও ক্রমশ দশটার ঘরে উঁকি মারছে, ডিনারের প্লেটের টুংটাং শব্দ যেন কোনো অর্কেস্ট্রার অংশ বলে মনে হচ্ছে। ফোকলা চ্যাটার্জি চিৎকার করে উঠলেন, আর কতক্ষণ?
এবার আমার পালা। সর্দিতে বোসদার গলা বুজে গিয়েছে। মাঝে মাঝে কাশছেন। মার্কোপোলেও রাজি হয়েছিলেন। বলেছিলেন ইয?ংম্যানকে একটা সুযোগ দেওয়া যাক। ওধারে গোমেজের দল অবিশ্রান্তভাবে বাজিয়ে চলেছে।
বোসদা দরজার কাছ থেকে আমার দিকে ইঙ্গিত করলেন। সিনেমা হ-এর মতো হঠাৎ কোণের উজ্জ্বল আলোগুলো নিভে গেল। স্টেজের সামনে গিয়ে মাইকটা বাঁ হাতে নিয়ে দুরু দুরু বক্ষে আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার ইঙ্গিতে অর্কেস্ট্রা বন্ধ হয়ে গেল। গোমেজ চাপা গলায় বললেন, চিয়ারিও।
আমি দেখলাম সাড়ে তিনশ লোকের সাতশ চোখ হঠাৎ প্রত্যাশায় সজাগ হয়ে উঠল। আমার মুখ দিয়ে আমার অজান্তেই বেরিয়ে পড়লÍলেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। সমস্ত হ-এ সেদিন একটাও প্রকৃত লেডিকে খুঁজে বার করতে পারলাম না। তবু পুনরাবৃত্তি করলাম, গুড ইভনিং, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। শাজাহান হোটেলের এই মধুর সন্ধ্যায় আপনারা আশা করি আমাদের ফরাসি সেফের রান্না এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সযতেœ চয়ন করা ড্রিঙ্কস উপভোগ করেছেন। নাউ, আই প্রেজেন্ট টু ইউ কনি। আপনাদের বৈচিত্র্যময় জীবনে আপনারা অনেক উয়োম্যান দেখেছেন। বাট সি ইজ দি উয়োম্যান যা এই শতাব্দীতে ভগবান একটিই সৃষ্টি করেছিলেন।
এবার আলোগুলো একসঙ্গে নিভে গেল। সমস্ত হ-এর মধ্যে একটা চাপা প্রত্যাশার গুঞ্জন উঠল।
চাপা প্রত্যাশার গুঞ্জন হঠাৎ যেন কোনো অদৃশ্য প্রভাবে স্তব্ধতায় বিলীন হয়ে গেল। কিন্তু সে কেবল মুহুর্তের জন্য। কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সেই হারিয়ে-যাওয়া শব্দ যেন অকস্মাৎ আলোতে রূপান্তরিত হল। অন্ধকারের বুক ভেদ করে ছুঁচের মতো সরু আলোর রেখা স্টেজের সামনে এসে পড়ল। সেই আলোর রেখা মত্ত অবস্থায় কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কে যেন স্টেজের উপর এসেও দাঁড়িয়েছে; কিন্তু মাতাল আলোর রেখা কোথাও স্থির হয়ে। দাঁড়াতে পারছে না। স্টেজের উপর যে দেহটা অন্ধকারের ঘোমটা পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই কি কনি?
পৃষ্ঠপোষকদের ঔৎসুক্যে আর সুড়সুড়ি না দিয়ে আলোর রেখাটা এবার বেশ মোটা হয়ে উঠল। কিন্তু কোথায় কনি? কনি নেই। সেখানে ইভনিং স্যুটপরা দুফুট লম্বা এক বামন ঘোরাঘুরি করছে। তার মাথায় একটা তিনফুট উঁচু টুপি। বামন সায়েবের হাতে ছড়ি।
আশাহত দর্শকদের বিস্ময় প্রকাশের কোনো সুযোগ না দিয়ে বামনটা টুপিটা খুলে বাঁ হাতে নিয়ে, হাতের ছড়িটা ঘুরিয়ে, একটা চেয়ারের উপর উঠে পড়ে বললেÍগুড ইভনিং, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। আমিই কনি দি..বলে, যেন ভুলে গিয়েছে এমনভাবে বিড় বিড় করে গুনতে লাগল ছেলে না মেয়ে, মেয়ে না ছেলেৃনা, আমিই সেই মেয়েমানুষ কনি, কনি দি উয়োম্যান।
দর্শকরা এবার একসঙ্গে হই-হই করে উঠলেন। সমৃদ্ধ কলকাতার দুএকজন সম্রান্ত নাগরিক আর স্থির থাকতে পারলেন না। চেয়ার থেকে উঠে পড়ে চিৎকার করে বললেন, আমরা কনিকে চাই। এই বিটলে বামনটা কোথা থেকে এল?
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাকেও অভিনয় করতে হল। যেন কনির বদলে এই বামনকে স্টেজের উপর দেখে আমিও মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছি, এমন ভাব করে মাইকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললাম, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এই পাঁচ মিনিট আগেও আমি কনির ঘরে গিয়েছিলাম। ওর জামাকাপড় পরা হয়ে গিয়েছিল। একটা ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে যাচ্ছিল। আমাকে বললে, তুমি অ্যানাউন্স করোগে যাও, আমি রেডি, তারপর এই দুফুট ভদ্দরলোক যে কোথা থেকে এলেন!।
বামন কিন্তু দমল না। আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই তেড়ে মাইকের কাছে এসে, মাইকটা নামিয়ে মুখের কাছে এনে, মেয়েদের মতো সরু গলায় বললে, বিশ্বাস করুন, আমিই কনি। আমি একটা ভুল ওষুধ খেয়ে ফেলেছি। সে যাই হোক, আপনারা যে আমার জন্যে এই রাত এগারোটা পর্যন্ত জেগে রয়েছেন, এর জন্যে আমি গর্ব বোধ করছি। বলা শেষ করেই, বামন ক্যাবারে মেয়েদের কায়দায় নাচতে আরম্ভ করলে। সমস্ত হল এবার হই-হই করে উঠল।
আমি এবার মাইকের কাছে গিয়ে বললাম, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, আপনারা অধৈর্য হবেন না। আমি এখনই ডাক্তার ডাকবার জন্যে লোক পাঠাচ্ছি। ভুল ট্যাবলেট খাবার ফলেই এই অঘটন ঘটেছে।
বামন এবার বললে, পাঁচ মিনিট আগে আমার নারীত্ব, আমার যৌবন সব ছিল। কিন্তু এখন তারা যে কোথায় গেল, বামন এবার নিজের দেহটা নিজেই হাত দিয়ে খোঁজ করতে লাগল। পকেট থেকে আর একটা ট্যাবলেট বার করে সে খেলো। তারপর কি যেন মন্ত্র পড়তে লাগল।
হঠাৎ আবার আলো নিবে গেল এবং প্রথম সারির এক মারওয়াড়ি ভদ্রলোক পরমুহূর্তেই কাতর চিৎকার করে উঠলেন। ও। আমার কোলে কে যেন এসে বসেছে।
আমি এদিকে থেকে অন্ধকারের মধ্যে বললাম, ভয় পাবেন না। কেমন বুঝছেন? মারওয়াড়ির ততক্ষণে ভয় কেটে গিয়েছে। তার কোলে কী জিনিস হঠাৎ ধপাস করে বসে পড়েছে তা তিনি বুঝতে পেরেছেন। তিনি এবার অবলীলাক্রমে উত্তর দিলেন, বহুত্ সফট খুব নরম!
এবার একটা আলো জ্বলে উঠল, এবং সেই আলোতে দেখা গেল মারওয়াড়ি ভদ্রলোকের গলা জড়িয়ে বসে রয়েছে কনি। তার মাথায় টায়রা, গলায় হার, পায়ের গোড়ালি থেকে হাতের মণিবন্ধ পর্যন্ত রঙিন নরম কাপড়ে ঢাকা। এবার আরও কয়েকটা আলো জ্বলে উঠল এবং সেই মারওয়াড়ি ভদ্রলোককে টানতে টানতে স্টেজের উপর নিয়ে এসে দর্শকদের দিকে মাথা নত করলে, কনি দি উয়োম্যান।
মারওয়াড়ি ভদ্রলোক ভুড়ি নিয়ে কোনোরকমে ওর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের চেয়ারে ফিরে গেলেন। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, কনি আপনাদের সামনে উপস্থিত। ইনি টেলিভিশনে বহুবার অভিনয় করেছেন। একবার মহামান্য ষষ্ঠ জর্জের সামনেও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আজ আপনারা সকলেই এই বালিকার মহারাজা। কিং এমপারার অফ কনি দি উহোম্যান!
কনি এবার নাচতে শুরু করল। সেই পুরো কাপড়ের আলখাল্লা সমেত নাচের মধ্যে তেমন গতি ছিল না। দর্শকরা যেন একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। কনি বললে, মাই ডার্লিং ক্যালকাটাওয়ালাজ, আমি শুনলাম তোমাদের কয়েকজন আমার স্ট্যাটিসটিকস চেয়েছ। আমি দুঃখিত, আমার সংখ্যা কিছুতেই মনে থাকে না। তোমরা কেউ যদি আমার ফিগারগুলো হিসেব করে নিয়ে যাও। অঙ্কের কোনো প্রফেসর এখানে আছেন নাকি?
দর্শকদের মধ্যে থেকে কেউ উত্তর দিলেন না। চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট? কনি মুখ বেঁকিয়ে এবার প্রশ্ন করল। এবারেও কোনো উত্তর নেই।
এনি দর্জি? এবারেও সভাগৃহ নিঃস্তব্ধ হয়ে রইল। মাই ডিয়ার ডিয়ার কনি কপট দুঃখে চোখ মুছতে লাগল। এই গ্রেট সিটিতে কি দর্জি নেই? তোমাদের গার্লরা কি সেলাই করা কিছুই পরে না?
এবার সকলে একসঙ্গে হেসে উঠল।
(সংকলিত)
——চলবে




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com