বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২১ অপরাহ্ন

অদ্বৈত মল্লবর্মণ : প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক

রহমান হাবিব
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২৪

(পূর্ব প্রকাশের পর) নায়িকার ‘বসন বিমা কাঁপে গাও’ (পৃ ১০০) ভাষ্যমধ্য দিয়ে নায়িকা যে বস্ত্রাভাবে শীতে কষ্ট পায়, সে-কথাই স্পষ্টভাষিত হয়।
‘পরিহাস সঙ্গীত’ অংশে ‘নাতীনের গান’ এবং ‘ঝিয়ারির গান’ শীর্ষক দুটো গানের বিশ্লেষণ করেছেন লেখক নাতনি তার বধূয়া কর্তৃক বহুদিন যাবৎ বিচ্ছেদে থাকায় নাতিনের অন্তর বিরহকাতর। বন্ধু ভাত খাবে বলে নাতনি ভাতসহ মাগুর মাছ রান্না করেছে, তাকে খাওয়ানোর জন্যে। তার বন্ধু ‘রঙ্গী চঙ্গী’ বলেই অন্য নারীর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়। নাতনিও যৌবন বেদনায় আর্ত; সে তার দিদিকে বলে :
কতকাল রাখিব যৌবন গো দিদি, বসনে বান্ধিয়া
(ওই, )
‘ঝিয়ারির গানে’র ঝিয়ারির সঙ্গে ‘তালৈ’র অসম সম্পর্কসূচক শরীরী-প্রেমের ব্যাপারে অশ্লীলতার ইঙ্গিত গানটিতে রয়েছে। ঝিয়ারি সাজপোশাকে টিপটপ। ঝিয়ারির যৌবনকে প্রথমে ‘তামা কাঁসা’ বললেও পরে যৌবনকে ‘মেঘের ফোঁটা’ বলে যৌবনের ক্ষণস্থায?িত্বের কথাই বোঝানো হয়েছে। যৌবনে পদস্খলিত না হবার আকাঙ্ক্ষাই গানটিতে অভিব্যক্ত। কারণ যৌবনের গর্ব করা ভালো নয় বলে গানটিতে উল্লিখিত আছে :
ঝিয়ারীর যৌবন মেঘের ফোঁটা দেশ বিদেশে রইল খোটা
আম কাঁঠাল তো আষাঢ়ের পর থাকে না
এ যৈবনের গৈরব কথা ভাল না।
(ওই, পৃ ১০২)
‘মাঘমন্ডল’ রচনায় বলা হয়েছে, পূর্ববঙ্গ ও শ্রীহট্টের পল্লীর অবিবাহিত হিন্দু বালিকারা সূর্যব্রত অনুষ্ঠান করে তারা চন্দ্র-সূর্যকে প্রণতি জানায়। মেয়েরা আনন্দ, নিষ্ঠা ও ভক্তির সঙ্গে এই পূজা করে। পূজা শেষে সূর্য দেবের নিকট প্রণতি করে ‘বর’ প্রার্থনা করে। গানভাষ্য :
চান্দ পূজলাম চন্দনে/ সুরুজ পূজলাম বন্দনে
চান্দ পূজ্যা পাইলাম স্থান/ সুরুজ পূজ্যা স্বর্গধাম।
(ওই, পৃ ১০৪)
‘অপ্রকাশিত পুতুল বিয়ের ছড়া’ রচনাবেশে বালিকার পুতুলকে বিয়ে দেবার কথাচ্ছলে আসলে বালিকার প্রকৃতপক্ষে বিয়ে হয়ে যাবার কথাই অভিব্যক্ত হয়েছে। জামাইকে খাট, পালঙ্ক, তামা, কাঁসা, আসন, বসন, হাতি, ঘোড়া, দাসি, বাঁদি সবকিছু দেওয়া হলো; তবুও জামাই খুশি নয়। কন্যাও দেওয়া হলো, তবুও সে খুশি নয়। আসলে সে কন্যা তো পুতুলকন্যা। প্রকৃত কন্যার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সেই কন্যা তাঁর মায়ের ‘কান্দন’ শুনে; শুধু তাই নয়, কন্যার জন্যে
ভাই কান্দে বাবা কান্দে গামছা মুখে দিয়ে
সোনামুখী বইনে কান্দে পন্থপানে চাইয়া
পেট-পোড়ানী মায়ে কান্দে ভূমিতে লুটাইয়া।
(ওই, পৃ ১০৭)
‘অপ্রকাশিত বাউল সঙ্গীত’ অংশে কোনো আলোচনা নেই; শুধু ছয়টি গান সংকলিত হয়েছে। বাউল গানে মূলত স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির প্রেমময়তার সম্পর্ক সন্নিবদ্ধ থাকে। ১নং গানে আছে : ‘দেহের মধ্যে থাকে যে মনোরায়’ (পৃ ১০৮)। এই ভাষ্যমধ্য দিয়ে দেহের মধ্যে মনরূপী তথা আত্মরূপী যে স্রষ্টার অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃত আধ্যাত্মিক গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্রষ্টাকে চেনার কথাই এখানে অভিব্যক্ত হয়েছে। ৫নং গানে যে বলা হয়েছে, দেশের জন্য সাধকের প্রাণ কাঁদে; বিদেশে সে ঘুরে মরছে – এই ভাষ্যমধ্য দিয়ে আসলে আত্মার দেশে এবং স্রষ্টাময় অস্তিত্বের প্রকৃত দেশে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সাধনের মধ্যে অভিব্যক্ত হয়েছে; আত্মার দেশ ভিন্ন সাধারণলোকে তার অবস্থানকে সাধক মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। স্রষ্টার সন্ধানী যে হয়, মৃত্যু দেবতা যমের ভয় তার থাকে না; কারণ স্রষ্টাই তো তার বন্ধু; স্রষ্টার তো তার জন্য যথেষ্ট :
সেই দেশের যে দেশী হয় ঘোচে তার শমনের ভয়।
(ওই, পৃ ১০৯)
অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাহিত্যসমালোচনামূলক প্রবন্ধ
বর্মণের ‘রোকেয়া জীবনী’ রচনাটি সামসুন নাহার প্রণীত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনী-গ্রন্থের ভূমিকা। এটিকে আমি প্রবন্ধ হিসেবে অভিহিত করেছি লেখকের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন অভিমতের জন্যে। সমাজের ও পারিপার্শ্বিকতার প্রচন্ড বাধাবিপত্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে রোকেয়া তার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পেরেছিলেন বলেই বঙ্গীয় মুসলমান নারীসমাজ তাদের জাগরণ, শিক্ষাদীক্ষা ও আত্মমুক্তির পথ প্রশস্ত হওয়ার জন্যে রোকেয়ার নিকট চিরঋণী থাকবেন। বোরখার অন্তরালে অবরোধবাসিনী থেকে বঙ্গীয় নারীরা যে ক্লেশময় ও গ্লানিকর জীবনকে যাপন করেছে – রোকেয়ার প্রচেষ্টাতেই তারা আলোর মুখ দেখতে পেরেছে। জ্ঞানার্জনের স্পর্ধিত স্পৃহা রোকেয়াকে সমাজের রক্ষণশীলতার আগল ভেঙে নারীদেরকে অধিকার ও জীবনের কল্যাণময়তার বৃহত্তর বৃত্তে উপনীত করে দিতে সমর্থ করে তুলেছে বলে আমি মনে করি।
‘টিএস এলিয়ট’ অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি প্রাতিস্বিক ও প্রতিভাদীপ্ত সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। এলিয়ট কেন বড় ও মহৎ কবি এবং কীভাবে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যচিন্তাধারায় নবতর জাগরণ সৃষ্টি করলেন – সেই অনুদ্ঘাটিত প্রেক্ষাপটের দ্বারোন্মোচন করেছেন বর্মণ। এমন অন্তর্দৃষ্টিতে এলিয়টকে বিবেচনা করার সামর্থ্য বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অনেক শিক্ষকরাও রাখেন না বলে আমি মনে করি।
এলিয়ট ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মিসৌরির অন্তর্গত সেন্ট লুইনায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১২-১৪ পর্যন্ত তিন বছর এলিয়ট হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ভারতীয় ভাষাতত্ত্ব এবং সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করেন। ১৯১৪-তে অক্সফোর্ডের মার্টন কলেজে গ্রিক দর্শন অধ্যয়ন করতে আসেন। এ-সময় তিনি ব্রহ্মবাদ সম্পর্কেও প্রবন্ধ শেখেন। ব্রহ্ম আসলে পরমাত্মা বা স্রষ্টারই প্রকাশরূপ। এলিয়ট ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ছিলেন। স্রষ্টার প্রতি ছিল তাঁর প্রচন্ড গভীর বিশ্বাসবোধ। সে-কারণেই নৈতিক অশুদ্ধতা, চারিত্রিক বিকার ও অবক্ষয়কে তিনি প্রচন্ড নেতিবাচক মনে করতেন। সভ্যতার মধ্যে গর্বকারী কিছু নেই বলে মন্তব্য করে এলিয়ট দেখিয়েছেন যে, মানুষ যেখানে অন্তঃসারশূন্য, সেখানে সভ্যতাও তো নেতিবাচকতার এবং অবক্ষয়েরই নামান্তর হবে।
একজন বড় ও মহৎ কবি পৃথিবীর যে কোনো দেশেরই মহৎ কবির স্বগোত্র। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের কথাই তিনি উচ্চারণ করেন।
রোমান্টিক কবিতা যখন কবিদের অন্তরাত্মা হাওয়ায় উড়িয়ে বেড়াচ্ছিল; এবং ব্যক্তিগত দুঃখবোধের নৈরাশ্যে যখন ব্যক্তি অতল গহবরে মজ্জমান হচ্ছিল; তখন এলিয়ট সমষ্টির দুঃখবেদনা, অভাব ও নৈরাশ্যকে প্রাজ্ঞতার দৃষ্টিতে সাহিত্যিক সমক্ষে উদ্ঘাটিত করে মানবতার ও প্রজ্ঞার প্রকৃত রূপকে স্পষ্টায়িত করতে সচেতন প্রয়াসী হলেন।
ত্রিশের দশকের পাশ্চাত্য বুদ্ধিবৃত্তি ভারতীয় বেদ ও উপনিষদের আত্মা-পরমাত্মা ও স্রষ্টাতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এলিয়ট নিজেও বেদান্ত প্রভাবিত ব্যক্তিত্ব। সে-কারণে ভারতীয় কালতত্ত্বের ভাববাদী দর্শন একটি শাশ্বত ও সূক্ষ্ম অনুভববাদী স্রষ্টাময়ী দর্শন একথা প্রাজ্ঞজন স্বীকার করছেন। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও চিন্তাদর্শনের সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হলো, সে-সভ্যতা ত্যাগকে বিসর্জন দিয়ে ভোগবাদিতাকে বড় করে তুলেছিল। সে-কারণেই সেই সভ্যতায় ফাঁপা মানুষের জন্ম হয়েছে বেশি। ভারতীয় দর্শন ভোগবাদী নয়; মূলত ত্যাগবাদী দর্শন। এটিই আমাদের দর্শনের শক্তিমত্তাকে স্পষ্টায়িত করে। পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজে যা নয়, তার চেয়ে বেশি বলে নিজেকে দাবি করে। এলিয়ট পাশ্চাত্য সভ্যতার অবক্ষয়, অন্তঃসারশূন্যতা, মেকিত্বকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন। পাশ্চাত্য সভ্যতার সভ্য মানুষগুলো যে কত অখাঁটি, কত অসার, কত ফাঁপা, কত অকিঞ্চিৎকর ও কত অন্তঃসারশূন্য, তা এলিয়ট স্পষ্টতার সঙ্গে উপস্থাপন করলেন।
এলিয়টের সভ্যতা ব্যবচ্ছেদে তাঁর মধ্যে নৈরাশ্য ও দুঃখবাদ প্রতীয়মান হলেও প্রচলিত মেকিত্ব ও ভন্ডামিপূর্ণ সভ্যতা-স্রোতের বিরুদ্ধে তিনি নৈতিকতা, ইতিবাচকতা, মূল্যবোধ, বিশ্বাসময়তা ও প্রশান্তির সুরকে জাগ্রত করার নিমিত্তে তখনকার বাহ্য ফ্যাশনবহুল কবিতাকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে তেজিত্বপূর্ণ, খাঁটি, অকৃত্রিম ও শোভন বোধকে উচ্চবিত্ত আনন্দময়তায় অবগাহিত করে তুললেন। তাঁর The Wasteland (১৯২২) সেই ভাষ্যেরই মননচিত্র।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে এলিয়টের Prufroch এবং ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের চড়বসং-এর মধ্যে সে স্পষ্টভাষিত বিশ্বনিন্দাবাদের সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছিল; তা প্রচলিত চিন্তাচর্চার খুব বিরোধী হলেও বুদ্ধিজীবী মানসে তা নবচেতনার ও প্রজ্ঞার নব-উদ্দীপনার কারণে আন্দোলন ও আলোড়ন সৃষ্টি করতে শুরু করল। ভঙ্গুর সভ্যতাও জীবন্মৃত মানুষকে জাগ্রত করতেই তিনি বিশ্বাসময় শুভ্রতার সুর তাঁর কবিতায় সচেতনভাবে আমদানি করলেন।
বিপ্লবমুখী সমাজ-বিশ্লেষণ ও ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণী ভাবনার নৈরাজ্য যখন বিশ্বচিন্তারাজ্যকে জবরদখল করে তুলেছিল; তখন এলিয়টের সাহসী, নীতিবাদী ও স্রষ্টাবিশ্বাসী সুরের অমোঘ শক্তিমত্ততা সভ্যতার ইতিবাচকতাকে আলোর পথে প্রধাবিত করেছে বলে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের বিষয়নির্ভর, লোকসংগীতনির্ভর এবং সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধসমূহের অন্তর্গভীরে দৃষ্টিপাত করলে আমরা প্রত্যক্ষ করি যে, তাঁর জৈবনিক বোধের গভীরতা, জীবনদৃষ্টির তীক্ষ্ণতা এবং মানবের প্রতি মমত্ববোধের প্রগাঢ়তা এবং ভাষাশিল্পের আভিজাত্য তাঁকে বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যের একটি পরিণত জায়গায় সমাসীন করে। সমাপ্ত ( উৎস: কালি ও কলম)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com